রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে না তাকিয়ে যেভাবে বাংলাদেশকে উন্নত করা যায়

shahbag_candlevigil

 

শাহবাগের যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলন এর মাধ্যমে মানুষের দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং দেশের জন্যে কিছু করার ইচ্ছা দেখে আমি অভিভূত।

রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই থাকুক না কেনো সবাই মোটামুটি একটা জায়গায় এসে একমত – বাংলাদেশকে একটা সমৃদ্ধ, আধুনিক, চমৎকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই সবাই। জামাত-শিবির এবং তাদের মতো জঙ্গি দলগুলো চাইবে আমাদেরকে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো বানিয়ে ফেলতে। কিন্তু আমরা চাইলেই তাদের প্রায় চোখের সামনে দিয়ে আমাদের দেশটাকে একটা উন্নত এবং আধুনিক দেশে পরিণত করে ফেলতে পারি। এমনকি আওয়ামীলীগ এবং বিএনপিও যদি আমাদের বিরুদ্ধে যায় তবু আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারি!

বাংলাদেশকে উন্নত করতে চাইলে আমাদেরকে -আমাকে এবং আপনাকে – অংশ নিতে হবে এই কাজে। দেশের প্রতি ভালোবাসার জন্যে একদিনের মধ্যে যদি শাহবাগ লক্ষ মানুষের জনসমুদ্রে পরিণত হতে পারে তাহলে এই লক্ষ মানুষই পারবে দেশকে বদলে দিতে। এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয় যে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি ক্ষমতার যাওয়ার ব্যাপারে যতোটুকু আগ্রহী হবে দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখানোতে ততোটা আগ্রহী তারা হবে না। জামাত-শিবির এবং জঙ্গি দলগুলো ব্যস্ত দেশটাকে মধ্য যুগে ফিরিয়ে নেওয়াতে। জাতীয় পার্টি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র দলগুলো ব্যস্ত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বড় দলগুলোর ভাড়া খাটায়। এই অবস্থায় দেশটাকে উন্নত করার, সমৃদ্ধ করার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আসলে আমাদের সাধারণ মানুষের হাতে, ছাত্র-শিক্ষক-চাকুরিজীবি-ব্যবসায়ী-শ্রমজীবি মানুষের হাতে।

মনে হতে পারে আমরা একটা তৃতীয় রাজনৈতিক দল তৈরি করতে পারি। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে। আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির মতো দলের শেকড় বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। একদিন হঠাৎ করে আমরা একটা রাজনৈতিক দল করবো আর মানুষ দলে দলে আমাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাবে সেটি হবার নয়! অনেক অনেক দিন (কয়েক দশক!) ধরে চেষ্টা করলে হয়তো একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা যাবে কিন্তু সেটাও নিশ্চিত নয়, এবং এই দীর্ঘ সময়ে আসলে আমরা দেশের জন্যে অনেক বেশি কিছু করে ফেলতে পারতাম। সবচেয়ে বড় কথাঃ আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে একটা সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত দেশে পরিণত করা, ক্ষমতায় যাওয়া নয়!

তাহলে কিভাবে আমরা খুব সহজে রাজনৈতিক দলগুলোর নাকের ডগা দিয়ে আমাদের দেশটাকে একটা সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত দেশে পরিণত করতে পারবো?

বাংলাদেশকে একটা চমৎকার এবং সুখী দেশে পরিণত করতে হলে আমাদেরকে বাংলাদেশের মানুষগুলোর প্রত্যেককে একেকজন চমৎকার এবং সুখী মানুষে পরিণত করতে হবে! বাংলাদেশ মানে যতোটা না ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটা ব-দ্বীপ তার চেয়ে বেশি হচ্ছে ষোল কোটি মানুষ। একটা দেশকে সঙ্গায়িত করে তার মানুষেরা। আমাদেরকে ক্ষমতায় কে আছে সেটা না ভেবে নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের এবং কাছের মানুষদের চমৎকার মানুষে পরিণত করতে হবে। দেশের জন্যে কিছু করার এই পদ্ধতির নাম আমি দিয়েছি “মুহম্মদ জাফর ইকবাল মডেল”। জাফর ইকবাল স্যার যেমন কোনো ব্যক্তিগত লোভ বা স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে, কোনো দলের দিকে না তাকিয়ে, “একজন মাহাথির” এর অপেক্ষায় না থেকে একেবারে নিজে থেকে নিজের মতো করে দেশের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন – নিজের বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করে যাচ্ছেন, দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীকে উদ্দীপ্ত করে যাচ্ছেন – আমাদেরকে সেভাবেই কোনো স্বপ্নের দল বা ব্যক্তির অপেক্ষা না করে দেশের জন্যে কাজ করে যেতে হবে। প্রত্যেকে নিজের অবস্থানে থেকে কাজ করে গেলে বাংলাদেশকে একটা উন্নত দেশের পরিণত করতে খুব বেশি সময় লাগবেনা। শুধু দেশকে নিয়ে স্বপ্নটাকে জিইয়ে রাখতে হবে, কখনো হতাশ হলে চলবেনা, নিজের নাম কামাইয়ের কথা ভুলে যেতে হবে, ফেইসবুকে কয়টা লাইক পেলাম সেটার কথা ভুলে কাজ করে যেতে হবে।

দেশের মানুষের জন্যে কিছু করতে চাইলে আমাদের প্রথমে তিনটা মূল জিনিস নিয়ে কাজ করতে হবেঃ নিজেকে এবং আশে পাশের সবাইকে একটা চমৎকার বিজ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে, মানুষের মনে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা আনার জন্যে কাজ করতে হবে, এবং দেশের মানুষের শারীরীক এবং মানসিক স্বাস্থের জন্যে কাজ করতে হবে।

আসুন দেখি এই তিনটা জিনিস কিভাবে আমাদের দেশের চেহারা বদলে দিতে পারে। কিভাবে জামাত-শিবির এর মতো জঙ্গি দল এবং তাদের মদদ-দাতা দলগুলোর চোখের সামনে দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে তাদেরকে অস্তিত্বশুন্য করে দিতে পারি কোনো রকম সহিংসতা ছাড়াই।

একটা চমৎকার বিজ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষাঃ

রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ধর্ম নিয়ে আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের কারো মধ্যে কোনো দ্বিমত নাই। মধ্যাকর্ষণ নিয়ে সবাই একমত, কার-বাস-ট্রাক চলার প্রযুক্তি নিয়ে সবাই একমত, রাস্তা বানানোর ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েও সবাই একমত। বিজ্ঞানে কোনো হাঙ্কি-ফাঙ্কি নাই। সবকিছু চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই এরপর কোনো কিছুকে নিশ্চিত বলে ঘোষনা করা হয়। তাই বিজ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে কিংবা মানুষ বিজ্ঞান মনষ্ক হলে মানুষের চিন্তা ভাবনা অনেক যৌক্তিক হয়। কোনো কিছু ভালো করে যাচাই বাছাই না করে মানুষ তখন আর বিশ্বাস করে না। বগুড়ার যে মানুষগুলো সাইদিকে চাঁদে দেখা গিয়েছে বলে রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে ছুটে যেয়ে থানা আক্রমণ করতে গিয়েছে তারা বিজ্ঞান মনষ্ক হলে কোনোদিন সাইদিকে চাঁদে দেখতো না। বিজ্ঞান মনষ্ক মানুষকে সাইদি তার ওয়াজ-মাহফিলে বেহেশতের টিকেট দিতে পারবেনা। মানুষ যখন ক্রিটিকাল থিঙ্কিং করে তখন কোনো গুজবে তাকে বিশ্বাস করানো কঠিন হয়ে পড়ে।

আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা যাতে আধুনিক বিজ্ঞান-ভিত্তিক হয় সে ব্যাপারে আমাদের কাজ করতে হবে। বিশ্বজগতের বিবর্তন, জীবজগতের বিবর্তন, পৃথিবীর জন্মের পর থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন বছরের বিবর্তন, মানুষের গুহা মানব থেকে উঠে এসে আজকের এই অবস্থায় আসার ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটা মুখস্ত-নির্ভর পরীক্ষার ব্যবস্থা থেকে উদ্ধার করে মস্তিষ্ককে ব্যবহার করার ব্যবস্থায় পরিণত করতে হবে। মানুষ তার মস্তিস্কের ক্ষমতার এক ক্ষুদ্রাংশ ব্যবহার করে; আমাদেরকে মস্তিস্কের সেই ব্যবহৃত অংশের পরিমাণ বাড়ানোর জন্যে কাজ করতে হবে।

এটা ঠিক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক করার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার যদি তার দায়িত্ব ঠিকভাবে না করে (ইচ্ছা এবং/অথবা যোগ্যতার অভাবে) – যেটার সম্ভাবনাই বেশি – তাহলে আমাদেরকে আমাদের মতো করে কাজ করে যেতে হবে। শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সাইদ স্যার কয়েক দশক ধরে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র দিয়ে আমাদের আলোকিত করার কাজ করে যাচ্ছেন; জাফর ইকবাল স্যার, মুনীর হাসান ভাই আর তাদের সাথে শত শত তরুণ তরুণী গণিত, ভাষা, বিজ্ঞান, এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে সারা দেশে কাজ করে যাচ্ছে; রাগীব হাসানের শিক্ষক ডট কম বিনামূল্যে দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স। এগুলো হচ্ছে যেগুলোর খবর আমরা জানি। আমাদের জানার বাইরে কতো অসংখ্য মানুষ তাদের মতো করে শিক্ষা বা শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বই লিখে, পত্র-পত্রিকায় লিখে, ব্লগ লিখে, কিংবা কনফারেন্স-সেমিনার-বক্তৃতা আয়োজন করেও অনেকে দেশের শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। সবকিছুর উপরে, সবচেয়ে গুরুত্মপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন বাবা-মা’রা। অন্যদের জন্যে কী করছেন সেটি যতোটা না গুরুত্মপূর্ণ তার চেয়ে গুরুত্মপূর্ণ হচ্ছে নিজের ছেলেমেয়েদের একটা চমৎকার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। স্কুল-কলেজে তারা যাই শিখুক না কেনো আপনি আপনার সন্তানকে একজন মানবিকতাবোধসম্পন্ন, বিজ্ঞান মনস্ক, যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন। চিন্তা করে দেখুন বাংলাদেশের সব বাবা-মা যদি তাদের সন্তানদের একজন চমৎকার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে তাহলে বাংলাদেশ কতো সহজে একটা আধুনিক এবং উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে?

মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাঃ

আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভূমিকায় আছে এই কথাগুলোঃ

“We hold these truths to be self-evident, that all men are created equal, that they are endowed by their Creator with certain unalienable Rights, that among these are Life, Liberty and the pursuit of Happiness.”

অর্থাৎ – “আমরা এই সত্যগুলিকে স্বতসিদ্ধ বলে জানিঃ সকল মানুষ সমান অধিকার নিয়ে জন্ম নেয়; এবং সবাই সৃষ্টিকর্তা হতে কিছু অধিকার জন্মগতভাবে পায় যার মধ্যে আছে বেঁচে থাকার অধিকার, স্বাধীনভাবে জীবন ধারণের অধিকার, এবং নিজের জীবনে সুখী হওয়ার অধিকার”।

সেই ১৭৭৬ সাল থেকে আমেরিকার শাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে এই কথাগুলো। সব মানুষ সমান। কেউ কারো থেকে বড় বা ছোট নয়। আইন সবার জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য। খেটে খাওয়া শ্রমিক থেকে শুরু করে বিলিওনেয়ার শিল্পপতি সবার আইনের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে সমান।

আমাদের বাংলাদেশে আমরা ছোটকাল থেকে শিখি “বড়দের সম্মান করো”, “গুরুজনকে মান্য করো”, “শিক্ষকদের সম্মান করো”, “তোমার বসকে সম্মান করো”, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের কখনোই শেখানো হয়নি যে *সব* মানুষকে সম্মান করো, শ্রদ্ধা করো, ভালোবাসো! ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েদের শ্রদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায়; খেটে খাওয়া রিকশাওয়ালাকে শ্রদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায়; কঠোর পরিশ্রম করা গার্মেন্টস কর্মীদের শ্রদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায়; ঘরের কাজ করার মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায়; আপনি অফিসের বড় কর্তা হলেও আপনার অধস্তনদের শ্রদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায়। কার পকেটে বা ব্যাংকে কতো টাকা আছে কিংবা কে কতো চমৎকার বাসায় থাকে, বা কে কতো দামী জামা-কাপড় পরে এগুলো মনে না রেখে মানুষের সাথে মিশলে আমি কী হনুরে অসুখ থেকে বাঁচা যায়।

যে কারণেই হোক আমাদের সমাজে সব মানুষকে সমান করে দেখার অবস্থা পুরোপুরি তৈরি হয়নি। প্রাচীন মুসলমান সমাজে ছিলো আশরাফ-আতরাফ ভেদাভেদ, হিন্দু সমাজে ছিলো বর্ণ সমস্যা। “সম্ভ্রান্ত বংশ” বলে একটা চরম অমানবিক শ্রেণী প্রথা এখনো চালু আছে আমাদের সমাজে।

শুধু দেশ দিয়ে নয়, সারা পৃথিবীর জন্যেও একই কথা প্রযোজ্য – পৃথিবীর সকল মানুষ সমান! আমার দেশ পৃথিবীর সেরা দেশ সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি, কোনো পরম মানদন্ডে সেটি সত্যি নয়। তেমনিভাবে আমার ধর্ম পৃথিবীর সেরা ধর্ম সেটাও আমার একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কোনো পরম মানদন্ডে সেটি সত্যি নয়। পৃথিবীর প্রতি এক’শ জন মানুষের মধ্যে প্রায় দুইজন আমার দেশের মানুষ, প্রতি এক’শ জন মানুষের মধ্যে প্রায় একুশ জন আমার ধর্মের মানুষ, তাই আমার দেশ বা আমার ধর্ম পৃথিবীর সবার দেশ বা ধর্মের উপরে এই ধরণের চিন্তা করা মানে পৃথিবীর একটা বড় অংশের মানুষকে আমার থেকে ছোট করা হয় (আসলে তো নিজেকেই নিজে ছোট করা হয়)!

জন্মস্থানের কারণে, ধর্মের কারণে, বংশের কারণে, গায়ের রঙ এর কারণে, পেশা’র কারণে কাউকে নিজের থেকে ছোট ভাবার মতো অমানবিক আর কিছুই হতে পারে না!

আমাদের সবার মাঝে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে কাজ করতে হবে। এই শিক্ষা সবার আগে শুরু হতে হবে পরিবার থেকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যদি দেখে তাদের বাবা-মা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে, কিংবা ঘরের কাজ করার মানুষকে নির্যাতন করছে, অসম্মান করছে, তাহলে সেই ছোট ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়ে নিজেরাও তাই করবে। বাবা-মা’র উচিৎ ছেলেমেয়েদের মধ্যে সব ধরণের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাবোধ তৈরি করে দেওয়া।

একজন মানুষ তখনই দেশের জন্যে কিছু করতে উদবুদ্ধ হবে যখন তার মধ্যে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকবে। কেউ দেশের জন্যে কিছু করতে চায় – এই কথাটার মানে হচ্ছে সে দেশের মানুষের জন্যে কিছু করতে চায়! তাই দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরি করার পুর্বশর্ত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মানুষকে ভালোবাসে এমন মানুষ তৈরি করা!

একটা সুস্থ এবং শক্ত শরীর (এবং মন):

আমাদের দেশে সব সময় অবহেলিত একটা বিষয় হচ্ছে সুস্বাস্থ্য। পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব হচ্ছে শরীর এর মাধ্যমে অথচ আমাদের বড় হয়ে উঠার মধ্যে শরীর নিয়ে কোনো শিক্ষা বা প্রচার একেবারে নাই বললেই চলে! আমার শরীর যে একটা খুবই গুরুত্মপূর্ণ জিনিস এবং আমার যে এই শরীরকে অনেক যত্ন নেওয়া উচিৎ, অনেক শক্ত করে তোলা উচিৎ এটা আমাকে খুব বেশি কখনো বলা হয়নি। শরীরের প্রতি যত্ন ব্যাপারটা “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল” ভাবসম্প্রসারণ এর মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে আমাদের জীবনে।

শরীর যে একটা গুরুত্মপূর্ণ জিনিস এটা আমি সত্যিকারভাবে বুঝতে পারি বিদেশে পড়তে আসার পর। এখানে বেশিরভাগ মানুষেরই চমৎকার স্বাস্থ্য, রাস্তায় বেরুলেই মানুষজনকে সকাল বিকেল দৌড়াতে দেখি, জিমে গেলে দেখা যায় সবাই শরীরকে শক্ত করার জন্য নানা ব্যায়াম করছে। এখানে সত্তর-আশি বছরের মানুষকে একা একা নিজের এবং ঘরের কাজ করতে দেখি যেখানে আমাদের দেশে ষাট এর পর বেশির ভাগ মানুষ এটা সেটা নানা অসুখ-বিসুখে কুপোকাত হয়ে পড়ে।

এখানে সব হাই স্কুল, কলেজ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সব ধরণের খেলাধুলার দল আছে এবং সেই স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই অলিম্পিকে যেয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পদক জিতে আসে। আমাদের বাংলাদেশে আমরা কয়জন ছেলেমেয়ে নিয়মিত খেলাধুলা করে বড় হয়েছি? আমরা কয়জন নিয়মিত ব্যায়াম করি?

