Monthly Archives: June 2017

ভাগ্য

আমি এক সময় বিশ্বাস করতাম ভাগ্য বলে কিছু নাই, আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে তার প্রত্যেকটি ঘটনার জন্যেই শুধুমাত্র আমরাই দায়ী। জীবনে খুব ভালো করতে হলে আমাদেরকে জাস্ট সময় নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং এক সময় না এক সময় আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেয়ে যাবো।

সম্প্রতি ভাগ্য নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি জীবনে খুব ভালো করতে হলে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, কিন্তু মানুষের জীবনে ভাগ্যের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। আমি এখানে লটারি জেতা টাইপের ভাগ্যের কথা বলছিনা, আমি বলছি আমাদের জীবন-যাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ্য যেভাবে আমাদেরকে প্রভাবিত করে সেটার কথা। আমাদের জীবনের একটা বিরাট অংশের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই!

কারো জন্মের কথাই ধরুণ। কোন দেশে তার জন্ম হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। ২০১৫ সালের জাতিসঙ্ঘের হিসেবে সিয়েরা লিওনের শিশু মৃত্যুর হার শতকরা প্রায় দশ ভাগ। মানে জন্ম নেওয়া প্রতি একশ শিশুর মধ্যে দশটি শিশু তাদের প্রথম জন্মদিন পালন করার আগেই মারা যাবে! যেখানে উন্নত বিশ্বে প্রায় সব দেশেই এই হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তাহলে সিয়েরা লিওনের মতো দরিদ্র দেশগুলোর জন্মের সময় বা তার পরপরেই শিশুগুলোর মারা যাওয়ার এই দায় কার? বেঁচে থাকলে হয়তো ওরা বড় রাজনীতিবিদ হতে পারতো, বিজ্ঞানী হতে পারতো! কে জানে!

ভালো গ্রেইড পাওয়ার জন্যে ভালো করে লেখা পড়া করা যায়, ভালো খেলোয়াড় হতে হলে খুব ভালো কোচের অধীনে বছরের পর বছর অনুশীলন করা যায়, কিন্তু আমাদের জন্মের সময় কেমন পরিবারে জন্ম হবে আমাদের সেটা আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো? কারো বাবা-মা কেমন হবে, তারা কি নিজেদের মধ্যে কুৎসিতভাবে ঝগড়াঝাঁটি করবে নাকি চমৎকারভাবে তাদের সন্তানদেরকে মানুষ করবে? যে পরিবারে তার জন্ম হবে সেই পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছল্য না থাকলে তারা কিভাবে ছেলেমেয়েদের বড় করবে? পরিবারের সদস্যদের যদি সবচেয়ে বড় চিন্তা থাকে যে ঘরে চাল আসবে কিভাবে, কিংবা আগামী মাসের বাড়িভাড়া আসবে কোত্থেকে তাহলে সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরা ক্যালকুলাস এর অঙ্ক কিভাবে সল্ভ করবে? কিংবা কিভাবে ক্রিকেট বা ফুটবল বা দাবা খেলা প্র্যাকটিস করবে?

সন্তান যখন মায়ের পেটে থাকে তখন মা’র খাবার থেকে সন্তান পুষ্টি পায়, মা মানসিক চাপ বা রোগে থাকলে সেটা সন্তানকে প্রভাবিত করে, সন্তান বড় হলে তারও অপুষ্টি বা মানসিক সমস্যার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একটা শিশু মায়ের পেটে থাকা- কালীন সময়ে এভাবে মায়ের অসুখ বা অপুষ্টি নিজের ভেতরে নিয়ে নিলে বড় হয়ে যাওয়ার পর সেটা থেকে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।

আরেকটা গুরুত্মপূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে একজনের জন্ম কোন দেশে হচ্ছে সেই ব্যাপারটি। আমার জন্ম যদি বুরুন্ডি বা রোয়ান্ডায় হতো তাহলে এতদিনে হয়তো আমি শিশুযোদ্ধা হয়ে গৃহযুদ্ধে কয়েকশ মানুষকে মেরে ফেলতাম কিংবা নিজে আরেক শিশু-যোদ্ধার গুলিতে কিংবা রামদা’র কোপে মরে যেতাম। আবার একজনের জন্ম বাংলাদেশে হচ্ছে নাকি সুইজারল্যান্ডে হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে সে কী ধরণের সামাজিক নিয়ম-কানুনের মধ্যে বড় হবে, কী ধরণের রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বড়ো হবে, কতোটুকু দুর্নীতি-সন্ত্রাস দেখে বড় হবে। প্রত্যেক ধরণের পরিবেশের নিজস্ব প্রভাব আছে মানুষের বড় হওয়ার উপর।

দেশের উপর নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থা, নারীদের নিরাপত্তা এবং অধিকার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার, ইত্যাদি। একটা মেয়ে কি রাত দশ’টার সময় শিস দিতে দিতে বাসায় ফিরতে পারবে নাকি ফেরার পথে গুন্ডা-বদমাশ (কিংবা পুলিশ?) এর হাতে নিগৃহীত হবে সেটাও নির্ভর করে সে কোন দেশে জন্ম নিয়েছে তার উপর।

