Category Archives: Miscellaneous

ভাগ্য

আমি এক সময় বিশ্বাস করতাম ভাগ্য বলে কিছু নাই, আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে তার প্রত্যেকটি ঘটনার জন্যেই শুধুমাত্র আমরাই দায়ী। জীবনে খুব ভালো করতে হলে আমাদেরকে জাস্ট সময় নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং এক সময় না এক সময় আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেয়ে যাবো।

সম্প্রতি ভাগ্য নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি জীবনে খুব ভালো করতে হলে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, কিন্তু মানুষের জীবনে ভাগ্যের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। আমি এখানে লটারি জেতা টাইপের ভাগ্যের কথা বলছিনা, আমি বলছি আমাদের জীবন-যাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ্য যেভাবে আমাদেরকে প্রভাবিত করে সেটার কথা। আমাদের জীবনের একটা বিরাট অংশের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই!

কারো জন্মের কথাই ধরুণ। কোন দেশে তার জন্ম হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। ২০১৫ সালের জাতিসঙ্ঘের হিসেবে সিয়েরা লিওনের শিশু মৃত্যুর হার শতকরা প্রায় দশ ভাগ। মানে জন্ম নেওয়া প্রতি একশ শিশুর মধ্যে দশটি শিশু তাদের প্রথম জন্মদিন পালন করার আগেই মারা যাবে! যেখানে উন্নত বিশ্বে প্রায় সব দেশেই এই হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তাহলে সিয়েরা লিওনের মতো দরিদ্র দেশগুলোর জন্মের সময় বা তার পরপরেই শিশুগুলোর মারা যাওয়ার এই দায় কার? বেঁচে থাকলে হয়তো ওরা বড় রাজনীতিবিদ হতে পারতো, বিজ্ঞানী হতে পারতো! কে জানে!

ভালো গ্রেইড পাওয়ার জন্যে ভালো করে লেখা পড়া করা যায়, ভালো খেলোয়াড় হতে হলে খুব ভালো কোচের অধীনে বছরের পর বছর অনুশীলন করা যায়, কিন্তু আমাদের জন্মের সময় কেমন পরিবারে জন্ম হবে আমাদের সেটা আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো? কারো বাবা-মা কেমন হবে, তারা কি নিজেদের মধ্যে কুৎসিতভাবে ঝগড়াঝাঁটি করবে নাকি চমৎকারভাবে তাদের সন্তানদেরকে মানুষ করবে? যে পরিবারে তার জন্ম হবে সেই পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছল্য না থাকলে তারা কিভাবে ছেলেমেয়েদের বড় করবে? পরিবারের সদস্যদের যদি সবচেয়ে বড় চিন্তা থাকে যে ঘরে চাল আসবে কিভাবে, কিংবা আগামী মাসের বাড়িভাড়া আসবে কোত্থেকে তাহলে সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরা ক্যালকুলাস এর অঙ্ক কিভাবে সল্ভ করবে? কিংবা কিভাবে ক্রিকেট বা ফুটবল বা দাবা খেলা প্র্যাকটিস করবে?

সন্তান যখন মায়ের পেটে থাকে তখন মা’র খাবার থেকে সন্তান পুষ্টি পায়, মা মানসিক চাপ বা রোগে থাকলে সেটা সন্তানকে প্রভাবিত করে, সন্তান বড় হলে তারও অপুষ্টি বা মানসিক সমস্যার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একটা শিশু মায়ের পেটে থাকা- কালীন সময়ে এভাবে মায়ের অসুখ বা অপুষ্টি নিজের ভেতরে নিয়ে নিলে বড় হয়ে যাওয়ার পর সেটা থেকে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।

আরেকটা গুরুত্মপূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে একজনের জন্ম কোন দেশে হচ্ছে সেই ব্যাপারটি। আমার জন্ম যদি বুরুন্ডি বা রোয়ান্ডায় হতো তাহলে এতদিনে হয়তো আমি শিশুযোদ্ধা হয়ে গৃহযুদ্ধে কয়েকশ মানুষকে মেরে ফেলতাম কিংবা নিজে আরেক শিশু-যোদ্ধার গুলিতে কিংবা রামদা’র কোপে মরে যেতাম। আবার একজনের জন্ম বাংলাদেশে হচ্ছে নাকি সুইজারল্যান্ডে হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে সে কী ধরণের সামাজিক নিয়ম-কানুনের মধ্যে বড় হবে, কী ধরণের রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বড়ো হবে, কতোটুকু দুর্নীতি-সন্ত্রাস দেখে বড় হবে। প্রত্যেক ধরণের পরিবেশের নিজস্ব প্রভাব আছে মানুষের বড় হওয়ার উপর।

দেশের উপর নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থা, নারীদের নিরাপত্তা এবং অধিকার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার, ইত্যাদি। একটা মেয়ে কি রাত দশ’টার সময় শিস দিতে দিতে বাসায় ফিরতে পারবে নাকি ফেরার পথে গুন্ডা-বদমাশ (কিংবা পুলিশ?) এর হাতে নিগৃহীত হবে সেটাও নির্ভর করে সে কোন দেশে জন্ম নিয়েছে তার উপর।