আমাদের দেশের মানুষজনের শরীরের দিকে তাকালেই আমাদের শরীরের দৈন্য দেখা যায়, অযত্নের ছাপ দেখা যায়। বাংলা সিনেমা দেখলে হয়তো মনে হতে পারে আমরা অনেক স্বাস্থ্যবান কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা আসলে উলটা। আমাদের ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই বয়স ত্রিশ পেরুতে না পেরুতেই নধর একটা ভুড়ি গজিয়ে ফেলে। কেউ কেউ ভুড়ি না গজিয়ে শীর্ণকায় হয়। ব্যাপারটা নিয়ে মজা করা যায় কিন্তু এটা আমাদের শরীরের প্রতি অযত্ন আর অবহেলার প্রমাণ দেয়।

শরীরের সাথে মনের সম্পর্ক খুব নিবিড়। শরীর যদি দুর্বল হয়, চর্বির ভারে পেট যদি গড়িয়ে পড়ে তাহলে সেই শরীরে একটা চমৎকার মন থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। সেই শরীরের একটা বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিস্ক থাকাটাও কঠিন হয়ে পড়ে। শরীরের প্রতি অযত্নের কারণে মানুষ আগে আগে বুড়িয়ে যায় এবং আমাদের মতো একটা গরীব দেশের জন্যে তখন অনেক বেশি অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে হয়। আমরা যদি আমাদের শরীরের যত্ন নিই, যদি একটা শক্তিশালী শরীর এবং ব্রেইন ধরে রাখতে পারি তাহলে বেশি বুড়ো হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা অনেক বেশি দিন নিজের জন্যে, পরিবারের জন্যে, দেশের জন্যে কাজ করে যেতে পারি!

আমাদেরকে দেশের মানুষকে শরীর ভালো রাখার, শক্ত রাখার গুরুত্ম বোঝাতে হবে। রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকায় এটা নিয়ে বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। যারা স্বাস্থ্য-পুষ্টি-মেডিক্যাল বিষয়ে জানেন তাদের এটা নিয়ে লেখালেখি করতে হবে, রেডিও-টিভিতে যেয়ে বলতে হবে।

একটা শক্ত শরীরের মানুষ একটা শক্ত মনের অধিকারী হয়। তখন সে জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে কম ভয় পায়, বেশি ঝুঁকি নিতে পারে, বেশি পরিশ্রম করতে পারে, নিজের ব্যররথতার জন্যে অন্যকে বা ভাগ্যকে দোষ দেয় না, নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেয়, লটারি জেতার আশায় বসে থাকে না, মানুষের দোষ ত্রুটি খঁজে বেড়ায় না।

শেষ কথাঃ

দেশের উন্নয়ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আলাদা কোর্স আছে, এমনকি অনার্স-মাস্টার্স-পিএইচডি করার বিষয় পর্যন্ত আছে। আমি উন্নয়ন বিষয়ক পন্ডিত নই, কিন্তু আমার মনে হয় বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্যে আমাদের বাংলাদেশের মানুষের পেছনে বিনিয়োগ করতে হবে সবার আগে। যাদের দ্বারা আমরা স্বপ্ন দেখি, যাদের জন্যে আমরা স্বপ্ন দেখি, তাদেরকে উন্নত হওয়ার জন্যে আগে প্রস্তুত করতে হবে। এরপর এটা একটা পজেটিভ ফিডব্যাক লুপের মতো নিজেকে নিজে টেনে নিয়ে যাবেঃ একদল চমৎকার মানুষ আরেক দল চমৎকার মানুষ তৈরি করবে, তারা সবাই মিলে আরো চমৎকার মানুষ তৈরি করবে, এবং এভাবে এক সময় বাংলাদেশের বেশির মানুষ একেকজন স্বপ্নের মানুষে পরিণত হবে!

আর সেটি হবে তখন আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ!

যে দু’টো জিনিস আপনার জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে

sky

ছোটকালে পেপারে একটা বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখতাম, একজন জ্যোতিষের বিজ্ঞাপন – প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ঝামেলা, স্বামী-স্ত্রীতে অমিল, মানসিক সমস্যা, কর্মস্থলে সমস্যা, যাদু-টোনা, রোগ-বালাই, জমিজমা নিয়ে ঝামেলা, মামলা-মোকদ্দমা, ইত্যাদি যেকোনো সমস্যা সেই জ্যোতিষ সাহেব সমাধান করে দিতে পারতেন। তিনি ঠিক কিভাবে সেটি করতেন সেটা জানা হয়নি কোনোদিন, কিন্তু সারাজীবন এই “প্যানাসিয়া”‘র সন্ধান করে এসেছি। যে জিনিসটি সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে সেটিকে ইংরেজীতে প্যানাসিয়া বলা হয়। প্যানাসিয়া আসলে গ্রীক পুরাণের একজন দেবীর নাম। দেবী প্যানাসিয়া একধরণের তরল পদার্থ খাইয়ে মানুষের যাবতীয় অসুখ-বিসুখ ভালো করে দিতে পারতেন!

তো সেই প্যানাসিয়ার সন্ধান পাওয়া হয়ে উঠেনি এখনও। কিন্তু পুরো পৃথিবী এখনও ব্যস্ত আছে কিভাবে মানুষের জীবনে আরো সুখ আনা যায়, আরো সাফল্য আনা যায়, রোগ-বালাইকে কিভাবে আরো দূরে রাখা যায়, ব্যক্তি এবং জাতি হিসেবে কিভাবে আরো উন্নতি করা যায়, ইত্যাদি নিয়ে।

আমি সারাজীবন নিজেকে নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছি। নানা ধরণের “প্যানাসিয়া”‘ ট্রাই করেছি। নিজের জীবনের সব এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে যখন ভাবতে বসেছি তখন অনেকগুলো এক্সপেরিমেন্টকে মোটামুটি সফল মনে হয়েছে। সফল এক্সপেরিমেন্টগুলোর মধ্যে দু’টোকে আমার প্রায় প্যানাসিয়া’র কাছাকাছি পর্যায়ের বলে মনে হয়েছে। এই দু’টো জিনিস হচ্ছে – ১। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা, ২। ব্যায়াম। শুধুমাত্র এই দু’টো জিনিস অনুসরণ করে জীবনের অসংখ্য সমস্যার সমাধান করা যায়। আমি নিজে এটা করেছি – আপনিও ট্রাই করে দেখুননা!

মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা

মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার ব্যাপারটাকে পুরনো দিনের নীতিকথা মনে হতে পারে। কিন্তু এই পৃথিবীর প্রায় সাতশ কোটি মানুষের পুরো সভ্যতা টিকে আছে মূলত মানুষে মানুষে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার কারণে। একটু সময় নিয়ে নিজেকে নিয়ে একটু ভাবুন। মানুষকে কতোটুকু ভালোবাসেন আপনি? কতোটুকু শ্রদ্ধা করেন? আপনার স্বার্থ বা দরকারের উর্ধে উঠে মানুষকে ভালোবাসতে পারেন? আপনার ব্যক্তিগত চিন্তার সাথে বিপরীত বা সাংঘর্ষিক চিন্তার মানুষগুলোকে কতোটুকু শ্রদ্ধা করেন আপনি? কতোটুকু ভালোবাসেন?

আপনি রিকশায় করে যাওয়ার সময় একটা কার যদি বিপজ্জনকভাবে আপনার রিকশা’র পাশ দিয়ে চলে যায় বা রাস্তার গর্তে জমে থাকা পানি ছিটিয়ে দেয় আপনার গায়ে তখন কি আপনি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ওই গাড়ির মালিকের মুন্ডুপাত করেন? সে ধনী হয়েছে বলে কি তাকে অভিসম্পাত করেন? কিংবা আপনি গাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো রিকশার কারণে যদি আটকে যান বা রিকশার চাকা থেকে আপনার গাড়িতে আঁচড় লাগে তখন কি ছোটলোকের বাচ্চা বলে ওই রিকশাওয়ালাকে গালি দেন?

পৃথিবীতে প্রায় সাতশ কোটি মানুষ আছে। এবং মানুষ হচ্ছে প্রচন্ড সমাজবদ্ধ জীব। আমরা এতোটাই একসাথে থাকি যে একাকীত্মকে প্রায় একটা সমস্যা হিসেবে দেখি আমরা। তো যে সমাজ ছাড়া আমরা থাকতে পারিনা সেই সমাজের প্রধান উপাদানই হচ্ছে মানুষে মানুষে ভালোবাসা। ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বেশিদিন বাঁচতে পারেনা।

তাই বলে কি পৃথিবীতে ঘৃণার অস্তিত্ত্ব নাই? হিটলারকে ঘৃণা করা কি দোষের কিছু? স্বাধীনতার সময় আমাদের বাংলাদেশীদের হত্যাকারী, খুনী ধর্ষক পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের ঘৃণা করা অপরাধ?

না, ঘৃণা করা অপরাধ নয় কোনো। ঘৃণাও ভালোবাসার মতো একটা মানবীয় গুন। কিন্তু ভালোবাসা দেওয়া এবং নেওয়া দুটোতেই সুখ আছে, আনন্দ আছে। আর ঘৃণা করা এবং ঘৃণিত হওয়া দু’টোই কষ্টের ব্যাপার। শুধু শুধু কাউকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু শুধু শুধু ঘৃণা করা যায়না!

আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধা ব্যাপারটা শুধু মুরুব্বি কিংবা সামাজিক/রাষ্ট্রীয় উঁচু পদে থাকা মানুষকে দেখানো হয়। শ্রদ্ধা যখন এইভাবে একমুখী হয় তখন সেটা আসলে আর শ্রদ্ধা থাকেনা, সেটা আসলে ভয় হয়ে যায়। আপনার বস কিংবা কোনো মন্ত্রীকে আপনি যে শ্রদ্ধা দেখাচ্ছেন সেও যদি আপনাকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা না করে তাহলে এটা হচ্ছে একধরণের শাসক এবং শোষক সম্পর্ক, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্ক নয়। একইভাবে আপনি শুধু আপনার থেকে বয়সে বড় মানুষকে শ্রদ্ধা করেন কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চাদের যখন তখন ধমক মারেন তাহলে সেটাও সত্যিকারের শ্রদ্ধা নয়। ছোট ছেলেমেয়েরাও মানুষ এবং তারাও আমাদের শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য!

শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দেখানোর ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত মতামত বা স্বার্থ সামনে এসে দাঁড়ালে সেই শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় খাদ থেকে যাবে। আপনি কোনো রাজনৈতিক দলকে দেখতে পারেননা, তাই বলে সেই রাজনৈতিক দল এবং তার কর্মী-সমর্থকদের দিনরাত গালাগাল করবেন? হাসিনা-খালেদাকে দেখতে পারেননা অতএব তাদেরকে প্রতিদিন দশবার গালাগাল করবেন? বাংলা সিনেমার কোনো নায়ক-নায়িকাকে পছন্দ করেন না, তাই তদের নিয়ে যাচ্ছেতাই বলবেন? রাস্তায়, মার্কেটে, বা অফিসে মেয়েরা আপনার মনমতো জামাকাপড় পরবেনা তাই ওদেরকে কটুক্তি করবেন?

আপনার কি মনে হয় আপনার চারদিকে সবাই স্বার্থপর? সবাই শুধু নিজের ধান্ধায় ঘুরে? সবাই নির্বোধ? বিএনপি খারাপ, আওয়ামী লীগ খারাপ? আমেরিকা খারাপ, ভারত খারাপ, পাকিস্তান খারাপ? বুদ্ধিজীবিরা সব  দালাল? পত্রিকাগুলা সব কর্পোরেট ধান্দাবাজ? বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নাই, এই দেশকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, দেশটা চোর-বাটপারে ভরে গেছে? আপনার ফেইসবুকের প্রতিদিনের স্ট্যাটাসে শুধুই মানুষের দুর্বলতা, দেশের দুর্বলতাগুলো উঠে আসে? আপনার কি শুধু মনে হয় সবকিছু ভেঙ্গে পড়ছে, সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যাচ্ছে? চারদিকের এই স্বার্থপর, নষ্ট-ভ্রষ্ট মানুষগুলোকে ভালোবাসতে এবং শ্রদ্ধা করতে কষ্ট হয় আপনার?

যদি চারদিকের পৃথিবীকে এতো স্বার্থপর, ভঙ্গুর, দুর্বল, এবং খারাপ মনে হয় তাহলে একবার ভালো করে নিজের দিকে তাকান। নিজের কথা ভাবুন। আপনি নিজে কতোটা স্বার্থহীন, কতোটা শক্ত, কতোটা ভালো? ভঙ্গুর সিস্টেম এর জন্যে আপনি কী করেছেন? আপনি ছাত্র/ছাত্রী হলে কতোটুকু ভালো ছাত্র/ছাত্রী? আপনি চাকুরিজীবি হলে আপনার চাকুরিতে আপনি কতোটুকু দক্ষ? আপনি শিক্ষক হলে কতোটুকু ভালো শিক্ষক?

আমি দেখেছি যারা মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মানুষকে ভালোবাসে তারা সাধারণত ব্যক্তিজীবনে বেশি সুখী হয়। শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা খুবই সুখকর অনুভূতিদায়ক জিনিস, তাই কারো প্রতি যখন শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রদর্শন করবেন তখন সেটা আপনার মনে সুখানুভূতি দিয়ে ভরিয়ে তুলবে। চিন্তা করে দেখুন প্রতিদিন কতো মানুষের সংস্পর্শে আসি আমরা। এই মানুষগুলোর সবার প্রতি যদি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা দেখান তাহলে আপনার দিনটা কতো চমৎকার হবে ভেবে দেখেছেন?

ব্যায়াম

পৃথিবীতে যদি কোনো ওষুধ না থাকতো তাহলে শুধুমাত্র ব্যায়াম দিয়েই আমরা আমাদের অর্ধেকেরও বেশি অসুখ সারিয়ে ফেলতে পারতাম।

দশ হাজার বছর আগ পর্যন্তও মানুষ ছিলো শিকারী। মানুষের শরীর বসে থাকার মতো করে বিবর্তিত হয়নি। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা আমাদেরকে ঘর এবং অফিসবন্দী করে ফেলেছে। খাবার এর প্রয়োজনে আমাদের এখন আর বের হতে হয়না। আমাদের অফিসের দৈনন্দিন কাজ আমরা শরীর দিয়ে না করে ব্রেইন দিয়ে করি। ফলশ্রুতিতে আমাদের শরীরের অংগ-প্রতংগগুলি ঠিকভাবে বেড়ে উঠে না। নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম যেভাবে আপনাকে সাহায্য করেঃ

– ওজন নিয়ন্ত্রণঃ নিয়মিত ব্যায়াম করলে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে। খাবার থেকে শরীর যে ক্যালরি পায় সেটি ব্যবহার না করলে সেটা চর্বিতে রুপান্তরিত হয়ে যায় এবং শরীরকে মোটা করে ফেলে।
– অসুখ-বিসুখকে দূরে রাখাঃ ব্যায়াম করলে আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভালো থাকে, তাই ব্যাক্টেরিয়া-ভাইরাস সহজে আক্রমণ করতে পারেনা।  ব্যায়াম হার্ট এর পেশিগুলোকে শক্ত করে তোলে, দরকারী কোলেস্টরেল বাড়িয়ে দেয় আর ক্ষতিকারক কোলেস্টরেল কমিয়ে দেয়, শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে।
– মনকে চাঙ্গা করেঃ ব্যায়ামের সবচেয়ে গুরুত্মপূর্ণ অবদান সম্ভবত এটা মনকে চাঙ্গা করে তোলে। আমাদের ভালো মুড এর জন্যে যে নিউরোট্রান্সমিটারগুলো দায়ী, ব্যায়াম করার সময় সেই নিউরোট্রান্সমিটারগুলো ব্রেইনে নিঃসৃত হয় আমাদের মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে দেখবেন আপনার মন সবসময় ভালো থাকে, মানুষের প্রতি আপনার ভালোবাসা বেড়ে যাবে, বিশ্বাস বেড়ে যাবে!
– ব্যায়ামের ফলে আমাদের শরীর এবং মন শক্ত হয়ে উঠে। শরীরের মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়, আমাদের হার্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আমরা মনের শক্তি ব্যবহার করে শারীরিক দুর্বলতা-অক্ষমতাকে অতিক্রম করি।

ব্যায়াম আমাদের মানুষের সবচেয়ে মৌলিক অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের খেতে হয়। আর খেতে হলে আমাদের খাবার এর ব্যবস্থা করতে হয়, খাবার প্রস্তুত করতে হয়। আমাদের যতোই আলস্য লাগুক না কেনো খাবার সংগ্রহ এবং প্রস্তুত এর প্রক্রিয়ার নধ্য দিয়ে আমাদের যেতেই হয়। কিন্তু খাবার খেয়ে ফেলার পর আমাদের শরীর তার প্রয়োজনীয় জ্বালানি পায় এবং কর্মক্ষম হয় উঠে। ব্যায়ামের ব্যাপারটিও ঠিক তেমনি। আমাদের শরীরকে (এবং মনকে) সুস্থ রাখতে ব্যামের দরকার। ব্যায়াম করতে হয়তো আলস্য লাগতে পারে, কিন্তু একবার ব্যায়াম করে ফেলার পর আমাদের শরীর মন চাঙ্গা হয়ে উঠে!

