Monthly Archives: September 2015

নীল তারা

blue-stars-1280x800

ছেলেটি মেয়েটিকে ডাকতো নীল তারা বলে।

এক অদ্ভুত কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর সম্পর্কের জালে জড়িয়ে ছিল ওরা দু’জন।

প্রথম যেদিন মেয়েটি ওদের বাসায় আসে, ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকাতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো কী যেন ঘটে গেলো ওর মনে। এরপর বেশ কয়েক মাস মেয়েটি ওদের বাসায় ছিল। সেই কয়েক মাসে ওরা একজন আরেকজনের অনেক কাছে চলে আসে। মেয়েটি ছেলেটির চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু ওদের মানসিক বয়স ছিল একেবারে সমান – একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বোঝার এবং ভালো লাগার জন্যে যে বয়সে থাকতে হয় ঠিক সে বয়সটি।

মেয়েটির প্রেম ছিল আরেকজনের  সাথে। সে প্রেমে কোন খুঁত ছিল না। ছিল না আবেগের কোনো ঘাটতি। কিন্তু ছেলেটির সাথে পরিচয় হবার পর তাকেও মেয়েটির ভালো লাগতে শুরু করে। সে ভালো লাগা শুধুই ভালো লাগা, ভালোবাসা বা প্রেম নয়। কিন্তু কখনো কখনো ভালো লাগার তীব্রতা ভালোবাসার তীব্রতার চেয়ে বেশি হয়ে যায়। ছেলেটির প্রতি মেয়েটির ভালো লাগা সেরকম তীব্র কিনা এই প্রশ্নের উত্তর মেয়েটি তার জীবনে কখনো খুঁজে পায়নি। কাকে বেশি ভালো লাগে – নিজের প্রেমিককে (পরবর্তীতে স্বামী) নাকি ছেলেটিকে – এ প্রশ্ন নিজেকে অসংখ্যবার করেও মেয়েটি কখনো কোনো উপসংহারে পৌঁছতে পারেনি।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত এসে চলে যায়; পৃথিবী তার আপন কক্ষপথে আর সূর্যের চারদিকে অবিরাম ঘুরতে থাকে। সেই ঋতু চক্রের ক্লান্তিহীন চলার মাঝে ছেলেটি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ও প্রেম শুরু করে এক সুন্দরী তরুণীর সাথে। এরপর এক মায়াময় হেমন্তের রাত্রিতে ছেলেটি তার সুন্দরী প্রেমিকাকে বিয়ে করে বউ হিসেবে ঘরে তুলে আনে। মেয়েটি অবশ্য এর অনেক আগেই বিয়ে করে তার প্রেমিক পুরুষকে। গত কয়েক বছরে ওদের মধ্যে যোগাযোগ অনেক কমে গিয়েছিল। নিজেদের সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় একে অপরকে খুব বেশি মিস করার সময়ই পায়নি।

নিজেদের জীবনে নিজ জীবন সঙ্গী নিয়ে ওরা মোটামুটি সুখেই ছিল। দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনের টুকটাক টানাপোড়ন ছাড়া ওদের ব্যস্ত সংসার জীবনে খুব বেশি অভিযোগ অনুযোগ ছিল না। কিন্তু ভাগ্য বিধাতার মনে হয় অন্য পরিকল্পনা ছিল!

চাকরির কারণে দুজনেই এক সময় একই শহরে এসে পড়ে। ওদের যোগাযোগটা তখন আবার শুরু হয় নতুন করে। তবে এবার ওদের দেখা-সাক্ষাৎ সব হয় পারিবারিকভাবে। দু’জনের দুই পরিবার আস্তে আস্তে খুব ঘনিষ্ট হয়ে আসে। সেই সাথে ফিরে আসে প্রথমবার দেখা হওয়ার সময়কার ভালোলাগা।

মেয়েটি বৃষ্টি ভালোবাসতো। এক অঝোর ধারার শ্রাবনের বিকেলে ছেলেটি একদিন এসেছিল মেয়েটির বাসায়। মেয়েটির স্বামী বাসায় ছিল না। বাচ্চারা ছিল ঘুমে। মেয়েটি সোফা থেকে উঠে যেয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়, বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে সেই একই প্রশ্ন, যেটা আগেও সে অসংখ্যবার জিজ্ঞেস করেছিল ছেলেটিকে – “তুমি নিশ্চয়ই আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে পুরোপুরি পরিষ্কার?” ছেলেটি সোফা থেকে উঠে এসে পেছন থেকে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটির কানে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। এরপর ফিসফিস করে বলে – “আমি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে পুরোপুরি পরিষ্কার। আমি আমার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসি। তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আমি অসম্ভব রেস্পেক্ট করি। তোমরা দুজনেই আমার এবং আমার স্ত্রীর খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু…”। ছেলেটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে যায়। “কিন্তু কী?” – মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে ছেলেটির গলা জড়িয়ে ধরে, দু’চোখ রাখে ছেলেটির দু’চোখে, আর ছেলেটি দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েটির কোমরে। ওরা দু’জনেই মোটামুটি আঁচ করতে পারে এরপর ছেলেটি কী বলবে। ছেলেটি বলে – “আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি, তুমি ভালোবাসো তোমার স্বামীকে। কিন্তু আমরা দু’জনেই জানি আমরা একজন আরেকজনের সোল-মেট। আমি তোমাকে যেরকম জানি বুঝি, তুমি আমাকে যেরকম জানো বুঝো, পৃথিবীর আর কেউই আমাদের সেরকম জানেনা, বুঝেনা।” ছেলেটি এক সেকেন্ডের জন্যে থামে। গভীর আদরে চুমু খায় মেয়েটির কপালে। বলে – “আমাদের পৃথিবীতে জীবন একটাই। কিন্তু স্রষ্টা যদি আর কোনো জন্ম আমাদের জন্যে রেখে থাকে তাহলে সে জন্মে তুমি হবা আমার, শুধুই আমার নীল তারা”।