জন্ম ছাড়াও আরো অনেক ধরণের ভাগ্যের ব্যাপার আছে। অনেক মানুষ আছে যারা অল্প সময় ঘুমিয়ে সারাদিন ফুরফুরা মেজাজে কাজ করে যেতে পারে। আপনার আমার যেখানে আট-নয় ঘণ্টা ঘুমিয়েও সারাদিন গা ম্যাজ-ম্যাজ করে সেখানে এইসব মানুষেরা মাত্র পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ঘুমিয়েও অনায়াসে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। এই মানুষেরা জেনেটিক-ভাবেই কম ঘুমের জন্যে তৈরি হয়ে থাকে। বাড়তি সময়টা কাজে লাগিয়ে তারা আমাদের মতো আমজনতার চেয়ে অনেক এগিয়ে যেতে পারে!

অনেকে জন্ম নেয় একটা চমৎকার ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) নিয়ে। ঠান্ডা-সর্দি-জ্বর তাদের সহজে কাবু করতে পারেনা। আর যাদের এর উল্টোটা হয় তাদের প্রায় সারা বছরই সর্দি, কাশি, হাঁচি, ইত্যাদি লেগে থাকে; সামান্য ঠাণ্ডা লাগলে বা ধুলা লাগলে শরীর খারাপ হয়ে যায়।

মানুষের লম্বা হওয়াটাও একটা মোটামুটি ভাগ্যের (জেনেটিক্স) এর ব্যাপার। লম্বা মানুষেরা সাধারণত বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে লম্বা মানুষেরা সাধারণত খাটো মানুষদের থেকে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়। আর আত্মবিশ্বাস না থাকলে জীবনে উন্নতি করা প্রায় অসম্ভব!

রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে কতো মেয়ের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে কে জানে!

আরেকটা ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে একটা মানুষের জন্ম কোন সময়টাতে হয়েছে সেটার উপর। একটা মোটামুটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই –  আশি-নব্বই দশকের কমিপিউটার বিপ্লব, নব্বই-দুই হাজার দশকের ইন্টারনেট বিপ্লব, আর দুই হাজার দশ দশকের মোবাইল বিল্পব – এই সময়গুলোতে যারা তরুণ ছিলো এবং এই প্রযুক্তি-গুলো আয়ত্ব করেছে, তারা এখন অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। অন্যরা পরে এসে যতোই চেষ্টা করুক না কেন যারা ইতিমধ্যে এগিয়ে গিয়েছে তাদের ধরাটা এখন অনেক কঠিন হবে। প্রথম দলটি শুধুমাত্র তাদের জন্ম সময়ের কারণেই এই সুবিধাটা লাভ করেছে।

উপরে যে উদাহরণগুলোতে ভাগ্যের ব্যাপারটা মোটামুটি পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। কিন্তু ভাগ্য আরো সুক্ষ্মভাবেও কাজ করে থাকে!

ধরুণ আমাদের সাস্টের বা বুয়েটের একটা টিম এর সদস্যরা প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট এর জন্যে একেবারে কলেজ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। ভার্সিটির থার্ড/ফোর্থ ইয়ারে উঠতে উঠতে ওদের প্রায় চার-পাঁচ বছরের ভালো প্রোগ্রামিং অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। তো ধরুণ ওরা একটা অনলাইন কন্টেস্টে অংশ নিচ্ছে বুয়েট বা সাস্ট এর ল্যাব রুম থেকে। ওরা কন্টেস্টটা করছে পৃথিবীর সেরা প্রোগ্রামিং দলগুলের সাথে, যারা রাশিয়া, চায়না, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অংশ নিচ্ছে। যদি আমরা ধরেও নিই আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা অন্য দেশগুলোর বেশিরভাগের চেয়ে ভালো, আমাদের দেশের বিদ্যমান অন্য সব সমস্যার কারণে ওদের এই যোগ্যতা দিয়েও ওরা প্রত্যাশিত ফল নাও পেতে পারে। যেমন, ওরা যখন প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে অংশ নেওয়ার জন্যে বাসা থেকে রওয়ানা দিয়েছে, তখন ওদের অনেকেরই হয়তো গাড়ি থাকবে না। প্রচণ্ড কাঠফাটা রোদে ওরা হয়তো সিএনজি বা রিকশার জন্যে আধা ঘন্টা-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে এরপর রিকশা বা সিএনজি পাবে। এরপর প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে কন্টেস্ট ভেন্যুতে আসতে আসতে ওদের উপর এক ধরণের মনস্তাত্বিক চাপ (Stress) পড়ে যাবে। এখন ওদের যোগ্যতা যতোই ভালো হোক না কেন, এই অযাচিত স্ট্রেস এর কারণে ওদের ফলাফল স্বাভাবিক এর চেয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ইউরোপ আমেরিকার প্রতিযোগীরা হয়তো নিজস্ব গাড়ি বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ধরে গুন গুন গান গাইতে গাইতে তাদের ল্যাবে এসে কন্টেস্ট করছে!