আমি জানি ব্যায়াম যতোই ভালো জিনিস হোকনা কেন আলস্যের কারণে আমাদের বেশিরভাগেরই ব্যায়াম করা হয়ে উঠেনা। কিভাবে আলস্যকে কাটিয়ে ব্যায়াম এর অভ্যাস করা যায় সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে একটা পোস্ট দিবো কিন্তু আপাতত শুধু দু’টো পরামর্শ দিয়ে রাখিঃ

১। যেকোনো জিনিস শুরু করাটা হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন। প্যারাশুট নিয়ে প্লেইন থেকে ঝাঁপ দেওয়ার মতো, ঝাঁপ দিয়ে দিলে আর কোনো সমস্যা নাই কিন্তু ঝাঁপ দেওয়াতেই যতো ভয় এবং অনীহা। তায় ব্যায়াম করার সিদ্ধান্ত নিলে জাস্ট শুরু করে দিন। ভালো না লাগলেও শুরু করুণ। কষ্ট লাগলেও শুরু করুণ। মনে করুণ এটা একটা ওষুধ – তেতো কিন্তু আপনার কোনো ভয়ংকর অসুখ ভালো করে দিবে। কয়েক সপ্তাহ কষ্ট করে করতে থাকলে দেখবেন পরের দিকে আর তেমন সমস্যা হচ্ছে না অভ্যাসটা ধরে রাখতে।

২। অল্প অল্প করে শুরু করুণ। এই টেকনিকটার নাম হচ্ছে কাইজেন। ব্যায়াম করতে ভালো না লাগলে প্রথমদিন শুধু ২ মিনিট ব্যায়াম করুণ। হ্যাঁ, জাস্ট ২ মিনিট। এরপর প্রতিদিন ১ মিনিট করে বাড়ান। এক মাসের মাথায় দেখবেন আপনি আধ ঘন্টা করে ব্যায়াম করছেন প্রতিবারে!

ব্যায়ামের উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবেনা। আশা করি শুধু ব্যায়াম নিয়ে ভবিষ্যতে একটা লেখা লিখবো।

ব্যায়াম আমার নিজের জীবনকে অনেক বদলে দিয়েছে, আমি নিশ্চিত আপনার জীবনকেও বদলে দিতে পারে ব্যায়াম।

ব্যায়াম নিয়ে দু’টো সাইট যেগুলো আমি নিয়মিত অনুসরণ করিঃ নার্ড ফিটনেস, ব্লগ অফ ইম্পসিবল থিংস। ব্লগগুলি নিয়মিত পড়ুন, দেখবেন ব্যায়াম নিয়ে, নিজের শরীর এবং মন নিয়ে আপনার অনেক চিন্তাভাবনা বদলে যাবে!

জীবনে সুখী হতে হলে, সফল হতে হলে আসলে আরো অনেক কিছু দরকার, কিন্তু একটা চমৎকার মন এবং চমৎকার শরীর না থাকলে সুখ আর সাফল্য কখনোই আসবেনা। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা আপনাকে একটা চমৎকার মন দিবে আর নিয়মিত ব্যায়াম দিবে একটা চমৎকার শরীর।

আমাদের ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে দাও

Ivy_League_Logo-Large
১। বিশ্বজিত

চব্বিশ বছর বয়সী বিশ্বজিতকে ছাত্রলীগের ছেলেরা রড-চাপাতি-ছুরি দিয়ে কুপিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে।  চব্বিশ বছর বয়সে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। চব্বিশ বছর বয়সে আমার মনে ছিলো পাহাড় সমান স্বপ্ন। বিশ্বজিত আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি। দারিদ্র্যের কারণে ক্লাস নাইনের পর পড়ালেখায় ক্ষান্ত দিয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত বিশ্বজিতেরও আমার মতো পাহাড় সমান স্বপ্ন ছিলো। ওই বয়সে কার না স্বপ্ন থাকে? অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন, চমৎকার একটা মেয়ের সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন, নিজের পরিবারের জন্যে কিছু করার স্বপ্ন, সম্ভব হলে দেশের জন্যে কিছু করার স্বপ্ন – সব মিলিয়ে একটা অর্থপূর্ণ জীবন যাপনের স্বপ্ন।

২। আমন্ত্রণ টেইলার্স

বিশ্বজিত ছয় বছর ধরে দর্জির দোকান “আমন্ত্রণ টেইলার্স” গড়ে তুলেছিলেন। বিশ্বজিতদের তো দর্জি বা এরকম কিছুই হতে হয়। বিশ্বজিত যদি দর্জি না হতো তাহলে হয়তো রিকশা চালাতো। কিংবা হতে হতো বাসের নিরীহ যাত্রী। কিংবা কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে আসা কোনো এক সাধারণ তরুণ। বিশ্বজিতের বাবা তো আর কোটিপতি রাজনীতিবিদ নয়। কোটিপতি আমলা কিংবা সামরিক অফিসারও নয়। কিংবা নয় ধনী ব্যবসায়ী। এমন না যে কোটিপতি হওয়াটা কোনো অপরাধ। কিন্তু বিশ্বজিতের বাবা কোটিপতি হতে পারবেনা। কোটিপতির ছেলে দর্জি হয়না। কোটিপতির ছেলে রিকশাওয়ালা হয়না। কোটিপতির ছেলে অবরোধের মধ্য দিয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক এর সামনে দিয়ে হেঁটে শাঁখারীবাজার এর দর্জি দোকানে একজন কাস্টমার ধরার জন্যে সকাল নয়টার সময় ঘর থেকে বের হয়না। কোটিপতির ছেলে আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। কিংবা পড়ালেখা শেষ করে আমেরিকাতেই বড় অংকের চাকরি করে। এমন না যে আমেরিকায় থাকা কোনো অপরাধ। কিন্তু বিশ্বজিতরা আমেরিকায় থাকেনা। বিশ্বজিতদের থাকতে হয় লক্ষ্মীবাজারের ঋষিকেশ দাস রোডে।

বিশ্বজিতরা বারিধারায় থাকেনা, বনানীতে থাকেনা, ধানমন্ডিতেও নয়। বিশ্বজিতরা থাকে টঙ্গিতে কিংবা যাত্রাবাড়ি পার হয়ে ঢাকার কোনো এক কোণে। বিশ্বজিতরা মুড়ির টিন মার্কা বাস এর হ্যান্ডলে ঝুলে ঝুলে কাজ করতে যায়। হরতাল অবরোধের সময় বিশ্বজিতদের বাসে আগুন লাগানো একটা ফরজ কাজ। যাদের দিয়ে আগুন লাগানো হয় তাদের নামও হয় বিশ্বজিত। কিংবা নাহিদ। অথবা শাকিল।

৩। বারিধারা, বোস্টন, বা ভার্জিনিয়া

বারিধারা বা ডিওএইচএস বা বনানীতে বিশ্বজিতরা থাকেনা। বিশ্বজিতের খুনী নাহিদ, শাকিলরাও থাকেনা সেখানে। কিন্তু তাদেরকে যারা খুন করে কিংবা খুনীতে পরিণত করে তারা সেখানে থাকে। আর তাদের সন্তানরা থাকে বোস্টনে, কিংবা ভার্জিনিয়ায়। কিংবা লন্ডনে। কেউ কি কখনো আমাদের রাজনীতিবিদদের, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের, ব্যবসায়ীদের, বুদ্ধিজীবিদের,  কিংবা তাদের সন্তানদের দর্জি হতে দেখেছে? কেউ কি তাদের সন্তানদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেখেছে? তাদের সন্তানদের হাতে কোনোদিন চাপাতি, রড, ছুরি, রামদা দেখেছে কেউ? কেউ কি দেখেছে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কোনো সন্তানকে তারই বয়সী কয়েকজন ছাত্র ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলছে? ভার্জিনিয়া-নিউ ইয়র্ক-বোস্টন এর আই-৯৫ হাইওয়েতে হাই স্পিডে চলতে থাকা এসইউভির ভেতরে হাই ভলিউমে যখন এই কর্তাব্যক্তিদের সন্তানরা গান শুনছে ঠিক সেই সময় তাদেরই সমবয়সী নাহিদ, শাকিলরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারছে বিশ্বজিতদের। বিশ্বজিতের শরীর থেকে ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়া রক্তের সাথে আমেরিকার দশ লেইনের রাস্তায় ড্রাইভ করতে থাকা কিংবা নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কোনো ফার্মে কাজ করা সন্তানদের রক্তের পার্থক্য কতোটুকু?

৪। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি

দেশের কর্তাব্যক্তি যারা – রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবি – তাদের যাদের সন্তানরা বিদেশে পড়ালেখা করছে বা করেছে তারা দয়া করে একটু নিজের সন্তানদের জিজ্ঞেস করে দেখুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঠিক কী করা হয়। ব্যাপারটা হয়তো আপনাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, কিন্তু এটাই সত্যিঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করা হয়! সারপ্রাইজ! একটা ছেলে বা মেয়ে আঠারো/উনিশ বছর বয়সে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তার পছন্দের বিষয় বা বিষয়গুলোতে শিক্ষা লাভ করে, গবেষণা করে। পাশাপাশি সে খেলাধুলা করে, গান-কবিতা-অভিনয় ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কাজে জড়িত হয়, সুযোগ পেলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কোথাও কাজ করে, কেউ বা ক্লাব-সঙ্গগঠন করে নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করে। কোনো সভ্য দেশের সভ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাড়াটে মাস্তান হয়ে বিশ-একুশ বছরের ছেলেমেয়েরা রামদা-চাপাতি হাতে খুনাখুনি করেনা!

ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতি নিয়ে কথা উঠলেই অবধারিতভাবে কয়েকটা জিনিস বলা হবেই! প্রথমটি হচ্ছেঃ ছাত্ররাজনীতি না থাকলে আমরা বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বই এর মতো অধিকার আদায় এর আন্দোলন কিভাবে করবো? এর মানে কি পৃথিবীর যাবতীয় অধিকার আদায় এর উত্তর হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি? পৃথিবীর গতো কয়েক হাজারের ইতিহাসে সব অধিকার আদায় হয়েছে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে? আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেখানেই যতো সমস্যা হয়েছে সব অনাচার অবিচার বন্ধ করা হয়েছে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে?  হাই স্কুল, প্রাইমারী স্কুলেও কি আমরা রাজনীতি চালু করে দিবো যাতে ওরাও আমাদের অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন করতে পারে? আমি বাংলাদেশের দুইটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি, এর প্রায় কোনো সময়ই কোনো ছাত্র সঙ্গঠনকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন করতে দেখিনি। সব সময় সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন করেছে। এই আন্দোলন এর জন্যে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কোনো রাজনৈতিক অং সঙ্গগঠন এর সদস্য হতে হয়নি। উলটা ছাত্রলীগ/ছাত্রদল/ছাত্র শিবির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উপর  নির্মমভাবে অত্যাচার করেছে। নব্বই এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এর পর বাইশ বছর পার হয়েছে। এই বাইশ বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে মাস্তানি-গুন্ডামি করা ছাড়া ছাত্র সংগঠনগুলো আর কোনো ভালো করেছে? এমনকি ২০০৬-২০০৮ সালের মিলিটারি-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই করেছে!

দ্বিতীয় আরেকটি কথা বলা হয় ছাত্ররাজনীতি না থাকলে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হবে কিভাবে? আমরা কি সত্যিই বিশ্বাস করি ছাত্রলীগের শাকিল, নাহিদ এর মতো খুনী ছেলেরা আমাদের দেশের ভবিষ্যত নেতা হবে? যে দেশের অনেক বর্ষীয়ান নেতাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আমাদের মনে শঙ্কা জাগায় সেই দেশের পড়ালেখা না করা, সন্ত্রাস করে দিন পার করে দেওয়া ছেলেমেয়েরা আমাদের ভবিষ্যত নেতা হবে? এরচেয়ে ভালো করে লেখাপড়া করা, সত্যিকারের স্মার্ট, ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়েরাই কি ভালো নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা?

আর কারো যদি রাজনীতি করার ইচ্ছা থাকে তাহলে সে ক্যাম্পাসের বাইরে যেয়ে মূল দলের সাথে রাজনীতি করুক। রাজনীতি করা একটা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর যদি রাজনীতি না করলে ভালো লাগেনা, সে তো যে কোনো সময় যেয়ে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারে। কিন্তু সেটা করবে ক্যাম্পাসের বাইরে যেয়ে, মূল দলের সাথে। কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় শুধুই পড়ালেখা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কাজকর্ম, আর স্বপ্ন দেখার জায়গা!

৫। আমাদের ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে দাও

আজ থেকে প্রায় পনের বছরেরও বেশি সময় আগে শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যার তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতিবিদ নামক সন্ত্রাসীদের তান্ডব দেখে “আমাদের ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে দাও” শিরোনামে একটি হৃদয়-স্পর্শী লেখা লিখেছিলেন। স্যার তখন সবে দীর্ঘ আঠারো বছরের প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে ফিরেছেন, বিশ-একুশ বছরের ছেলেমেয়েদের তিনি দেখে এসেছেন ক্যাম্পাসে এসে পড়ালেখা করছে, গবেষণা করছে, সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠান করছে, খেলাধুলা করছে। রামদা-চাপাতি-কাটা রাইফেল হাতে একে অপরকে নির্দয়ভাবে আক্রমণ করার ব্যাপারটি তখনও তাঁর কাছে নতুন ছিলো। যে বয়সে এই ছেলেগুলোর জীবনকে পূর্ণ উদ্দ্যমে উপভোগ করার কথা, নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করার কথা, ভবিষ্যত রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা, দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে নতুন নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে দিনভর যুক্তি-তর্ক-আলোচনা করার কথা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করার কথা, খেলাধূলা করে অলিম্পিকের সোনা জেতার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা – সেই স্বর্ণ সময়ে এই ছেলেগুলো চাপাতি-রড-রাইফেল নিয়ে তাদেরই সমবয়সী আরেক দল ছেলেকে পশুর মতো পিটিয়ে মারছে – এই হাহাকার করা কথাগুলোই উঠে এসেছিলো জাফর স্যারের সেই লেখায়। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা জানি, জাফর স্যারের এই হাহাকার আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিদের একবিন্দু স্পর্শ করেনি।

বিশ্ববিদ্যালয় আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে স্বপ্ন দেখার এবং সে স্বপ্ন পূরণের জন্যে কাজ করার জায়গা। আমেরিকায় আসার পর আমি আমেরিকার অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়েছি। যখনি কোনো নতুন জায়গায় গিয়েছি, আমি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঘুরে বেড়িয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লনের সবুজ ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে আমি সদ্য কৈশোর পার হওয়া ছেলেমেয়েদের উচ্ছাস আর উল্লাস দেখি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদ-সামরিক বেসামরিক আমলা-ব্যবসায়ী-বুদ্ধিজীবির সন্তানরা পড়ালেখা করে। মনে মনে ভাবি আচ্ছা বিশ্বজিত যদি এখানে পড়তে পারতো? বিশ্বজিত এখানে পড়লে সেদিন বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে দিয়ে না যেয়ে হেঁটে যেতো ভার্জিনিয়ার কোনো সাজানো পার্কে, কিংবা ডিনার করতো বোস্টনের কোনো চমৎকার রেস্টুরেন্টে, কিংবা দেখতে যেতো সান ফ্রান্সিস্কো গোল্ডেন গেইট ব্রিজ!

খুনী ছাত্রনেতা শাকিল আর নাহিদ – আহা, ওরা যদি পড়তে আসতো কোনো আইভি লিগ ইউনিভার্সিটিতে? চাপাতির বদলে শাকিল হয়তো নতুন কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতো, নাহিদ হয়তো স্ট্রিং থিওরির উপর কাজ করতো। হয়তো ওদের থাকতো একজন ভালোবাসার মানুষ, চমৎকার এক প্রেমিকা যাকে দেখে ওরা মানুষকে, জীবনকে ভালোবাসতে শিখতো!

আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা – রাজনীতিবিদ, সামরিক বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবিগণ – এদের প্রায় কারোর সন্তানই বিশ্বজিত, শাকিল, কিংবা, নাহিদের মতো অবস্থায় নাই। এর মানে তাঁরা ভালো করেই বুঝেন বিশ্বজিত, শাকিল, এবং নাহিদরা যেভাবে জীবন চালিয়েছে/চালাচ্ছে সেটা একটা অর্থবহ জীবন হতে পারেনা! তবে কেনো নিজের সন্তানদের নিরাপদে রেখে অন্যের সন্তানদের দিয়ে রাজনীতির নামে খুনাখুনি করানো হয়?

আমরা কি আমাদের সন্তানদের জন্যে রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পেতে পারিনা? ফিরে পেতে পারিনা আমাদের ছেলেমেয়েদের?

সবচেয়ে বড় যে ভয় – এবং যেভাবে আমি এটাকে জয় করলাম

আমার উচ্চতাভীতি (Acrophobia) আছে। উঁচু দালানের ছাদের কিনারায় দাঁড়ালে পায়ের তলায় শিরশির করে, প্লেইন যখন টেইক অফ করে মাটি ছেড়ে উঠে যেতে থাকে তখন বুকের মধ্যে ধক করে উঠে। এরপরও যখনি কাউকে আকাশে স্কাই ডাইভিং করতে দেখি তখন প্রচন্ড ইচ্ছে হয় স্কাই ডাইভিং করার। এই ভিডিও দেখার পর কার আকাশে উড়তে ইচ্ছে না করবে?

কিন্তু প্রাণের মায়া সম্ভবত সবচেয়ে বড় মায়া, মৃত্যুভয় সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভয়! একটা চমৎকার উড়ন্ত প্লেইন থেকে কোন দুঃখে আমি শুন্যে ঝাঁপ দিতে যাবো?

কিন্তু একমাত্র মানুষই সম্ভবত আপাতদৃষ্টিতে দেখতে সবচেয়ে অযৌক্তিক কাজটি অবলীলায় করতে পারে। তাই গতো রোববার একটা চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আমি আর আমার দুই বন্ধু মিলে যখন স্কাই ডাইভিং করতে রওয়ানা দিলাম তাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিলোনা!