এভাবে চলতে থাকে ওদের ভেতরের আর বাইরের জীবন। এরপর আরো অনেক শ্রাবণ এসে চলে যায়। আকাশ কালো করে মেঘ জমে, তারপর আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটি মনে মনে ভাবে “আচ্ছা, ও কি আমাকে মিস করছে?”

কিন্তু ভাগ্য বিধাতার এর পরের পরিকল্পনাটা ছিল বড়ই নিষ্ঠুর।

এক কঠিন অসুখ এসে বাসা বাঁধে মেয়েটির শরীরে। মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরের সেরা হাসপাতালে নেওয়া হয়। ছেলেটি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সিঙ্গাপুর যায়। হোটেল থেকে সে প্রতিদিন নিয়ম করে হাসপাতালে যায়। মাঝে মাঝে ছেলেটি যখন হাসপাতালে যায় তখন কেউ না থাকলে ছেলেটি মেয়েটিকে হাতে তুলে খাইয়ে দেয়, হাতে পায়ে হালকা মাসাজ করে দেয়। দেখতে দেখতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠে। ছেলেটি মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

এরপর ওরা আবার ফিরে যায় ওদের আগের জীবনে। যদিও বিভিন্ন কারণে ওদের আগের মতো আর দেখা হয়না, শুধু মাঝে মাঝে এসএমএস বা ফোনে দু’এক মিনিট কিছুটা কথা হতো। অবশ্য সেই দুই একটি এসএমএস কিংবা দুই এক মিনিট কথাতেই ওরা ওদের সব ভাব বিনিময় করে ফেলতে পারতো। মনে হয় ওদের একজনের মনের কথা আরেকজন ঠিকই টেলিপ্যাথি কিংবা অদৃশ্য ইথারে কান পেতে পড়ে নিতে পারে।

ছেলেটি প্রায়ই ভাবতো – পৃথিবীতে কি খুঁতহীন পারফেক্ট কিছু আছে? মেয়েটির প্রতি ওর যে ভালো লাগার  অনুভূতি, সেটা তো প্রায় পারফেক্ট। প্রকৃতি কি এই পারফেকশন মেনে নিতে পারবে?

প্রকৃতি আসলেই মেয়েটির প্রতি ছেলেটির এই অদ্ভুত সুন্দর ভালো লাগার অনুভূতি বেশিদিন সহ্য করলো না। কিছুদিন পর মেয়েটির সেই কঠিন অসুখ আবার ফিরে আসে। এবার দেখা গেল সেটা আরো ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে এসেছে। মেয়েটির স্বামী ওকে আবার সিঙ্গাপুরের সেই হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানকার সেরা ডাক্তাররা ওর চিকিৎসা করতে থাকে। কিন্তু ভাগ্য বিধাতা সম্ভবত পণ করে বসেছিল এবার যে কোনভাবেই মেয়েটিকে ভালো হতে দিবে না।

কয়েক সপ্তাহ জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি যুদ্ধ করে মেয়েটি আরেক অঝোর ধারার শ্রাবণের এক বিষণ্ণ বিকেল বেলা এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেয়।

মেয়েটির মৃত্যু ছেলেটির পৃথিবীকে পুরোপুরি উল্টেপাল্টে দেয়। কিন্তু ও সেটা কাউকে বলতে পারেনা, বুঝাতে পারেনা। পৃথিবীতে কেউ জানেনা ওদের কথা। জীবনের সবচেয়ে কষ্টের একটা সময় ওর শুধু অদৃশ্য অশ্রু  ঝরিয়ে পার করে দিতে হয়েছে। ওর নীল তারা আর নাই। ওর সব প্রশ্নের উত্তর যে দিতে পারতো সেই মানুষটি আর নাই। যার মুখ দেখলে ওর জীবনটাকে অনেক সুন্দর মনে হতো সেই মানুষটা আর নাই।

সেই মৃত্যুময় শ্রাবণের এক দিনে ছেলেটি অফিসের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পুরো শহরকে ধুয়েমুছে দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেটির মনে সারা পৃথিবীর সব কষ্ট এসে আটকে আছে। ছেলেটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে। আর কোনো দিন নীল তারার সাথে ওর বৃষ্টি দেখা হবেনা ভেবে বুকটা এক অসীম শূন্যতায় ভরে ওঠে। ও জানে ওর নীল তারা আজ আর এই শহরে নাই, এই বৃষ্টি শুধু মিছে মিছিই ঝরে পড়ছে আজ। নীল তারা আর কোনো দিন হাসবেনা ওর চোখে চোখ রেখে, হাতে হাত রেখে। আর কোনো দিন বলবেনা বৃষ্টি সে কতো ভালোবাসে।

নীল তারা আর নাই।

নীল তারা চলে গেছে।