জন্ম ছাড়াও আরো অনেক ধরণের ভাগ্যের ব্যাপার আছে। অনেক মানুষ আছে যারা অল্প সময় ঘুমিয়ে সারাদিন ফুরফুরা মেজাজে কাজ করে যেতে পারে। আপনার আমার যেখানে আট-নয় ঘণ্টা ঘুমিয়েও সারাদিন গা ম্যাজ-ম্যাজ করে সেখানে এইসব মানুষেরা মাত্র পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ঘুমিয়েও অনায়াসে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। এই মানুষেরা জেনেটিক-ভাবেই কম ঘুমের জন্যে তৈরি হয়ে থাকে। বাড়তি সময়টা কাজে লাগিয়ে তারা আমাদের মতো আমজনতার চেয়ে অনেক এগিয়ে যেতে পারে!

অনেকে জন্ম নেয় একটা চমৎকার ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) নিয়ে। ঠান্ডা-সর্দি-জ্বর তাদের সহজে কাবু করতে পারেনা। আর যাদের এর উল্টোটা হয় তাদের প্রায় সারা বছরই সর্দি, কাশি, হাঁচি, ইত্যাদি লেগে থাকে; সামান্য ঠাণ্ডা লাগলে বা ধুলা লাগলে শরীর খারাপ হয়ে যায়।

মানুষের লম্বা হওয়াটাও একটা মোটামুটি ভাগ্যের (জেনেটিক্স) এর ব্যাপার। লম্বা মানুষেরা সাধারণত বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে লম্বা মানুষেরা সাধারণত খাটো মানুষদের থেকে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়। আর আত্মবিশ্বাস না থাকলে জীবনে উন্নতি করা প্রায় অসম্ভব!

রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে কতো মেয়ের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে কে জানে!

আরেকটা ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে একটা মানুষের জন্ম কোন সময়টাতে হয়েছে সেটার উপর। একটা মোটামুটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই –  আশি-নব্বই দশকের কমিপিউটার বিপ্লব, নব্বই-দুই হাজার দশকের ইন্টারনেট বিপ্লব, আর দুই হাজার দশ দশকের মোবাইল বিল্পব – এই সময়গুলোতে যারা তরুণ ছিলো এবং এই প্রযুক্তি-গুলো আয়ত্ব করেছে, তারা এখন অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। অন্যরা পরে এসে যতোই চেষ্টা করুক না কেন যারা ইতিমধ্যে এগিয়ে গিয়েছে তাদের ধরাটা এখন অনেক কঠিন হবে। প্রথম দলটি শুধুমাত্র তাদের জন্ম সময়ের কারণেই এই সুবিধাটা লাভ করেছে।

উপরে যে উদাহরণগুলোতে ভাগ্যের ব্যাপারটা মোটামুটি পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। কিন্তু ভাগ্য আরো সুক্ষ্মভাবেও কাজ করে থাকে!

ধরুণ আমাদের সাস্টের বা বুয়েটের একটা টিম এর সদস্যরা প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট এর জন্যে একেবারে কলেজ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। ভার্সিটির থার্ড/ফোর্থ ইয়ারে উঠতে উঠতে ওদের প্রায় চার-পাঁচ বছরের ভালো প্রোগ্রামিং অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। তো ধরুণ ওরা একটা অনলাইন কন্টেস্টে অংশ নিচ্ছে বুয়েট বা সাস্ট এর ল্যাব রুম থেকে। ওরা কন্টেস্টটা করছে পৃথিবীর সেরা প্রোগ্রামিং দলগুলের সাথে, যারা রাশিয়া, চায়না, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অংশ নিচ্ছে। যদি আমরা ধরেও নিই আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা অন্য দেশগুলোর বেশিরভাগের চেয়ে ভালো, আমাদের দেশের বিদ্যমান অন্য সব সমস্যার কারণে ওদের এই যোগ্যতা দিয়েও ওরা প্রত্যাশিত ফল নাও পেতে পারে। যেমন, ওরা যখন প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে অংশ নেওয়ার জন্যে বাসা থেকে রওয়ানা দিয়েছে, তখন ওদের অনেকেরই হয়তো গাড়ি থাকবে না। প্রচণ্ড কাঠফাটা রোদে ওরা হয়তো সিএনজি বা রিকশার জন্যে আধা ঘন্টা-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে এরপর রিকশা বা সিএনজি পাবে। এরপর প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে কন্টেস্ট ভেন্যুতে আসতে আসতে ওদের উপর এক ধরণের মনস্তাত্বিক চাপ (Stress) পড়ে যাবে। এখন ওদের যোগ্যতা যতোই ভালো হোক না কেন, এই অযাচিত স্ট্রেস এর কারণে ওদের ফলাফল স্বাভাবিক এর চেয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ইউরোপ আমেরিকার প্রতিযোগীরা হয়তো নিজস্ব গাড়ি বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ধরে গুন গুন গান গাইতে গাইতে তাদের ল্যাবে এসে কন্টেস্ট করছে!