নিউ ইয়র্কে এখন গ্রীষ্মকাল প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আর মাস খানেক এর মধ্যে শরৎ/হেমন্ত চলে আসবে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন ছিলো চমৎকার একটা দিন। বাইরের তাপমাত্রা ছিলো ৭৫-৮০ ফারেনহাইটের মধ্যে। রৌদ্রজ্জ্বল দিন, আকাশে হালকা ছেঁড়া মেঘের ভেলা। আমার বন্ধুদের তাদের এপার্টমেন্ট থেকে গাড়ীতে তুলে নিলাম ঠিক ১১:৩০ এ। আমাদের গন্তব্য ক্যালভারটন নামক একটা শহর। ক্যালভারটন নিউ ইয়র্ক শহর থেকে ঘন্টা দেড়েকের ড্রাইভ। শহর ছেড়ে হাইওয়েতে উঠতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। ব্যাপারটা আমি আগেও খেয়াল করেছি, যখনি আমি কোনো বড় শহর ছেড়ে বের হয়ে যাই আমার খালি বুক ভরে নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। চারদিকের খোলা মাঠ, চনমনে বাতাস, মনের সাথে সাথে শরীরটাও কেমন যেন ফ্রেশ হয়ে যায়!

আমেরিকার হাইওয়েতে একবার এক্সিট ভুল করলে শাস্তি হিসেবে অনেক পথ ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। আমার প্ল্যান ছিলো নর্দার্ন স্টেইট পার্কওয়ে ধরে অনেক দূর ড্রাইভ করে এরপর লং আইল্যান্ড এক্সপ্রেসওয়ে ধরে গন্তব্যে পৌঁছাবো। কিন্তু একটা এক্সিট মিস করার কারণে অনেক ঘুরাঘুরি করে যেয়ে উঠলাম সাউদার্ন স্টেইট পার্কওয়েতে। সাউদার্ন স্টেইট পার্কওয়ে ধরে অনেক দূর যাওয়ার পর লং আইল্যান্ড এক্সপ্রেসওয়ে তে উঠে যাই। এরপর মিনিট পনের বিভিন্ন লোকাল হাইওয়ে ধরে আমরা আমাদের গন্তব্য ক্যালভারটন শহরের এক কোণায় অবস্থিত ড্রপ জোনে (স্কাই ডাইভিং করার স্থানটিকে ড্রপ জোন বলা হয়) পৌঁছে যাই।

ড্রপ জোন যায়গাটা আসলে একটা এয়ারপোর্টকে ঘিরে স্কাই ডাইভিং এর আয়োজন ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা গাড়ী পার্ক করে অফিস বিল্ডিংয়ে ঢুকলাম চেকইন করার জন্যে। কাউন্টারের মেয়েটি দ্রুত চেকইন শেষ করে আমাদের একটা টিভির সামনে বসিয়ে দিলো। টিভিতে মিনিট পাঁচেক এর একটা ভিডিও দেখতে হবে যেটা আমাদের আজকের স্কাই ডাইভিং এর ট্রেইনিং। ভিডিওতে আমাদের ডাইভিং এর সময় কিভাবে হাত-পা ভাঁজ করে থাকতে হবে, জাম্প করার সময় কিভাবে গায়ে লাগানো জাম্প হারনেস এর স্ট্র্যাপ ধরে উপরের দিকে চেয়ে থাকতে হবে, ল্যান্ড করার সময় ইন্সট্রাকর এর কথা অনুযায়ী স্ট্যান্ড বা স্লাইড করতে হবে কিভাবে ইত্যাদি সবকিছু ডেমন্সট্রেইট করা হলো।

ভিডিও দেখা শেষে আমাদের “কোনো ধরণের দূর্ঘটনার জন্যে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়” টাইপের কাগজপত্র সই করতে হলো। এমনকি মৃত্যু হতে পারে, বা চিকিৎসা খরচ ইত্যাদি কিছুই দাবী করবো না বলে সই করতে হলো।

অবশেষে আমাদেরকে বলা হলো বাইরে যেয়ে অপেক্ষা করার জন্যে। যথাসময়ে আমাদের নাম ধরে ডাকা হবে বলে বলা হলো।

বাইরে অপেক্ষা করার যায়গাটায় এসে তো আমাদের আক্কেলগুড়ুম। একটু পরপর আমাদের সামনে এসে টুপ টুপ করে প্যারাশুট নিয়ে পড়ছে স্কাই ডাইভাররা। বিশেষ করে যারা অভিজ্ঞ স্কাই ডাইভার তার যেভাবে বিপজ্জনকভাবে প্রচন্ড গতিতে এসে ধুপ করে ল্যান্ড করছিলো তা দেখে আমার শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেলো! অবশ্য আমরা যেটা করছি সেটা হলো ট্যান্ডেম স্কাই ডাইভিং। আমি বা আমার বন্ধুরা কেউই একা জাম্প করবোনা। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের ইন্সট্রাকটরের গায়ের সাথে শক্ত করে বাঁধা থাকবো। আমাদের পুরো জাম্পের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ইন্সট্রাকটরের হাতে, আমাদের কাজ হলো শুধু জাম্প দেওয়া এবং আকাশে উড়ে বেড়ানো উপভোগ করা!

আমরা জানতাম স্কাই ডাইভিং এর জাম্পের জন্যে ডাক পেতে বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হয়। তাই আমাদেরকে যখন প্রায় দুই ঘন্টা পর ডাকলো আমরা খুব একটা অবাক হলাম না।

মাইকে আমাদের নাম শোনার পর আমরা জাম্প গিয়ার এর জায়গাটার দিকে এগিয়ে যাই। জাম্প গিয়ার মানে নানা রকম বেল্টে ঠাসা একটা জিনিস যেটা দিয়ে আমি আমার ইন্সট্রাকট্রের গায়ের সাথে আঠার মতো লেগে থাকবো। একজন আমাদের সবাইকে গিয়ার পরিয়ে দিলো। আমার ইন্সট্রাকটর উইনি এসে আমাকে একটা গগল (এক ধরণের চশমা) দিয়ে গেলো যেটা জাম্পের সময় আমাকে পরে থাকতে হবে প্রচন্ড বাতাস থেকে চোখকে বাঁচানোর জন্যে। এরপর আমার ভিডিও এবং ফটোগ্রাফার কেইট এসে আমার সাথে পরিচিত হলো। ও আমার ছবি এবং ভিডিওর দায়িত্বে থাকবে আকাশে। একজন মানুষের প্রতিদিনের কাজ ১৩,৫০০ ফুট উপরের আকাশে ব্যাপারটা ভাবতেই আমার গায়ে চমক খেলে যায়!

এরপর আমরা একে আমাদের প্লেইনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ছোট, পুরনো, জীর্ণ-শীর্ণ একটা প্লেইন। আমার বন্ধু কৌতুক করে বললো – “এই ভাঙ্গা প্লেইন থেকে বাঁচার জন্যে হলেও আমাদের আকাশ থেকে ঝাঁপ দিতে হবে”! প্লেইন আস্তে আস্তে চলা শুরু করলো। ছোট একটা প্লেইন। যাত্রী সব মিলিয়ে জনা দশেক হবে। এর মধ্যে প্লেইনের একমাত্র দরজাটা হাট হয়ে খুলে আছে। জীবনে কোনোদিন প্লেইনের দরজা খোলা থাকতে দেখি নাই! আমি মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি – “একটু পর যখন আকাশে থাকবো তখন তো কোনো দরজাই থাকবেনা, সুতরাং দরজা খোলা কি বন্ধ সেটা কোনো ব্যাপার না”!

কিছুক্ষণ পর প্লেইনটা মাটি ছেড়ে আকাশে উঠা শুরু করলো। প্রায় ৪৫ ডিগ্রী কোণে প্লেইনটা উঠতে উঠতে যখন নিচের সবকিছু ছোট বিন্দুতে পরিণত হলো আমি আর আমার বন্ধু শাহেদ প্রায় একসাথে একে অপরের দিকে তাকালাম। দুইজনই প্রথমবারের মতো উচ্চতা দেখে একটু ভয় পেলাম। আর কিছুক্ষণ পর এখান থেকে শুন্যে লাফিয়ে পড়বো ভাবতেই একটা হিমশীতল স্রোত রক্তের সাথে বেয়ে গেলো। আমার ক্যামেরাম্যান কেইট আমার একটা ছবি তুললো, আমি নার্ভাস ভঙ্গিতে হেসে পোজ দিলাম।

প্লেইন ১৩,৫০০ ফুট (প্রায় আড়াই মাইল/সাড়ে চার কিলোমিটার) উপরে এসে স্থিত হলো। আমি লাইনে দ্বিতীয় জাম্পার। আমার আগে সারা গায়ে টাট্টু লাগানো টিংটিঙ্গে একটা আমেরিকান ছেলে লাফ দিলো। মুহুর্তের মধ্যেই সে এবং তার ইন্সট্রাকটর শুন্যে হাওয়া হয়ে গেলো। এরপর আমার পালা। কেইট আগে বের হয়ে দরজার বাইরে যেয়ে একটা হাতল ধরে দাঁড়ালো। সে ওখান থেকে আমার লাফ দেওয়ার মুহুর্ত ক্যামেরায় ধরবে। এরপর আমার ইন্সট্রাকটর এর ঈশারার সাথে সাথেই কেইট লাফ দিবে এবং সাথে সাথে আমরাও।

আমার ইন্সট্রাক্টর প্লেইনেই আমাকে তার শরীর এর সাথে খুব শক্ত করে বেঁধে নিয়েছে। সে আমাকে ঠেলে ঠেলে প্লেইনের দরজার সামনে নিয়ে আসলো। আমার প্রায় পুরো শরীর প্লেইনের বাইরে, আমার হাত আমার বুকে জাম্প হারনেস এর সাথে ধরে রাখা। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার ইন্সট্রাক্টর উইনি আমাকে সহ শুন্যে ঝাঁপ দিলো। কয়েক মুহুর্তের জন্যে আমার মনে হলো এটা কী হলো? আমি দুস্বপ্ন দেখার মতো পড়েই যাচ্ছি নিচে… কিন্তু পুরো ব্যাপারটা মাত্র তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ড স্থায়ী হলো। ততক্ষণে উইনি ছোট একটা প্যারাশুট (যাকে drogue বলে) ছেড়ে দিলো। এই ছোট প্যারাশুট এর কাজ হলো পৃথিবীর অভিকর্ষনজনিত ত্বরণকে বাধা দিয়ে আমাদের মোটামুটি ঘন্টায় ১২০ মাইল বেগের মধ্যে সীমিত রাখা। প্রাথমিক জাম্পের রেশ কাটতে না কাটতেই উইনি আমার হাত ধরে সামনে তাকাতে ইশারা দিলো। আমি সামনে তাকিয়ে দেখি কেইট এসে আমাদের সামনে আমাদের সমান তালে শুন্যে ভাসছে!

কেইটকে আমাদের পাশে শুন্যে ভেসে থাকতে দেখে মজা লাগলো। সে ঠিক আমাদের দশ ফুট নিচে থেকে আমাদের দিকে চেয়ে শুয়ে ছিলো। তার হাতে ক্যামেরা ছিলো, তাই সে আমার শুন্যে ভেসে থাকা শুট করার জন্যে আমাদের নিচে এসে বাতাসের কোলে শুয়ে ছিলো সারাক্ষণ!

স্কাই ডাইভিং না করার আগ পর্যন্ত যেটা মনে হতো – প্লেইন থেকে লাফিয়ে পড়ার পর প্রচন্ড গতিতে পড়ে যেতে থাকবো – আসলে ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম নয়। ছোট প্যারাশুট খোলার পর আমাদের গতি ছিলো ঘন্টায় ১২০ মাইল। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো একটা গাড়ীতে করে ১২০ মাইল বেগে চলতে থাকলে বাতাস এসে চোখে মুখে পড়লে যা হয়। প্রচন্ড বাতাস এসে আমার মুখে পড়ছিলো। নিশ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিলো। মুখ, ঠোঁটও শুকিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আকাশে ভেসে থাকার আনন্দ এবং উত্তেজনার কাছে সেটা আসলে কিছু ছিলোনা!

ঠিক এই সময় হঠাৎ করে প্রচন্ড ঝাঁকি খেলাম। কিছুক্ষণের জন্যে একটু হতচকিত হয়ে গেলাম। পরে বুঝলাম আমরা ভূমি ৫,০০০ ফুট উপরে এসে গিয়েছি, তাই উইনি আমাদের মূল প্যারাশুট খুলে দিয়েছে। হঠাৎ করে গতি একেবারে কমে গেলো। আমি প্রথমবারের মতো ভালো করে চার দিকে তাকানোর সুযোগ পেলাম। নিচের সবকিছু ক্ষুদ্র খেলনার মতো লাগছিলো। দূরে লং আইল্যান্ড এর সমুদ্র তীর দেখা যাচ্ছিলো।

সঠিক যায়গায় ল্যান্ডিং এর জন্যে উইনি প্যারাশুটকে বেশ কয়েকবার ডানে বামে টেনে আমাদের গতিপথ পরিবর্তন করছিলো। এসময় দুএকবার প্রচন্ড ভয় লেগে গিয়েছিলো। ওই অনুভূতিটা ছিলো সত্যিকারের ত্বরণ জনিত টান (free fall) যেটা এমনকি প্যারাশুট খোলার আগেও ছিলোনা।

জাম্প করার প্রায় পাঁচ ছয় মিনিট পর উইনি খুব দক্ষভাবে এসে প্যারাশুটটাকে ল্যান্ড করালো। মাটিতে পা রেখে আমার মনে হলো – “অবশেষে আমি এটা করেছি”! কতোদিন ধরে স্কাই ডাইভিং করতে ছেয়েছিলাম, কিন্তু মূলত ভয়ের কারণেই এতোদিন করা হয়নি। কিন্তু আমার মনে হলো শুধুমাত্র এই ফালতু ভয়ের কারণে এতো উত্তেজনা এবং আনন্দময় একটা জিনিস থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবো এর কোনো মানে হয় না। অবশেষে আমার ইচ্ছে শক্তির কাছে আমার ভয় পরাজিত হয়েছে আর এমি এমন চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করলামঃ)

ভারতের বিএসএফ এর অমানবিকতা এবং আমাদের আত্মমর্যাদাহীনতা

ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের একজন যুবককে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করেছে। এবং এই নির্যাতনের ভিডিওটি ভারতের এবং বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রকাশ হয়েছে। আমি কোনোভাবেই ভিডিওটি পুরো দেখতে পারিনি। একটা মানুষকে হাত-পা বেঁধে একদল অস্ত্রধারী মানুষ এভাবে পেটাচ্ছে – এই দৃশ্য আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। ছোটবেলায় সাপকে মারার জন্যে দেখতাম আমাদের গ্রামের মানুষগুলো লাঠিসোঁটা নিয়ে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তো। বেচারা সাপ কিছুক্ষণ তেড়েবেড়ে একটু পড় একটা প্রাণহীন নিথর দেহে পরিণত হতো। বাংলাদেশী যুবকটির ভাগ্য ভালো, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে প্রাণহীন নিথর দেহে পরিণত করেনি।

মানুষের জীবনের প্রতি কতোটুকু ঘৃণা থাকলে কেউ কাউকে এভাবে পেটাতে পারে। বিএসএফ এর সেই জওয়ানগুলো নিশ্চয়ই তাদের নিজের দেশ ভারতের কোনো মানুষকে ধরে এভাবে পেটাতো না। কিংবা তারা কি কখনো পশ্চিমা কোনো দেশের সাদা চামড়ার কোনো মানুষকে এভাবে পেটাতো কোনোদিন? কোনো চীনা নাগরিককে? এমনকি ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানী কোনো যুবককে? যতো বড়ই অপরাধ করুক না কেনো সে যুবক?

বিএসএফ যেভাবে বাংলাদেশী মানুষজনদের ধরে মেরে ফেলে, কিংবা পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় বাংলাদেশীদের তারা প্রায় মানুষই মনে করেনা। রাস্তার অপরিচিত কুকুরটিকে গুলি করে মেরে ফেলা যায়, জঙ্গলে সামনে পড়া সাপটিকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা যায়, একদল পিঁপড়াকে দলিত মথিত করে মেরে ফেলা যায় নিমিষে। ভারতের বিএসএফ ঠিক সেই ব্যবহারটিই করে আমাদের সাথে।

কিন্তু কেনো বিএসএফ এমন করে আমাদের সাথে?

আমরা দেশে বসে যতোই মনে করিনা কেনো বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটা গুরুত্মপূর্ণ দেশ, কথাটা কিন্তু খুব একটা সত্যি না। বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা গুরুত্মপূর্ণ অবস্থানে তো নয়ই, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের আসলে তেমন কোনো গুরুত্মই নাই। বাংলাদেশের কোনো খবর বাইরে খুব বেশি গুরুত্ম সহকারে প্রকাশ পায়না, এবং বাংলাদেশকে মোটের উপর একটা অশিক্ষিত, পশ্চাদপদ, এবং দরিদ্র জাতি হিসেবেই বিবেচনা করা হয় বাইরের পৃথিবীতে।

আমরা ভেবে ভেবে সুখ পেতে পারি যে আমেরিকা, ভারত, ইজরায়েল, এবং বাকী পৃথিবী আমাদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করে বসে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাইরের পৃথিবীতে আমাদের নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই খুব একটা। প্রতিবেশি হিসেবে ভারতের কিছুটা মাথাব্যথা থাকতে পারে, কিন্তু সেই পর্যন্তুই। আমাদেরকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা নিয়ে ভারত বসে থাকলে তাদের বছর বছর জিডিপির হার ৭%-৯% হতো না। তারা নিজেদের স্যাটেলাইট, জঙ্গিবিমান, সুপার কম্পিউটার বানাতে পারতো না।

আর আমেরিকার কাছে বাংলাদেশ এতোই তুচ্ছ একটা দেশ যে আমাদেরকে নিয়ে কোনো সময় ব্যয় করাও আমেরিকার জন্যে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার ধারণা বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার একমাত্র মাথাব্যথা হচ্ছে আমরা যেনো আত্মঘাতী জঙ্গি তৈরি করার একটা ঘাঁটি না হয়ে উঠি, যারা একদিন একটা বিমান নিয়ে যেয়ে আমেরিকার মাটিতে বিল্ডিং ধ্বংস করতে যাবে। এর বাইরে বাংলাদেশ এর কাছে আমেরিকার কী পাওয়ার আছে আমার ঠিক মাথায় ঢুকেনা।

আমি জানি নিজেদের সমালোচনা-দুর্বলতার কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগার কথা না। অনেকেই আমার উপরের লেখাগুলো পড়ে আহত হবেন, ক্ষেপে যাবেন, কিংবা একমত হবেননা। কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং চিন্তাভাবনা শেয়ার করলাম এখানে। পছন্দ না হলে সামনে আর পড়ার দরকার নেই, কারণ সামনে আরো আত্ম-সমালোচনা আছেঃ)

ধরুন, বিএসএফ ওই যুবককে না মেরে বাংলাদেশের কোনো সন্ত্রাসীকে মেরেছে। তাহলে কি আপনি এতো কষ্ট পেতেন? এতোটা ক্রুদ্ধ হতেন? খুব সম্ভবত হতেন। এবার বলেন, আমাদের র‍্যাব যখন বাংলাদেশীদের ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলে, গুলি করে লাশ ফেলে রাখে রাস্তায়, তখন আপনার কেমন লাগে? আপনি যদি র‍্যাব দ্বারা বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা সমর্থন করেন তাহলে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যা সমর্থন করেন না কেনো?

ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে যে আপনি পিটিয়ে বা আইন বহির্ভূতভাবে মানুষকে হত্যা সমর্থন করেন, কিন্তু কে সেটা করলো সেটার দিকে খেয়াল করেন। বিএসএফ মারলে দোষ, কিন্তু র‍্যাব মারলে দোষ নয়?

২০০৬ এর ২৮শে অক্টোবর শিবির এর একটা ছেলেকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করলো আওয়ামী লিগের লোকজন, আপনি (যদি আপনি আওয়ামী লীগ সমর্থক হোন আরকি) নিশ্চয়ই সেটা সমর্থন করেন? শিবির যখন রগ কাটে, কিংবা জামাতী রাজাকাররা যখন আমাদের বাংলাদেশীদের, কিংবা বুদ্ধিজীবিদের একাত্তরে হত্যা করেছিলো তখন ওরা নিশ্চয়ই কোনো মানবিকতা দেখায়নি। অতএব, এখন ওদেরকে অমানবিকভাবে মেরে ফেলার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ নেই?

ছাত্রলীগ এর সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোপাকুপি, খুনাখুনি দেখার পর মনে হয় না ছাত্রদল, কিংবা ছাত্র শিবির, কিংবা র‍্যাব-পুলিশ ধরে যদি এদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলতো আপনার (যদি আপনি বিএনপি কিংবা জামাত সমর্থন হোন আরকি) খুবই খুশি লাগতো। আচ্ছা বিএসএফ যদি ছাত্রলীগ এর এই সব গুন্ডাদের ধরে মেরে ওই যুবকের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলতো তাহলে কি আপনার একই রকম খুশি লাগতো?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল সাইদি যুদ্ধাপরাধী নন বলার পর একদল তরুণ যখন তাঁর কক্ষ ভাংচুর করেছে, তখন অনেকে – বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক লোকজন – এটাকে সমর্থন দিয়েছেন। একজন মানুষ যুদ্ধাপরাধী নন, এই মতামত দেওয়ার পর তার অফিস কক্ষ ভাঙ্গা তাদের কাছে কোনো অপরাধ নয়। এখানেও সেই একই যুক্তি – এইসব রাজাকার, আলবদরেরা যখন আমাদের বাংলাদেশীদের ধরে কচুকাটা করেছিলো তখন ওরাতো কোনো মানবিকতা দেখায়নি?

বিএনপির দ্বিতীয় দফা শাসনের সময় “অপারেশন ক্লিন হার্ট” নামে সেনাবাহিনী নামিয়ে দেওয়া হয়েছিলো সাধারণ মানুষকে ধরে ধরে উত্তম মধ্যম দেওয়া, কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্যে। শফিক রেহমানের মতো মানুষেরা সেটার প্রশংসা করে বলেছিলেন সব যুদ্ধে কিছু “কোল্যাটারাল ড্যামেজ” হয়। দেশের ভালো করতে গেলে কিছু মন্দ ঘটতেই পারে। অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় সেনাবাহিনী অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ধরে নির্যাতন করেছে, রাস্তায় থামিয়ে অপমান করেছে, সন্তানের সামনে পিতাকে কান ধরে উঠবস করিয়েছে। মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে পরে বলেছে হার্ট এটাকে সেই মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষেরা হাততালি দিয়েছি আমাদের সেনাবাহিনীর বীরত্ম দেখে।

ব্লগে, ফেইসবুকে আমাদের অসংখ্য মানুষকে (বিশেষ করে পুরুষ মানুষকে) দেখেছি হাসান সাইদ নামক পুরুষটিকে সমর্থন করতে, যে তার স্ত্রী রুমানার নাক কামড়ে ছিড়ে ফেলেছিলো, চোখ অন্ধ করে দিয়েছিলো। কেনো সেই মানুষগুলো হাসান সাইদকে সমর্থন দিয়েছিলো? কারণ রুমানার নাকি এক ইরানী যুবকের সাথে প্রেম ছিলো। অন্য পুরুষের সাথে প্রেম এর শাস্তি হচ্ছে নাক ছিঁড়ে ফেলা, চোখ ঘুঁটে অন্ধ করে দেওয়া! এবং এই মানুষগুলো দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইত্যাদি পড়ুয়া ছেলেমেয়ে!

আমরা আমাদের রিকশাওয়ালাদের পাঁচ টাকার জন্যে মার দিই, গালি দিই। আমাদের ঘরের কাজের লোকজনের সাথে আমরা কৃতদাসের মতো ব্যবহার করি।

আমাদের রাস্তা দিয়ে মেয়েরা হেঁটে যেতে পারেনা। কয়েক’শ চোখ তাকে ধর্ষণ করে বেড়ায়। অসংখ্য মুখ তার সম্পর্কে বাজে, রসালো মন্তব্য করে। এবং এই ধর্ষণকারী চোখগুলি, মুখগুলি আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া তরুণ।

তো বিএসএফ এর এক বাংলদেশী যুবককে নির্দয়ভাবে পেটানোর সাথে আমাদের দেশের এইসব অমানবিকতার সম্পর্ক কী?

সম্পর্ক হচ্ছে আমরা যদি আমাদের নিজেদের মর্যাদা না রাখতে পারি, আমরা যদি বাংলাদেশী হয়ে অন্য বাংলাদেশীদের এতো নির্দয়ভাবে মারতে পারি, পেটাতে পারি, ধর্ষণ করতে পারি, উত্যক্ত করতে পারি, র‍্যাব-সেনাবাহিনী দিয়ে পেটাতে পারি, এবং এতোকিছুর পর আমাদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে সেই অমানবিকতা, নিষ্টুরতা, নির্দয়তা, অসভ্যতা সমর্থন করতে পারি, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা একটা আত্মমর্যাদাহীন, আত্মসম্মানহীন জাতিতে পরিণত হবো এবং সেটা আমরা হচ্ছি।

আমরা যদি আমাদের নিজেদের মর্যাদা নিজেরাই না রাখতে পারি, তাহলে বিএসএফ কি আমাদের সেই মর্যাদা দিবে?

আমি কিন্তু এখানে বিএসএফ এর এই আচরণকে সমর্থন করছিনা, আমি ওদের এই আচরণের কারণ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি মাত্র।

বিএসএফ কখনো আমেরিকার একজন নাগরিককে এভাবে পেটাবেনা। কারণ আমেরিকা নিজেদের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করে এবং ভারতের এই আচরণের সাথে সাথে ভারত সেটার দাঁতভাঙ্গা জবাব পাবে।

আমেরিকা নিজেদের মাটিতে কাউকে অমানবিক নির্যাতন করতে পারেনা বলে (আইনের কারণে) কিউবার গুয়ানতানামোতে নিয়ে বিদেশীদের সাথে এই নিষ্ঠুর, নির্মম আচরণ করে। (ভাগ্যিস ওবামা এসে মানুষ নির্যাতনের এই কল বন্ধ করে দিয়েছে)।

যতোদিন আমরা নিজেরা নিজেদেরকে সম্মান দেওয়া শিখবোনা, আমার ধারণা বিএসএফও ততোদিন আমাদের সাথে এমন আচরণ করে যাবে।

আমরা যদি একটা মর্যাদাবান যাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারি, আমরা যদি নিজেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাত-র‍্যাব-পুলিশ-সেনাবাহিনী-ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-ছাত্র শিবির-সাধারণ মানুষ সবাইকে যদি আইনের শাসনের আওতায় নিয়ে বিচার করি, তাহলেই আমরা একটা চমৎকার সমাজ এবং জাতি গড়তে পারবো।

পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আইনের শাসনের একটা দেশ উন্নত হতে খুব বেশিদিন লাগেনা। এবং আমরা একটা উন্নত দেশ হতে পারলে বিএসএফ আমাদের যুবকদের ধরে নিয়ে পেটানোর পরিবর্তে একজন আমেরিকান নাগরিকের মতো ব্যবহার করবে। আর যদি সেটা না করে তবে বিএসএফকে একটা শক্ত পিটুনী দেওয়ার মতো শক্তিও তখন আমাদের থাকবে। আমাদের সশস্ত্রবাহিনী তখন অপারেশন ক্লিন হার্ট এবং ক্রস ফায়ার বাদ দিয়ে একটা সত্যিকারের শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হবে, যারা সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের সাথে ব্যাটাগিরি না দেখিয়ে ভারতের মতো দেশের সাথে ব্যাটাগিরি দেখানোর সামর্থ্য রাখবে। আর আমাদের তরুণ-তরুণীরা ব্লগে-ফেইসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়াও বাংলাদেশে ভারতের মতো পারমানবিক শক্তি-স্যাটেলাইট-জঙ্গিবিমান-সুপারকম্পিউটার তৈরির জন্যে মেধাবী হওয়ার জন্যে কাজ করবে।

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি – শেষ পর্ব

২০। সানস্ক্রীন ব্যবহার করুন

বেশি রোদ পড়লে ত্বকের ক্ষতি হয়, সানস্ক্রীন ব্যবহার করে ত্বকের যত্ন নিন। এবং নিচের ভিডিওটিতে যতো উপদেশ দেওয়া আছে সেগুলো সব অনুসরণ করার চেষ্টা করুনঃ

বাংলা অনুবাদ

২১। বেশি ভাবাভাবি বন্ধ করে কাজ করুন

বেশি ভাবতে যেয়ে জীবনের দরকারী কাজগুলো প্রায়ই করা হয়ে উঠেনা। আমি আমার জীবনে বেশি ভেবেচিন্তে একটা কাজও করতে পারেনি।

বেশি চিন্তা না করে কাজে নেমে পড়ুন। নাহলে কিছুই আর করা হয়ে উঠবেনা।

২২। সুযোগ পেলেই গান গাইতে, নাচতে চেষ্টা করুন

গান এবং নাচ চমৎকার আর্ট এবং মনকে খুব হালকা করে। নাচানাচি কিংবা গান গাওয়া/শুনার পড় মন ভালো না হতে উপায় নেই!

২৩। নতুন বন্ধু বানানো কঠিন কিছু না, এবং বর্তমান বন্ধুদের সাথে সুসম্পর্ক রাখাও জরুরী

আমি আমার গতো আট বছরের ভ্রমণ করে আসছি পুরোপুরি একা। প্রায়ই আমি একটা নতুন দেশে যে পা রাখি যেখানে আমাকে নিতে আসার কেউ থাকেনা। আমার তেমন কোনো কানেকশন নাই, কিন্তু আমি যেভাবেই হোক নতুন কানেকশন তৈরি করি। ইন্টারনেটে কোথাও কোনো পার্টি হচ্ছে দেখলে আমি সোজা যেয়ে সবাইকে “হ্যালো” বলি। এবং একটু লেগে থাকলে আমি কিছু মানুষকে পেয়ে যাই যাদের সাথে আমি গল্প-গুজব-আড্ডা দিতে পারি।

আপনি যদি বন্ধুত্বপরায়ন, অকপট, এবং মোটামুটি মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখেন তাহলে পৃথিবীর যেকোনো জায়গার যেকোনো মানুষের সাথে আপনি বন্ধুত্ব করতে পারবেন।

২৪। আপনার যা যা আছে তা হারিয়ে যাবার আগে সেগুলোর মূল্য বুঝবেন না

কোনো কিছুকেই খুব সহজপ্রাপ্য হিসেবে ধরে নিবেন না। একদিন রাতে আমার হোটেলে থাকার টাকা ছিলোনা এবং আমাকে বাইরে পাথরের উপর ঘুমাতে হয়েছিলো। সেই থেকে আমি আমার ঘুমানোর জন্যে যে একটা বিছানা এবং বাসা আছে সেটা নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। কারণ আমি জানি পৃথিবীর অনেক মানুষের এই মৌলিক জিনিসগুলোও নাই। কেবল এক রাতের বাইরে ঘুমানোর কষ্ট থেকে আমি এখন প্রতিদিন রাতে আমার বিছানায় ঘুমাতে যাবার আগে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি!

একবার আমার কানের ইনফেকশনের কারনে আমি প্রায় দুই সপ্তাহ কানে কিছু শুনতে পারতামনা। এরপর থেকে আমি আমার শ্রবণশক্তির জন্যে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকি। সুস্থ কান থাকার কারণে আমি চারদিকের এতো সব চমৎকার শব্দ শুনতে পাই!

আমি কখনো আমার খুব কাছের কাউকে মারা যেতে দেখিনি এখনো, কিন্তু আমি আমার পরিবারের কারো সাথে দেখা হলে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে বলি আমি তাদের কতোটা ভালোবাসি। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনদের সাথে আমি কোনো মনোমালিন্য পুষে রাখিনা, এবং আমার মনের কথাটি আমি সবসময় খোলাখুলিভাবে বলে ফেলি।

২৫। অযাচিত অহম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের ভুলের জন্যে ক্ষমা চেয়ে ফেলুন

কারো প্রতি মনে ক্ষোভ পুষে রাখবেননা, এবং সবসময় অন্যের সাথে বিতর্কে জেতার জন্যে মরিয়া হয়ে থাকবেননা। মাঝেমধ্যে নিজের অহমকে ছোট করে মানুষের সাথে মনোমালিন্য এড়ানো যায়। অপরজনের আগে আপনি নিজেই বলে ফেলুন আপনি দুঃখিত। কখনোই যার সাথে সমস্যা হচ্ছে তার ভুল বুঝার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন না। নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে ভুল বুঝাবুঝির সমাধান করে ফেলুন।

২৬। শুধুমাত্র অন্যদের মুগ্ধ করার জন্যে কিছু করা গাধামি

মানুষকে মুগ্ধ করার জন্যে যা-ই করেন না কেনো মানুষ আপনাকে সেই স্বীকৃতিটুকে দিবেনা। মানুষকে যদি বলে বেড়ান যে আপনি কতোগুলো ভাষা জানেন, কিংবা আপনি কতো ধনী, কতো উঁচু লেভেলের মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে, আপনি কতো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, আপনি কতো ভালো কাজ করেন, কোনো কিছুতেই আসলে মানুষের থেকে সেই স্বীকৃতিটুকু আপনি পাবেননা যেটা আপনি চাচ্ছেন। মানুষকে চমকিত করে আপনি নিজে গৌরবান্বিত হতে পারবেননা।

মানুষ তাদের দ্বারাই মুগ্ধ হয় যাদের কাছে গেলে তারা মন খুলে কথা বলতে পারে, এবং যাদের কথা এবং কাজ তাদের কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে। মোটামুটিভাবে বলা যায় আপনি মানুষ হিসেবে ইন্টারেস্টিং হতে পারলেই মানুষ আপনাকে পছন্দ করবে, আপনার দ্বারা মুগ্ধ হবে।

২৭। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ একাকীত্বে ভোগে

একা একা ভ্রমণ করার কারণে যে প্রশ্নটি আমাকে প্রায়ই শুনতে হয় তা হচ্ছে আমার নিজেকে একা লাগে কিনা। এক কথার হচ্ছে – না। আর লম্বা করে উত্তর দিতে গেলে একটা আলাদা পোস্ট লিখতে হবে।

সত্যি কথা বলতে কি পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ একাকীত্বে ভোগে। আর আমি আসলে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক বেশি একা ছিলাম। এখন আমি এমন অনেক মানুষের সাথে মিশি যাদের অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব, সামাজিক-পেশাগত নেটওয়ার্ক আছে। কিন্তু এদের অনেকেই নিজেকে একা ভাবেন কারণ তাদের ধারণা মানুষ তাদেরকে বুঝেনা।

আবার অনেকে পেশাগত কিংবা পারিবারিক কারনে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনদের থেকে দূরে সরে গিয়েছেন এবং এখন নিজেকে একা লাগে।

অনেকেই আমাকে বলেন যে পৃথিবীতে তাদের মতো একা আর কেউ নেই। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমার আসলে আমার নিজ বাড়ি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যেখানে কেউ আমার নাম পর্যন্ত জানেনা সেখানে বরং আমার অনেক ভালো লাগে। আমি নিশ্চিত এই মুহুর্তে পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আমার মতো অবস্থায় আছে যেখানে তারা তাদের প্রিয়জন থেকে অনেক দূরে আছেন।

নিজেকে একা লাগলে ভাববেন না আপনিই একমাত্র এই অবস্থায় আছেন। চারদিকের অনেকেই আপনার মতো একা আছেন এবং তারা নিশ্চিতভাবেই আপনার অবস্থা বুঝতে পারে।

২৮। ভালোবাসা-ই জীবনে সব নয়, তবে কিছু ভালোবাসার মানুষ ছাড়া জীবনটা শূন্য মনে হতে পারে