এরকম পরোক্ষভাবে ভাগ্যের কাজ করার আরো উদাহরণ আছে। কিছু জিনিস সরাসরি বুঝা যায় না, কিন্তু খুবই সূক্ষ্মভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে।

ধরুণ বাংলাদেশের কোন একটা দল বিদেশে খেলতে গেছে। এই দলটি খুবই  ভালো খেলে, তাদের একাধিক বিদেশী কোচ আছে, খেলোয়াড়দের প্রত্যেকেই মাসে লাখ লাখ টাকা বেতন পায়। যেকোন খেলারই একটা বড় অংশ হচ্ছে মনস্তাত্বিক। আমাদের খেলোয়াড়রা তাদের খেলায় যথেষ্ট ভালো হলেও তাদের মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে তারা তাদের দক্ষতার কতোটুকু ঢেলে দিতে পারবে। আমাদের বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে তাদের মানসিক অবস্থা তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, কিংবা দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলী দ্বারা নেগেটিভভাবে প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি অন্য দেশের প্রতিযোগীদের চেয়ে। কোন খেলোয়াড়ের হয়তো মা’র শরীর খারাপ ছিল, হাসপাতালে নেওয়ার পর ধর্মঘটের কারণে ওর মা’র চিকিৎসা হচ্ছে না। আরেকজনের হয়তো ভাই অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীর হাতে পড়ে ছুরির আঘাত পেয়েছে। কিংবা পরিবারের কারো কিছু না হোক, দেশে হরতালকারীরা কোথাও জ্বালাও-পোড়াও করে হয়তো কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে। এ ধরণের যেকোন নেগেটিভ খবরে আমাদের খেলোয়াড়দের মানসিক প্রস্তুতি পভাবিত হতে বাধ্য। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা হয়তো আগের দিন তাদের গার্লফ্রেন্ডদের সাথে সারা বিকাল আর সন্ধ্যা ঘোরাঘুরি করে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে হোটেলে ফিরে এসেছে!

আমাদের মা-বাবা’রা সারা জীবন মেয়েদের সাথে কথা বলাটা বারণ করে এসে বিয়ের বয়স হলে বলে “কিরে তুই মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারিস না কেন?” সমাজে ছেলে-মেয়েদের মেলা-মেশার মধ্যে কঠোর কারফিউ জারি থাকার ফলে আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিপরীত লিঙের মানুষের মনস্তত্ব বোঝাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মাথা উঁচু করে পরিষ্কার গলায় কথা বলাটা খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয়না। সব সময় একটা পুতু পুতু শ্রদ্ধা-শ্রদ্ধা ভাব না থাকলে মনে করা হয় বেয়াদবি করছে। এ কারণেই বিদেশে এসে আমারা টেকনিক্যালি ভালো করলেও প্রতিষ্ঠানের উপরের লেভেল উঠতে পারি না। দশজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে পরিষ্কারভাবে কথা বলতে গেলে আমাদের গলা শুকিয়ে যায়। বাংলাদেশের রেডিও-টিভিতে কারো সাক্ষাৎকার নিলে খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথাগুলো শুনবেন। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রতি দশজনের মধ্যে নয় জন মানুষই একটা বাক্য ঠিকভাবে সুন্দর করে পরিষ্কারভাবে বলতে পারে না। উচ্চারণের কথা বাদই  দিলাম, মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যে যেসব শব্দ ব্যবহার করা দরকার সেগুলোই আমরা অন্যের সামনে বলার সময় ভুলে যাই! রাজনীতিবিদ বলেন, সরকারী কর্মকর্তা বলেন, রাস্তার পথচারী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বলেন – সবারই এই অবস্থা।

আমি আমাদের সমালোচনার জন্যে এই কথাগুলো বলছিনা। আমি বলছি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থায় জন্ম নেওয়ার এবং বড় হওয়ার কারণে আমরা অনেক কিছুতে ভয়াবহ রকমের পিছিয়ে আছি। এবং অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবন চেষ্টা করেও অনেক দোষ-ত্রুটি থেকে আর বের হওয়া যায় না।

***

উপরের আলোচনার পর মনে হতে পারে বুঝি আমাদের কোন আশা নাই। জন্মের স্থানের কারণে আমরা বুঝি সারা জীবনের জন্যে পিছিয়ে গেলাম!

না, জন্মের কারণে আমাদের সারা জীবনের জন্যে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেই সম্ভাবনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জীবনে সফলও হওয়া যায়! জীবনে ভাগ্যের প্রভাব আছে – খুব বেশিই আছে – কিন্তু জীবনে কঠোর পরিশ্রমের প্রভাবও  আছে। এবং খুব বেশি রকমই আছে।

আগামী পর্বে সেটা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা থাকলো।