ভালোবাসা ছাড়াও আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন, কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া জীবনের একটা অংশ খালি মনে হবে। আপনার জীবনে কিছু মানুষ থাকা দরকার যারা আপনাকে ভালোবাসে – বন্ধুবান্ধব, পরিবার, অথবা আপনার প্রেমিক/প্রেমিকা।

২৯। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুলি কেউ আপনাকে কাগজে লিখে দিতে পারবেনা, আপনাকে অবশ্যই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মনে হতো আমি প্রায় সবকিছু জেনে গিয়েছি – এবং জীবনের গুরুত্মপূর্ণ প্রায় সবকিছুই বইয়ে লেখা আছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্মপূর্ণ জিনিসগুলো নির্ভুলভাবে কাগজে লেখা প্রায় অসম্ভব, এবং সেটা আমার এই পোস্ট সম্পর্কেও সত্যি।

যখন সারা পৃথিবীর প্রায় সব জ্ঞান যখন একটা কীবোর্ড এবং মাউস দিয়ে পাওয়া যায়, তখন এটা মনে হতে পারে বাইরের পৃথিবীতে যেয়ে সেই জ্ঞান নিজে অর্জন করার কোনো দরকার নেই। সিনেমা, বই, খবরের কাগজ ইত্যাদির মাধ্যমে এখন মনে হতে পারে আমরা প্রায় সব কিছু সম্পর্কে জেনে যেতে পারি।

এটা একটা ভুল ধারণা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছে মানুষের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

ঘরে বসে বসে নাটক, সিনেমা, কম্পিউটার এর মাধ্যমে পৃথিবী সম্পর্কে জানা বন্ধ করে বাইরে যেয়ে নিজের জীবন থেকে সেই অভিজ্ঞতা লাভ করুন।

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি – ২

পর্ব – ১

৬. মানুষকে কোনো কিছু বিশ্বাস করানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিজে একটা চমৎকার জীবন যাপন করা

কথা কিংবা যুক্তি-তর্ক দিয়ে মানুষকে যতোটা না বুঝাতে পারবেন, যেটার কথা বলছেন সেটা নিজে করে তার চেয়ে অনেক ভালো বুঝাতে পারবেন। যখন মানুষ আপনাকে দেখবে, আপনার কাজ দেখবে, তখন আপনার ওদেরকে আর আলাদাভাবে বিশ্বাস করানোর দরকার হবে না। তাদেরকে শুধু বলুন আপনি আপনার কাঙ্খিত জিনিসটি অর্জন করেছেন, জীবনে যেখানে পৌঁছাতে চান সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন কিংবা সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন। এরপর তাদেরকে জানান কীভাবে আপনি সেটা অর্জন করলেন বা করছেন। তাহলেই সবাই বুঝতে পারবে আপনি আসলে ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছেননা শুধু।

৭। পৃথিবীর কেউই সবকিছু জেনে বা পেয়ে বসে নেই

সবারই কিছু না কিছু সমস্যা আছে, কিন্তু তারা সেটা গোপন করে চলে। আপনি যখন একজন মানুষকে দেখেন তখন শুধু সে তাকে যেভাবে বাইরের পৃথিবীর কাছে দেখাতে চায় সেটাই দেখেন। আপনি হয়তো ভাবতেও পারবেন না তারা কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, কিংবা যে সুখী অবস্থায় তাদের দেখছেন সে অবস্থায় আসতে তাদের কীসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এটা সবার জন্যে সত্যি – কোটিপতি, ছাত্রছাত্রী, স্মার্ট তরুণ-তরুণী, লাজুক মানুষটি, এবং আর যেকোনো ধরণের মানুষই বলুন না কেনো, তাদের সবারই ভেতরের একটা জগত আছে – বাইরে থেকে তাদেরকে যেমনই মনে হোক না কেনো।

কারো সম্পর্কে সবকিছু জানার আগে কখনোই ভাববেন না সে খুব সহজে জীবনে সবকিছু পেয়ে গেছে।

৮। “আমি জানিনা” – এটা বলায় কোনো লজ্জা নাই

অনেকে কোনো বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করায় লজ্জা পান। এটা নিয়ে কোনো ভাবাভাবির অবকাশ নাই – জাস্ট বলে ফেলুন “আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে জানিনা”। অজ্ঞতা লুকানোর চেয়ে সততা অনেক বেশি স্মার্ট একটা ব্যাপার।

৯। আরো বেশি টাকা কখনোই আপনার সব সমস্যার সমাধান করবে না

আপনার যদি খাবার এবং থাকার জন্যে পর্যাপ্ত টাকা থাকে তাহলে এরচেয়ে বেশি টাকা ছাড়াও আপনি জীবন চালিয়ে নিতে পারবেন। এটা আরো ভালো করে বুঝতে পারবেন যদি আপনি অসচ্ছল অথচ মোটামুটি সুখী এমন মানুষদের সাথে মিশেন। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলি পেতে কোনো টাকা লাগেনা, আর বাদবাকী জিনিসগুলো আপনি যতো দামী ভাবছেন ততোটা দামী না।

১০। আপনার সম্পদ আপনাকে কিনে নেয়

সত্যিকারের দরকারী জিনিসগুলো ছাড়া মানুষের অন্যান্য দামী সম্পত্তি-সম্পদ আসলে অন্যের কাছ থেকে স্বীকৃতি বা এক ধরণের লোক দেখানো ছাড়া কিছুই না। বেঁচে থাকা এবং জীবন যাপনে সুবিধার জন্যে দরকারী না হলে এসব দামী জিনিসপত্র ছাড়া আপনি অনায়াসে আপনার জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন।

যখন আপনি জীবনে দামী জিনিসপত্র ছাড়া চলতে পারবেননা তখন এই জিনিসপত্রগুলি আপনার জীবনকে পরিচালিত করবে। আপনার দামী বাড়ি বা ফ্ল্যাট এবং ঘরের দামী ফার্নিচার থাকার কারণে আপনি অন্য জায়গায় সহজে চলে যেতে পারবেন না, এবং এগুলো পাওয়ার জন্যে আপনাকে সবসময় অনেক বেশি উপার্জন করা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এবং আমার ধারণা এইসব দামী সম্পদ আপনার জীবনকে খুব বেশি সমৃদ্ধ করেনা। জীবনে যতো কম সম্পদ থাকবে ততোই আসলে ভালো।

১১। টেলিভিশনের মতো সময় অপচয়কারী বস্তু পৃথিবীতে আর কিছু নাই

আমার বয়স একুশ হওয়ার আগে আমি টিভি দেখে আমার জীবনের অনেক সময় অপচয় করেছি। আমার মনে হতো “অমুক প্রোগ্রামটি আমাকে দেখতেই হবে”। এখন আমার সেই হারানো প্রতিটি সেকেন্ডের জন্যে খুব দুঃখ হয়। সারা পৃথিবী এগিয়ে চলে যাচ্ছিলো ভবিষ্যতের দিকে আর আমি বসে বসে টিভি দেখছিলাম!

বিংশ শতাব্দীতে টিভি একটা গুরুত্মপূর্ণ জিনিস ছিলো – সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ এবং সংবাদ এর জন্যে। কিন্তু এখন টিভির আর তেমন দরকার নেই। টিভির খবরগুলো সাধারণত পক্ষপাতিত্বপূর্ণ হয় যেখানে আমাদের অনেক বিকল্প সংবাদ মাধ্যম রয়েছে। আর টিভির অনুষ্ঠানগুলো থেকে শেখার প্রায় কিছুই নেই, যদিও এগুলো মানুষের দিন থেকে ঘন্টার পড় ঘন্টা নিয়ে নেয়। অথচ আমরা প্রায়ই অনুযোগ করি আমাদের হাতে সময় নেই!

টেলিভিশন মানুষকে ঘরকুনো করে ফেলে। যদি টেলিভিশনে পছন্দের কোনো অনুষ্ঠান বা খেলা দেখতে চান তাহলে কোনো বন্ধুর বাসায় যেয়ে আড্ডা দিতে দিতে একসাথে দেখুন।

ঘরের ভেতরে বসে টেলিভিশনের স্ক্রীন এর মতো জড় একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে থেকে জীবনকে কোনোভাবের সমৃদ্ধ করতে পারবেননা।

১২। ইন্টারনেট হচ্ছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে উপকারী জিনিস, কিন্তু এটাকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করতে হবে

টেলিভিশন হচ্ছে একটা নির্বোধ জড় স্ক্রীন, তার বিপরীতে ইন্টারনেট হচ্ছে একটা সক্রিয় মাধ্যম। ইন্টারনেট নিয়ে আপনি অনেক কিছু করতে পারবেন, একটা ভার্চুয়াল সামাজিক জগতে ঢুকে যেতে পারবেন। ইন্টারনেট পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে নানাভাবে সংযোগ স্থাপন করে এবং এটা ছাড়া আমার গতো আট বছরের জীবন অনেক কঠিন হতো।

ইন্টারনেটের এতো উপকারিতা সত্ত্বেও এটারো টেলিভিশনের মতোই সময় অপচয় করার সম্ভাবনা আছে। জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্যে ইন্টারনেট ব্যব্যহার করুন, কিন্তু সারাদিন এর মধ্যে পড়ে না থেকে বাইরে যেয়ে সেই সমৃদ্ধ জীবন উপভোগ করুন। টেলিভিশনের জড় স্ক্রীন এর জায়গায় কম্পিউটার এর অনেক কর্মকান্ডভরা স্ক্রীন ব্যবহার করলেই যে আপনার সময়ের সদব্যবহার হবে তা কিন্তু না। বাইরের পৃথিবী অনেক বেশি সুন্দর, বের হোন এবং সেটা উপভোগ করুন।

১৩। বাইরে যেয়ে মানুষের সাথে কিছু সময় কাটান

আমার খুব প্রিয় একটা ওয়েবসাইট হচ্ছে http://www.couchsurfing.org/। যেহেতু আমি নতুন নতুন ভাষা শিখতে আগ্রহী, এই সাইটের মাধ্যমে অনেক ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে আমার অতিথি হিসেবে আমার বাসায় থাকতে দিয়েছি এবং বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে তাদের ভাষা শিখতে পেরেছি।

সত্যিকারের পৃথিবী হচ্ছে বাইরের পৃথিবী – বই, টেলিভিশন, এবং ইন্টারনেটে যে পৃথিবী দেখছেন সেটা না। এই পৃথিবীর দেখা পাবেন আপনি বাইরের মানুষের সাথে মিশলে। নিজেকে লাজুক বা ইন্ট্রোভার্ট হিসেবে ভাবা বন্ধ করুন এবং নিজের ঘরের কিংবা দেশের বাইরে যেয়ে অন্য মানুষের সাথে মিশুন।

১৪। শুধু ইংরেজী ভাষা দিয়ে অন্য দেশের মানুষেকে খুব গভীরভাবে জানতে পারবেন না

আপনার বিদেশ ভ্রমণ যদি অল্প কিছুদিনের হয় তাহলে আপনি ইংরেজী দিয়ে অনায়াসে কিছুদিন চালিয়ে নিতে পারবেন। হোটেল বুক করা, রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দেওয়া, কিংবা একজন ভ্রমণ গাইডের সাথে ইংরেজীতে কথাবার্তা চালিয়ে নেওয়া – সবই করতে পারবেন। হয়তো কিছু স্থানীয় শিক্ষিত বন্ধুবান্ধবও বানিয়ে নিতে পারবেন। আপনার হয়তো মনে হবে আপনি সে দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গিয়েছেন

কিন্তু আপনি আসলে সত্যিকারভাবে কোনো দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবেননা শুধু সেদেশের ইংরেজী জানা মানুষজনের সাথে কথা বলে। শুধুমাত্র ইংরেজী জানলে আপনি সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। আমি আমার ভ্রমণ করা দেশগুলো সম্পর্কে এতো বেশি জানতে পেরেছি কেবলমাত্র তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলার কারণে। ওদের ভাষায় কথা বলতে না পারলে এতো গভীরভাবে তাদের সম্পর্কে জানা আমার পক্ষে অসম্ভব হতো।

যে কেউ চাইলেই একটা নতুন ভাষা শিখতে পারে। আমার বয়স যখন ২১ ছিলো তখনো আমি ভাবতাম এটা সম্ভব না। কিন্তু একদিন আমি সব ফালতু অজুহাত দেখানো বন্ধ করলাম এবং একটা নতুন ভাষা শিখে ফেললাম। কোনো ভাষা তাড়াতাড়ি শেখার গোপন উপায় হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই সেই ভাষায় অল্প অল্প করে কথা বলা শুরু করা।

১৫। অন্য দেশের মানুষজন সম্পর্কে আপনি যা ভাবেন তারা আসলে সেরকম না

পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশই ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে উঠছে। এর মানে এই নয় যে ওরা সব পশ্চিমা দেশগুলো বা আমেরিকার মতো হয়ে উঠছে। সব দেশই ভিন্ন এবং সেটা ট্যুর বইয়ে তাদের সম্পর্কে যা পড়ে এসেছেন সেরকম নয়। ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে প্রথাগত এবং পুঁথিগত ধারণা বাদ দিয়ে খোলা মন নিয় এওদের সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করুন।

আইরিশ মানুষ মানেই যে বিয়ার খায় তা নয়, ব্রাজিলের সবাই ফুটবল খেলেনা কিংবা সাম্বা নাচেনা, এবং জার্মান, ডাচ, ফিলিপিনো সবার সাথে কথা বলে আপনি অবাক হবেন যদি আপনার আগে থেকে পুষে রাখা ধারণা বাদ দিয়ে তাদের সাথে মিশেন।

মানুষের ভিন্নতাকে সম্মান করুন, তাদের কাছে গেলে তাদের সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন। এমনো হতে পারে আপনার সংস্কৃতই ওদের কাছে পশ্চাদপদ মনে হবে!

১৬। জীবন নিয়ে তাড়াহুড়ো করবেন না, সময় নিন

যেসব দেশকে আমাদের কাছে “ধীর গতির” মনে হয়, আমি দেখেছি তারা আসলে তাদের নিজস্ব গতির জীবনে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। যেসব মানুষ কিংবা দেশ সবকিছু তাড়াহূড়ো করে করতে চায় তাদের কাজের কোয়ালিটি আসলে ততোটা ভালো হয়না। সবকিছু সহজভাবে নিন এবং ধীরে ধীরে কাজ করুন।

খাবারের প্রতিটি কামড় উপভোগ করুন, হাঁটার সময় চারপাশ দেখে ধীরে ধীরে হাঁটুন, কারো সাথে কথা বলার সময় তাকে তার কথা পুরোপুরি শেষ করতে দিন এবং সে পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনুন।

দিনের কাজের ভেতর মাঝে মধ্যে কাজ বন্ধ করে বাইরে তাকান, কিংবা চোখ বন্ধ করে একটা বড় নিশ্বাস নিন, বেঁচে থাকার জন্যে নিজেকে সুখী ভাবুন।

১৭। আপনি সবাইকে খুশি করতে পারবেন না

“সফল হওয়ার উপায় হয়তো আমি জানিনা, কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার উপায় হচ্ছে সবাইকে খুশি করতে যাওয়া” – বিল কসবি।

নিজের মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করুন। আপনার যদি আপনার মতামতের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস থাকে এবং সেই মতামত অন্যদের সাথে শেয়ার করেন তাহলে নিশ্চিতভাবে অনেক মানুষ আপনার উপর বিরক্ত হবে, আপনার কথাটা যতোই চমৎকার হোকনা কেনো। যারা আপনার সাথে একমত না এবং আপনার মত পছন্দ করছেনা এটা তাদের সমস্যা, আপনার না।

১৮। Cool হওয়ার চেষ্টা করা কিংবা সর্বশেষ ক্রেইজের পেছনে ছোটা আসলে Uncool

যারা সবসময় অন্যের দেখাদেখি নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে তারা আসলে নিজেদের ব্যক্তিত্ব নিয়ে ভয় পায়। নিজের মেরুদন্ড শক্ত করুন, এবং স্রোতের বিপরীতে যাওয়াটাকে যদি আপনার সঠিক পথ মনে হয় তাহলে শক্তভাবে তাই করুন। আজকে যেটা চমকপ্রদ কয়েক বছর পর সেটাই হয়তো সবার অপছন্দের জিনিসে পরিণত হবে।

১৯। ভুল করতে ভই পাবেন না, জীবনে অনেক ভুল করুন

ভুলের মাধ্যমেই আমরা শিখি। সাফল্য আসে অনেক ভুলের পরেই

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি

কিছুদিন আগে একটা ওয়েব সাইটে একটা চমৎকার লেখা পড়ি। ভদ্রলোক গতো আট বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং বিভিন্ন দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতি শিখছেন। তার পৃথিবী ভ্রমনের আট বছর পুর্তি উপলক্ষে তিনি তার ভ্রমন থেকে কী শিখেছেন সেটার একটা লিস্ট দিয়েছেন ভাবলাম অনুবাদ করে ফেলি:)

মূল লেখার লিঙ্কঃ http://www.fluentin3months.com/life-lessons/

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি
===========================================

আট বছর।
৪১৬ সপ্তাহ, যেটা প্রায় ৩০০০ দিন।

এই দীর্ঘ সময় আমার কোনো নির্ধারিত ঘর ছিলোনা। আমি ঘুরে বেড়িয়েছি দেশ থেকে দেশে, এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে। আমার সারা জীবনের অর্জন করা সব সম্বল আমার ট্রাভেল ব্যাগে করে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি এই সময়টা। এটা ছিলো আমার জীবনের একটা বড় অংশ, এবং আমি এখনো এটা করে চলেছি।

এর আগেও আমি অবশ্য কয়েকটা জায়গায় ভ্রমন করেছি – দুটো গ্রীষ্ম আমেরিকায়, আর এক মাস স্পেইনে। এবং ২০০৩ সালে, আমার একুশতম জন্মদিনের সপ্তাহটিতে, আমি আমার জন্মস্থান আয়ারল্যান্ড ছাড়ি চিরদিনের জন্যে। এর কয়েকদিন আগে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করি, এবং আমি জানতাম এরপর হয়তো আমি আয়ারল্যান্ডে শুধু বেড়াতে আসবো, যদিও আমি জীবনে কখনো আমার পরিবারের সাথে ক্রিসমাস ডিনার না খেয়ে থাকিনি। কিন্তু আয়ারল্যান্ড আর আমার বাড়ি না। এখন থেকে “যেখানে আমি যাবো সেটাই হবে আমার বাড়ি”।

এর আগে আমার জীবনের প্রায় সবটুকু আমি ব্যয় করেছি বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে। কিন্তু সেখানে আমি গুরুত্মপূর্ণ প্রায় কিছুই শিখিনি। বইয়ে লেখা জিনিসগুলো প্রায় সবই আমি আগে থেকে জানতাম, কিন্তু আমি যা হতে চেয়েছি জীবনে সেটা আমি শিখেছি গতো আট বছরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে। এবং আমার নিশ্চিতভাবে এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।

গতোকাল ছিলো আমার ২৯-তম জন্মদিন, এবং এই সপ্তাহে আমার পৃথিবী ভ্রমনের আট বছর পূর্ণ হচ্ছে। তাই ভাবলাম আমার এই আট বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ২৯টি শিক্ষা আপনাদের সাথে শেয়ার করি। এগুলো বেশিরভাগই জীবন নিয়ে সাধারণ কথাবার্তা, কিন্তু এগুলো আমি শিখেছি সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের সাথে মেশার পরঃ

১। সব জায়গায় সব মানুষ আসলে একই জিনিস চায়

যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি অনেক ভিন্ন, আপনি ইটালিয়ান কোটিপতি থেকে শুরু করে গৃহহীন ব্রাজিলিয়ান, নেদারল্যান্ডস এর জেলে, ফিলিপাইনের কম্পিটার প্রোগ্রামার এর সাথে তাদের নিজের ভাষায় তাদের মতো করে কথা বলে দেখবেন যে তারা সবাই জীবনের গুরুত্মপূর্ণ জিনিসগুলোর ব্যাপারে একই রকম চিন্তা করে।

সবাই চায় স্বীকৃতি, ভালোবাসা, নিরাপত্তা, বিনোদন, এবং একটা ভবিষ্যতের আশা। এই চাওয়াগুলির প্রকাশ এবং এগুলো পাওয়ার জন্যে সবার কাজে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু এই বাহ্যিক ব্যাপারগুলো উপেক্ষা করলে দেখবেন পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ আসলে প্রায় একই জিনিস চায়।

২। সুখ ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখা বড় ভুল

অসংখ্য মানুষ ভাবে “ওই একটা জিনিস” যদি ঠিক হয়ে যায় “তাহলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে”।

এটা একটা ঘোর (ডিলুশন)।

যখন “ওই একটা জিনিস” ঠিক হবে, তখন “আরো একটা” জিনিস আপনার জীবনে বাকি থেকে যাবে। জীবনে কখনো সবকিছু একসাথে আপনার কাছে ধরা দিবেনা। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জীবনে সুখী হওয়া শুধু একটা জিনিস ঠিক হয়ে যাওয়ার উপর নির্ভর করেনা, এভাবে সুখী হওয়াও যায়না। এরচেয়ে এই মুহুর্তে আপনার যা আছে তা নিয়ে সুখী হোন, বর্তমানকে উপভোগ করুন, এবং একইসাথে ভবিষ্যতের জন্যে জন্যে কাজ করে যান। সাফল্য আসলে একটা ভ্রমন, গন্তব্য নয়!

আপনার জীবনের একটা বড় অংশ যদি একটা বড় কিছুর জন্যে কাজ করে চলে যায় তাহলে সে কাজটি হয়ে যাওয়ার পর আপনার জীবনে আর তেমন কিছুই থাকবেনা। কোনো বড় কিছুর জন্যে কাজ করলেও নিজেকে সুখী হওয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না, কাজটি শেষ হওয়া পর্যন্ত সুখী হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন না, কাজ করতে করতেই সুখী হওয়ার চেষ্টা করুন।

ধীরে ধীরে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন এবং এই ভ্রমন উপভোগ করুন।

অনুষ্টানটি উপভোগ করুন, শেষ দৃশ্যের জন্যে তাড়াহূড়ো করবেন না।

আমাদের জীবন হচ্ছে এখন – অতীত এবং ভবিষ্যত কোনোটাই না।

৩। “একদিন আমার সময় আসবে আর আমি সুখী হবো” – এটা একটা ফালতু চিন্তা। আপনি কখনোই লটারি জিতবেন না। বাস্তববাদী হোন।

অনেকের ভাগ্য নিয়ে একটা অদ্ভুত ধারণা আছে – আল্লাহ/ঈশ্বর/ভগবান/দেবতা কেউ একদিন কোনোভাবে তাদের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিবেন। তারা ভাবেন তারা “সৌভাগ্য পাবার যোগ্য” এবং “একদিন সব এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে” তাদের জন্যে। কেউ কেউ ভাবেন একদিন তারা লটারি জিতবেন কিংবা ভালো কিছু একটা ঘটবে তাদের জীবনে। অনেক মেয়ে ভাবে একদিন তার রাজপুত্র এসে তাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের দেশে!

এই ধরণের ভাবনা আসে পৃথিবী কীভাবে কাজ করে সেটা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা থেকে। হতে পারে আমি ভুল, হয়তো প্রার্থনা বা আশা থেকে ভালো কিছু ঘটতে পারে, হয়তোবা মানুষ হিসেবে ভালো হয়ে থাকতে পারলে একসময় ভালো কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু আশা, প্রার্থনা, এবং ভালো হওয়ার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে চাওয়ার জিনিসটাকে অর্জন করার চেষ্টা করে যেতে দোষ কোথায়?

আমি ব্যক্তিগতভাবে জাদু, জ্বীন-পরী, জ্যোতিষবিদ্যা, কিংবা কোনো অদৃশ্য সত্ত্বায় বিশ্বাস করিনা । এগুলোর ব্যাপারে আমি সন্দিহান এবং আমি বিশ্বাস করি এগুলো সবকিছু অসম্ভব এবং হাস্যকর। এইসব অদৃশ্যে বিশ্বাস না করাটা আমার জীবনকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। একজন বাস্তববাদী মানুষ হিসেবে পৃথিবীকে আমি খুব যুক্তির জায়গা হিসেবে দেখি যেখানে প্রকৃতির তৈরি বৈজ্ঞানিক নিয়ম এবং মানুষের তৈরি সামাজিক নিয়ম অনুসারে সবকিছু চলে। এবং পৃথিবীকে এভাবে দেখার কারণে আমি অনেক সহজভাবে সবকিছু দেখতে পারি।

এই বিশ্বজগত আপনাকে কিছু দেবার জন্যে পণ করে বসে নেই। আপনাকেই আপনার জীবন গুছিয়ে তোলার জন্যে কাজ করে যেতে হবে।

৪। নিয়তি বলে কিছু নাই, এবং এটা একটা সুখবর!

নিয়তি’র দোহাই দিয়ে আমরা অনেকেই জীবনে ভালো কিছু করা থেকে বিরত থাকি। আসল ঘটনা হচ্ছে নিয়তি বলে কিছু নাই ।

আপনার ব্যর্থতা কিংবা সীমাবদ্ধতা আপনার জন্ম কোথায় হয়েছে সেটার উপর নির্ভর করেনা, কিংবা আপনি কাকে চিনেন, আপনার জিন কেমন, আপনার কতো টাকা আছে, আপনার বয়স, আপনার অতীত, বা অন্য কোনো কিছুর সাথেই এর কোনো সম্পর্ক নাই। কোনো কিছুর দোহাই দিয়ে আপনার সীমাবদ্ধতাকে আপনি জাস্টিফাই করতে পারবেননা।

যদি সত্যিকারভাবে সংকল্পবদ্ধ হন, তাহলে জীবনে অর্জন করার অজস্র সুযোগ আছে – আপনি কে কিংবা আপনার কাছে কতো টাকা আছে এটা কোনো ব্যাপারই না।

৫। আপনার থেকে ভিন্ন বিশ্বাস ও মতের মানুষের সাথে কথা বলুন এবং তাদের বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করুন

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সাথে পৃথিবীর অনেক মানুষের বিশ্বাসের কোনো মিল নাই। কিন্তু মানুষ এই ভিন্ন বিশ্বাসে থেকেও জীবনের তাৎপর্য খুঁজে পায়। যদি সবাই আমার মতো বিশ্বাস করতো এবং ভাবতো তাহলে পৃথিবীটা একটা রসকষহীন জায়গায় পরিণত হতো।

অতএব আমি যখন আমার থেক ভিন্ন বিশ্বাসের কোনো মানুষের সাথে মিশি, তখন তাদেরকে আমার বিশ্বাসে নিয়ে আসার চেয়ে তাদের বিশ্বাস তাদের কাছে রেখে একসাথে মিলে চলার চেষ্টা করাই ভালো।

কেউ যখন তার কোনো বিশ্বাস এর ব্যাপারে “১০০% নিশ্চিত” এবং বহু বছর ধরে সেই বিশ্বাস ধারণ করে আসছে, তখন তাকে কিছু চালাকী কথাবার্তার মাধ্যমে তার বিশ্বাস থেকে সরানো যায় না। সবাই কিছু কিছু ব্যাপারে বদ্ধ মনের মানুষ, আমি নিজেও তাই।

কেউ যদি নিজে নিজের বদ্ধ মন থেকে বের হতে না পারে তাহলে তাকে সেটাই বিশ্বাস করতে দেওয়া উচিত। আপনিই ঠিক আর অন্যরা ভুল – পৃথিবীকে এটা বোঝানোর দায়িত্ব নেওয়ার দরকার নাই। কখনো কখনো হয়তো আপনার বিশ্বাসটিই ভুল!

পৃথিবী আরো অনেক বেশি মজার জায়গা হয় যখন সেখানে বিভিন্ন বিশ্বাসের এবং আগ্রহের মানুষ থাকে। আমার নিজের সন্দেহবাদীতা সত্ত্বেও আমি অনেক জ্যোতিষী, হস্তরেখা বিশারদ, অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ, রক্ষণশীল মানুষ, এবং প্রযুক্তিকে ঘৃনা করে এমন অনেক মানুষের সাথে মিশেছি। এবং সেজন্যে আমার জীবন অনেক বেশী বৈচিত্রময় এবং সমৃদ্ধ
হয়েছে।

আপনি যদি শুধুমাত্র যারা আপনার সব কথায় হ্যাঁ বলে এমন মানুষদের সাথে মিশেন তাহলে আপনি কখনো ভুল করছেন কিনা এটা জানার সুযোগ পাবেন না এবং নতুন জিনিস শিখতেও পারবেন না।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?

১। মৃত্যু উপত্যকা

প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরের দূর্ঘটনায় অকালমৃত্যু আমাদের সবার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে। এটা এমন এক ক্ষতি আমাদের জাতির জন্যে যেটা সহজে পূরণ হবার নয়। এমনিতেই আমাদের চলচ্চিত্রের যাচ্ছেতাই অবস্থা, এর মধ্যে একজন চরম প্রতিভাবান নির্মাতাকে হারানো মানে আসলে আমাদের চলচ্চিত্রের আরো অনেকখানি পিছিয়ে যাওয়া।

সড়ক দূর্ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেও আমাদের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে বাসে বাসে সংঘর্ষের পর অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন, যদিও সেই দূর্ঘটনায় ছয়জন হতভাগা মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো।

নৌপথেও আমাদের দেশে প্রায়ই লঞ্চডুবি হয়। বছর বছর শত শত মানুষ মারা যায় তাতে।

কয়দিন পরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে রাস্তায় পড়ে মরে থাকে কিশোরের মৃতদেহ। ইট, রড দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে রাখি তরুণদের, যে আমাদেরই কারো না কারো স্বজন, পরিচিত জন।

আমাদের র‍্যাব-পুলিশ তো মানুষ মারাকে কৌতুকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। রাত তিনটার সময় র‍্যাবের গাড়ি থেকে পালাতে যেয়ে গুলি খেয়ে মরে যায় কোনো তরুন, তার মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকে কোনো দেশীও অস্ত্র! বিচার বিভাগ নামে যে একটা প্রতিষ্ঠান আছে সেটা মনে হয় আমাদের র‍্যাব-পুলিশের লোকজন কোনোভাবেই মানতে রাজী নন।

২। এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়!

তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর খবরের কাগজে, ফেইসবুক, টুইটার, ব্লগে মানুষের হাহাকার উঠেছে। সবারই মোটামুটি এক কথা – এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়! এ কোন দেশে আছি আমরা, আমাদের কি সরকার নেই? আমরা কি আফ্রিকার কোন যুদ্ধপীড়িত দেশ? এই লাশের মিছিল থামানোর দায়িত্ব কি কারো নয়?

৩। অযোগ্য রাজনীতিবিদ-আমলা-পুলিশ

রাজনীতিবিদরা আমাদের দেশের চিরকালীন ভিলেন। বাজের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে? বানিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজশ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সড়ক দূর্ঘটনায় কেউ মারা গেছে? যোগাযোগ মন্ত্রী করেটা কী? জঙ্গিরা বোমা ফাটিয়েছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজের দলের উপকার ছাড়া আর কোনো কাজে আগ্রহী না। শেয়ার বাজার পড়ে গেছে? অর্থ মন্ত্রী নিজেই এই চক্রের সাথে জড়িত!

হয়তো ব্যাপারটি সত্যি। আমাদের রাজনীতিবিদদের অদক্ষতা এবং অসততা আমরা আমাদের সামনেই দেখে চলেছি।

রাজনীতিবদদের সাথে আমাদের ভিলেনের তালিকায় আছে দুর্নীতিপরায়ণ এবং অদক্ষ আমলা এবং পুলিশ বাহিনী। রাজনীতিবিদদের সাথে তাল মিলিয়ে এই মানুষগুলোর কর্মকান্ডও দিন দিন আমাদের কষ্টের এবং দেশকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন ভঙ্গের পেছনে অনেক অবদান রাখছে।

৪। অযোগ্য আরো অনেকে

শুধু কি রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ নিয়ে আমাদের অভিযোগ?

– আমাদের শিক্ষকদের নিয়েও আমাদের অনেক হতাশা, তারা দিনের পর দিন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাজনীতি করে চলেছেন।
– হতাশা আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের নিয়ে যারা আমাদের আশা অনেক উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে বারবার নিরাশ করছে। ফুটবল খেলোয়াড়দের নিয়ে আমাদের হতাশা তো এমন পর্যায়ে যে আমাদের আর কোনো আশাই নাই ওদের নিয়ে।
-আমাদের বিজ্ঞানীরা খুব কমই গর্ব করার মতো কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছেন এখন পর্যন্ত।
– আমাদের চলচ্চিত্র এমন পর্যায়ে যে আমাদের মধবিত্ত, উচ্চবিত্ত সমাজ চলচ্চিত্র প্রায় বর্জন করে চলেছেন।
– আন্তর্জাতিক কোনো ক্রীড়া প্রতযোগিতায় আমাদের কখনো তেমন কোনো সাফল্য নাই।
– বিজ্ঞান-প্রকৌশলে আমাদের কোনো বড় অর্জন নাই। আমাদের বড় বড় ব্রিজ, বিল্ডিং ইত্যাদি এখনো বিদেশী প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হয়।
– আমাদের বাস-ট্রাক ড্রাইভাররা খেয়াল খুশি মতো গাড়ি চালায় আর মানুষ মারে?

এই লিস্ট এর অন্ত নেই। মনের সুখে যোগ করুন আপনার অভিযোগটি।

এবং এর প্রতিটির জন্যে আমরা নিয়ম করে বকাঝকা, গালাগাল করে যাচ্ছি অদক্ষ, অযোগ্য মানুষগুলোকে। আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের যে কী পরিমান গালি খেতে হয় সেটা ফেইসবুক, ব্লগিং না থাকলে মনে হয় আমার জানা হতো না!

৫। আমি ছাড়া আর সবাই খারাপ, অযোগ্য?

এই যে চারদিকে এতো খারাপ মানুষ, অযোগ্য মানুষের দল এরা কোথাকার মানুষ, কোন দেশের মানুষ?

এরাই কি “আমরা” নয়? এরা কি আমাদের পরিবার, স্বজন, বন্ধু, পরিচিত কেউ নয়?

আয়নার সামনে দাঁড়ালে যে মানুষটাকে দেখা যায় সে কতোটুকু ভালো? কতটুকু যোগ্য?

নিজের ভালোত্ব বাড়ানোর জন্যে জীবনে কী করেছি? দক্ষতা, যোগ্যতা বাড়ানোর জন্যে কী করেছি? দেশের ভালোর জন্যে কী করেছি? নাকি নিজেকে অযোগ্য রেখে দিয়ে দেশকে আশা করেছি যোগ্য হতে? দেশ কি পনের কোটি মানুষের বাইরের কিছু? পনের কোটি মানুষ যদি যোগ্য হয়ে না উঠে, তাহলে দেশ কিভাবে যোগ্য হবে?

৬। এই মৃত্য উপত্যকা আসলে আমি, আপনি, এবং আমাদের আগের প্রজন্মের তৈরি!

কিশোর এবং তরুণ বয়সে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল পড়ালেখা। এর সাথে খেলাধুলা আর কিছু সাংস্কৃতিক কাজে জড়িত হওয়া। আমি এর কোনোটাই ভালোভাবে করতে পারিনি। আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে মেরে আলসেমী করে আমার সময় নষ্ট করেছি। সেজন্যেই আজ আমার কাজে দক্ষতা আন্তর্জাতিক মানের না। আমাদের দেশ যে পিছিয়ে আছে অন্য অনেক দেশ থেকে সে ব্যাপারে আমি অবদান রাখছি।

আমার ধারণা একই কথা আপনার ক্ষেত্রেও সত্যি। সেটা না হলে আপনার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনি এখন আমাদের দেশের জন্যে কিছু করুন এবং আমাদেরকেও পথ দেখান।

আমাদের চেয়ে বড় দোষ আমাদের আগের প্রজন্মের। আমাদের বাবা-মা’র। আমি দুঃখিত আপনার অনুভুতিতে আঘাত লাগলে, কিন্তু আমাদের আগের প্রজন্ম আমাদেরকে একটা জঘন্য বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।

তারা আমাদের একটা স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়েছে সত্যি (সেজন্যে তাদের কাছে সীমাহীন কৃতজ্ঞতা), কিন্তু তারা আমাদের উপহার দিয়েছেন একটা দুর্নীতিতে শ্রেষ্ট দেশ। দেশের প্রতি মায়া-মমতাহীন একদল রাজনীতিবিদ। ছাত্র রাজনীতি নামক ভয়াবহ সন্ত্রাসী এবং পশ্চাদপদ একটা ব্যবস্থা যেটা আমাদের সমাজকে, দেশকে তিলতিল করে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

তারা আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেন নি। যখনি আমি একটা অযোগ্য বালক-বালিকা কিংবা কিশোর-কিশোরী দেখি, তখনি আমার সেই বালক-বালিকা কিংবা কিশোর-কিশোরীর বাবা-মা’র প্রতি এক ধরনের রাগ কাজ করে। বাবা-মা চাইলে সন্তানদের সঠিকভাবে বড় করে তোলা খুব কঠিন কিছু না। আমাদের সীমিত সম্পদ, কিন্তু এটা দিয়েই আমাদের শুরু করতে হবে। কোনো দেশই প্রথমের উন্নত হয়ে শুরু করেনি!

এই অযোগ্য আমি, আপনি, আর আমাদের আগের প্রজন্ম থেকে তৈরি হয়েছে আমাদের রাজনীতিবিদগন, আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা, আমাদের ফুটবলাররা, চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারা, ঘাতক বাস ড্রাইভার, খুনী র‍্যাব-পুলিশ।

৭। পরিবর্তন শুরু হতে হবে নিজের থেকে

যে দেশের স্বপ্ন দেখি আমরা (এবং প্রতিনিয়ত সেই স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ভুগি) সে দেশ পেতে হলে আগে নিজেকে ভালো, যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।

পনের কোটি মানুষের বেশির ভাগ মানুষ যেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলতে পারবে “আমি সত্যিকারভাবে একজন ভালো মানুষ, যোগ্য মানুষ, অন্তত পক্ষে সেরকম হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি” সেদিন শুধুমাত্র আমরা আমাদের স্বপ্নের দেশ পাবো। তার আগ পর্যন্ত কেবল “নিজে ভালো, অন্যরা খারাপ” বলে গলা ফাটিয়ে যাবো, কিংবা বিভিন্ন উন্নত দেশের এম্ব্যাসিতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কোনোমতে এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে পালানোর চেষ্টা করে যাবো।

সমালোচনা

সম্প্রতি আমেরিকান লেখক, দার্শনিক এলবার্ট হাবার্ড একটা দুর্দান্ত উদ্ধৃতি পড়লামঃ “To avoid criticism do nothing, say nothing, be nothing”. অর্থ্যাৎ, সমালোচনা এড়াতে চাইলে কিছু করো না, বলো না, হয়ো না। যার জীবনে কোনো অর্জন নেই, যে পৃথিবী ধ্বংস হলো কি গড়লো এটা নিয়ে মাথা ঘামায়না তাকে নিয়ে কেউ সমালোচনা করার তেমন কিছু খুঁজে পায়না। যখনি আপনি কিছু করতে যাবেন, কিছু একটা বলতে যাবেন, কিছু একটা হতে যাবেন, পৃথিবী দুইভাগ হয়ে যাবে। একদল আপনাকে প্রশংসা করবে, আপনি আরো এগিয়ে যান সেই কামনা করবে, আর আরেকদল আপনার মুন্ডুপাত করবে। জীবনের বাস্তবতায় স্বাগতম!

পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষটির বিরুদ্ধেও অনেক সমালোচনা হয়। সত্যিকথা বলতে কি, “সবচেয়ে ভালো মানুষ” নামে কিছুর আসলে অস্তিত্ব নেই। আপনার কাছে যিনি অনেক ভালো মানুষ, অনেক শ্রদ্ধার পাত্র, অন্যের কাছে তিনি হয়তো ততোটাই বাজে লোক।

আমরা মানুষেরা আমাদের পরিবেশের দ্বারা তৈরি। আমরা যে পরিবেশে বড় হয়েছি, আমাদের বাবা-মা আমাদের যে শিক্ষা আর মূল্যবোধ শিখিয়েছেন, আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যা শিখেছি, চারদিকের পরিচিত আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধব থেকে আমরা যে জ্ঞ্যান লাভ করেছি, বই-পত্র-টেলিভিশন-সিনেমা ইত্যাদি থেকে আমরা সংস্কৃতি-চেতনা শিখছি, সেসব ব্যবহার করে আমরা আমাদের চারপাশকে বিচার করি, মূল্যায়ন করি। এবং প্রত্যেক মানুষের বড় হয়ে উঠা, শিক্ষার বিষয়বস্তু একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন। ফেইসবুক, টুইটারের কল্যানে মানুষের “সামাজিক গ্রাফ” দেখা যায় এখন। এই সামাজিক গ্রাফ থেকেই মানুষ তার বিচার-বিবেচনা তৈরি করে, পৃথিবীকে দেখার লেন্স বানায়।

আমি অনেক মেধাবী এবং গুনী মানুষকে চিনি যারা শুধু উটকো সমালোচনার ভয়ে নিজের নিরাপদ বলয়ের বাইরে বের হননা। “কী দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে, ভালোই তো আছি” – এটা হচ্ছে তাদের চিন্তা। এবং তাদেরকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতির সাথে সাথে আমাদের সমালোচনার বারুদও অনেক তাড়াতাড়ি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপনি হয়তো কোনো গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্যে একটা স্কুল করে দিলেন। দুইটা পত্রিকায় আপনাকে নিয়ে বিশাল প্রশংসাসূচক লেখা ছাপা হতে না হতেই অন্য তিনটা পত্রিকায় আপনার নামে যাবতীয় কুৎসা ছড়ানো হবে। পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, কর্পোরেট শক্তির ইন্ধনে আপনি যে স্কুলের নাম করে তলে তলে বিশাল ষড়যন্ত্র করে বসে আছেন সেটা নিয়ে অনেক কেচ্ছা কাহিনী ছাপানো হবে। অথচ আপনি শুধু ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার একটা ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন, এই যা।

আমি যখন প্রথম বিদেশে পড়তে আসি তখন এখানকার একজন বাংলাদেশী অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন বাংলাদেশে একজন মানুষের ক্ষতি করা অনেক সহজ কিন্তু কারো উপকার করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। তাঁর কথাটি ভালো করে বুঝিনি তখন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কেনো তিনি ওরকম একটি কথা বলেছিলেন। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা চারদিকের নেগেটিভ জিনিসে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে এখন আর মানুষের ভালোত্বে বিশ্বাস করি না সহজে। কেউ যে বিনা কারণে ভালো হতে পারে, স্বার্থহীন হতে পারে এটা বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হয়।

আমি সবসময় যে উপমাটার কথা ভাবি আমাদের বিচার-বিবেচনা নিয়ে সেটা হলোঃ আমরা আমাদের চারপাশকে হয় গাফফার চৌধুরী কিংবা শফিক রেহমানের দৃষ্টিতে দেখি। এই দুইজন মেধাবী মানুষ বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের আইকন সমর্থক। “সূর্য পূর্বদিকে উঠে” এটা নিয়ে রচনা লিখতে দিলে এরা খুব সুন্দর করে প্রমান করতে পারবে সূর্য পূর্বদিকে উঠাটা কিভাবে হাসিনার/খালেদার কৃতিত্ব কিংবা আওয়ামীলীগ/বিএনপির ষড়যন্ত্র। কোনো কিছু সাদাকালো চোখে দেখার ক্ষমতা এরা হারিয়ে ফেলেছেন। স্পেইডকে স্পেইড বলার ক্ষমতা আর এদের নাই। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে আমাদেরও সবসময় একটা পক্ষ নিয়েই পৃথিবীটাকে দেখতে হবে। হয় আওয়ামীলীগ, না হয় বিএনপি, না হয় জামাত, না হয় সমাজতন্ত্র।

আমাদের একদল ডক্টর ইউনুসকে শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি তিনি মানুষের ভালো করতে চান। ভালো করতে পারছেন কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ সেটা আমরা বিশ্বাস করি। আবার আরেকদল বিশ্বাস করি তিনি পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, কর্পোরেটবাদী, সামন্ততান্ত্রিক বিশ্ব মোড়লদের প্রতিনিধি। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র্য দূর করার নামে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের কাছে পাচার করা। আমাদের একদল মানুষ জাফর ইকবাল স্যারের নামে পাগল, আবার আরেকদল তাঁকে ইসলাম এর শত্রু, আওয়ামীলীগের দালাল মনে করে। অনেকে প্রথম আলোকে একটা সৎ পত্রিকা মনে করি, অন্তত সৎ থাকার চেষ্টা করে বলে মনে করি। আরেকদল ভাবি প্রথম আলো সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার। একইভাবে বড় বড় বহুজাতিক কম্পানীগুলোকে আমরা মনে করি শয়তানের দোসর, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের গরীব মানুষদেরকএ শোষণ করে সব টাকা বিদেশে পাচার করা।

আমাদের অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয় আমেরিকা, ভারত এবং অন্যদের চক্রান্তের কথা ভেবে ভেবে। আজকে আমেরিকা যে এতো উন্নত হয়ে উঠেছে এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সব টাকা শোষণ করে হয়েছে। এবং অন্যনায় গরীব দেশেরও। আচ্ছা আমেরিকা না হয় বিশ্ব মোড়ল। সুইজারল্যান্ড এর কথা ধরি। কিংবা ফিনল্যান্ড। অথবা নিউজিল্যান্ড। এরা এতো উন্নত হয়েছে কোন দেশকে শোষণ করে? কখনোতো শুনিনি এই দেশগুলো অন্যে দেশকে মিয়ে মাথা ঘামাতে। কাউকে শোষণ না করে যে শুধুমাত্র একটা চমৎকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস, মানুষের ভালো কামনা করে যে উন্নত হওয়া যায় সেটা তো আমেরিকা আর ইংল্যান্ড কে বাদ দিয়ে বাদবাকী উন্নত দেশগুলোর দিইকে তাকালেই বুঝা যায়। জীবন যে কতো সুন্দর হতে পারে, জীবন-যাপন যে কতো আরামদায়ক হতে পারে আধুনিক সভতার কল্যানে সেটা এসব উন্নত দেশে গেলে বুঝা যায়। আমরা কবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নিয়ে বেহুদা চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশটাকে সেরকম উন্নত করতে পারবো?

আমরা কেনো উন্নত হতে পারছিনা? আমাদের কেনো মনে হয় চারদিকের সবাই খারাপ, সবাই ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী? আমি আমার সাম্প্রতিক একটা লেখায় বলেছিলামঃ

“যেসব মানুষের নিজের উপর শ্রদ্ধা কম তারা বেশি (কু)সংস্কারে ভোগে। অর্থাৎ যেসব মানুষ আসলে নিজের যোগ্যতা নিয়ে খুশি নয়, নিজের উপর নিজের খুব বেশি শ্রদ্ধা নাই, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে, তারা সাধারণত মানুষকে নিয়ে বেশি নেগেটিভ কথা বলে। অন্যের ভালো কিছু দেখলে তারা সহজে খুশি হতে পারেনা, তাদের প্রথম চিন্তাটি হয় নেগেটিভ। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতে পারেনা এরা।”

আমরা যদি বিশ্বাস করি ইউনুস খারাপ তাহলে কেনো আমরা নিজেরা একটা নতুন মডেলের প্রতিষ্ঠান গড়ে ভালো কাজটি করে দেখাইনা? প্রথম আলো খারাপ; ঠিক আছে, তাহলে ভালো পত্রিকা কোনটি? একটাও না? আপনি নিজে একটা পত্রিকা বানিয়ে দেখিয়ে দিন ভালো পত্রিকা কেমন হতে পারে। ফোন কম্পানীগুলো খারাপ? দেশের গরীব মানুষের টাকা চুষে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে? চলেন আমরা নতুন একটা ফোন কম্পানী বানাই। কিংবা আমাদের সরকারকে চাপ দেই যাতে এমন আইন তৈরি করে যেটা দিয়ে মানুষের স্বার্থ রক্ষা হবে আরো ভালো করে। হাজার হোক সরকার তো আমাদের, ওরা তো আর বিদেশী শক্তি নাই।

দুঃখজনকভাবে একই কথা খাটে আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আমরা সবাই (এই লেখকসহ) রাজনীতিবিদদের ঢালাও সমালোচনা করি, কিন্তু আমরা কেউই নিজেরা রাজনীতিতে জড়াতে চাইনা। হাসিনা-খালেদার হাজার দোষত্রুটি সত্ত্বেও ওরাই কিন্তু রাজনীতি নামের কষ্টকর পেশাটি করে যাচ্ছে, এবং আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের জন্যে মোটামুটি সন্তোষজনক একটা জিডিপি বৃদ্ধির হার বজায় রেখেছে গতো দুই দশক ধরে। আমরা আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ বানাতে চাই, কিন্তু রাজনীতিবিদ বানাতে চাইনা। মেধাবী ছেলেমেয়েরা যদি রাজনীতিতে না যায়, তাহলে ছাত্রদল-ছাত্রলীগের ছাত্ররাজনীতিবিদ নামের অর্ধশিক্ষিত ছাত্ররা রাজনীতিতে যেয়ে দেশের ভবিষ্যতের আরো বারোটা বাজাবে। আমি জানি রাজনীতিতে যোগ দেওয়া অনেক কঠিন, বর্তমান রাজনীতিবিদ এবং ছাত্ররাজনীতির গুন্ডারা এটাকে আরো কঠিন করে রেখেছে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। কিন্তু তাই বলে তো বসে থাকলে চলবেনা, একটা না একটা পথ বের করতেই হবে এটাকে সংশোধনের জন্যে। রাজনীতির বাইরে থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে এই ট্রেন্ড পরিবর্তন করার।

যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পৃথিবীতে “নিখুঁত” বলে কিছু নেই। মানুষও নিখুঁত হতে পারেনা। পরম শদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সাইদ স্যারকে নিয়েও কতো বাজে কথা শুনেছি। এবং এটা হবেই। এর একটা ভালো দিক হচ্ছে সমালোচনা আমাদেরকে, আমাদের কাজকে আরো শুদ্ধ করে। “নিখুঁতত্ত্ব” এর দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায় সমালোচনার মাধ্যমে। যতোদিন মানুষ থাকবে ততোদিন মানুষের ভিন্ন মত থাকবে। ঘটনাক্রমে এটা গণতন্ত্র নামক শাসন ব্যাবস্থার সৌন্দর্য্য! পৃথিবীর সব উন্নত দেশগুলোতে যে কার্যকর একটা গণতন্ত্র আছে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!

যারা সমালোচনার ভয়ে বসে না থেকে নিজের মনের কথা বলে ফেলে, দেশের জন্যে কিছু একটা করার চেষ্টা করে ফেলে, নিজে কিছু একটা হতে চেষ্টা করে তাদের নিয়ে প্রয়াত আমারিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট একটা যুগান্তকারী কথা বলেছিলেনঃ

“It’s not the critic who counts, not the man who points out how the strong man stumbled, or when the doer of deeds could have done better. The credit belongs to the man who is actually in the arena; whose face is marred by dust and sweat and blood; who strives valiantly; who errs and comes short again and again; who knows the great enthusiasms, the great devotions and spends himself in a worth cause; who at the best, knows in the end the triumph of high achievement; and who at the worst if he fails, at least fails while daring greatly, so that his place shall never be with those cold and timid souls who know neither victory nor defeat।”

অনুবাদঃ

যারা সমালোচনা করছে তারা গুরুত্মপূর্ণ না। যারা আঙ্গুল উঁচু করে দেখিয়ে দিচ্ছে শক্ত মানুষটি কিভাবে হোঁচট খাচ্ছে তারাও গুরুত্মপূর্ণ না। যারা বাইরে থেকে উপদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছে কিভাবে কাজটা আরো ভালোভাবে করা যেতো ওরাও গুরুত্মপূর্ণ না। সব কৃতিত্ব হচ্ছে তাঁর যিনি আসলে সত্যিকার মাঠে নেমে যুদ্ধ করছেন। যাঁর মুখ এবং দেহ ধূলা, ঘামে, এবং রক্তে রঞ্জিত। যিনি জীবন দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যিনি বারবার ভুল করছেন এবং জয়ের একেবারে শেষ মাথায় এসে পৌঁছাচ্ছেন। যিনি চরম উৎসাহ, আগ্রহ, সাধনা নিয়ে নিজেকে একটা অর্থপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করেছেন। যিনি বিজয়ী হওয়ার কৃতিত্বের কথা জানেন, কিংবা যদি জয়ী হতে নাও পারেন, অন্ততপক্ষে বীরের মতো চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অতএব, তাঁর স্থান কখনোই সেইসব ভীরু এবং দূর্বল মানুষের সাথে হবেনা যারা জয় কিংবা পরাজয় কোনোটার স্বাদ কখনো পায়নি।