এরকম পরোক্ষভাবে ভাগ্যের কাজ করার আরো উদাহরণ আছে। কিছু জিনিস সরাসরি বুঝা যায় না, কিন্তু খুবই সূক্ষ্মভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে।

ধরুণ বাংলাদেশের কোন একটা দল বিদেশে খেলতে গেছে। এই দলটি খুবই  ভালো খেলে, তাদের একাধিক বিদেশী কোচ আছে, খেলোয়াড়দের প্রত্যেকেই মাসে লাখ লাখ টাকা বেতন পায়। যেকোন খেলারই একটা বড় অংশ হচ্ছে মনস্তাত্বিক। আমাদের খেলোয়াড়রা তাদের খেলায় যথেষ্ট ভালো হলেও তাদের মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে তারা তাদের দক্ষতার কতোটুকু ঢেলে দিতে পারবে। আমাদের বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে তাদের মানসিক অবস্থা তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, কিংবা দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলী দ্বারা নেগেটিভভাবে প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি অন্য দেশের প্রতিযোগীদের চেয়ে। কোন খেলোয়াড়ের হয়তো মা’র শরীর খারাপ ছিল, হাসপাতালে নেওয়ার পর ধর্মঘটের কারণে ওর মা’র চিকিৎসা হচ্ছে না। আরেকজনের হয়তো ভাই অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীর হাতে পড়ে ছুরির আঘাত পেয়েছে। কিংবা পরিবারের কারো কিছু না হোক, দেশে হরতালকারীরা কোথাও জ্বালাও-পোড়াও করে হয়তো কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে। এ ধরণের যেকোন নেগেটিভ খবরে আমাদের খেলোয়াড়দের মানসিক প্রস্তুতি পভাবিত হতে বাধ্য। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা হয়তো আগের দিন তাদের গার্লফ্রেন্ডদের সাথে সারা বিকাল আর সন্ধ্যা ঘোরাঘুরি করে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে হোটেলে ফিরে এসেছে!

আমাদের মা-বাবা’রা সারা জীবন মেয়েদের সাথে কথা বলাটা বারণ করে এসে বিয়ের বয়স হলে বলে “কিরে তুই মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারিস না কেন?” সমাজে ছেলে-মেয়েদের মেলা-মেশার মধ্যে কঠোর কারফিউ জারি থাকার ফলে আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিপরীত লিঙের মানুষের মনস্তত্ব বোঝাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মাথা উঁচু করে পরিষ্কার গলায় কথা বলাটা খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয়না। সব সময় একটা পুতু পুতু শ্রদ্ধা-শ্রদ্ধা ভাব না থাকলে মনে করা হয় বেয়াদবি করছে। এ কারণেই বিদেশে এসে আমারা টেকনিক্যালি ভালো করলেও প্রতিষ্ঠানের উপরের লেভেল উঠতে পারি না। দশজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে পরিষ্কারভাবে কথা বলতে গেলে আমাদের গলা শুকিয়ে যায়। বাংলাদেশের রেডিও-টিভিতে কারো সাক্ষাৎকার নিলে খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথাগুলো শুনবেন। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রতি দশজনের মধ্যে নয় জন মানুষই একটা বাক্য ঠিকভাবে সুন্দর করে পরিষ্কারভাবে বলতে পারে না। উচ্চারণের কথা বাদই  দিলাম, মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যে যেসব শব্দ ব্যবহার করা দরকার সেগুলোই আমরা অন্যের সামনে বলার সময় ভুলে যাই! রাজনীতিবিদ বলেন, সরকারী কর্মকর্তা বলেন, রাস্তার পথচারী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বলেন – সবারই এই অবস্থা।

আমি আমাদের সমালোচনার জন্যে এই কথাগুলো বলছিনা। আমি বলছি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থায় জন্ম নেওয়ার এবং বড় হওয়ার কারণে আমরা অনেক কিছুতে ভয়াবহ রকমের পিছিয়ে আছি। এবং অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবন চেষ্টা করেও অনেক দোষ-ত্রুটি থেকে আর বের হওয়া যায় না।

***

উপরের আলোচনার পর মনে হতে পারে বুঝি আমাদের কোন আশা নাই। জন্মের স্থানের কারণে আমরা বুঝি সারা জীবনের জন্যে পিছিয়ে গেলাম!

না, জন্মের কারণে আমাদের সারা জীবনের জন্যে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেই সম্ভাবনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জীবনে সফলও হওয়া যায়! জীবনে ভাগ্যের প্রভাব আছে – খুব বেশিই আছে – কিন্তু জীবনে কঠোর পরিশ্রমের প্রভাবও  আছে। এবং খুব বেশি রকমই আছে।

আগামী পর্বে সেটা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা থাকলো।

কাছের মানুষগুলো

আমেরিকান লেখক এবং মোটিভেশনাল বক্তা জিম রন (http://en.wikipedia.org/wiki/Jim_Rohn) একটা চমৎকার কথা বলেছিলেনঃ “যে পাঁচ জন মানুষের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটান আপনি সেই পাঁচজন মানুষের গড় (You are the average of the five people you spend the most time with.)”। এর মানে হচ্ছে আপনার বুদ্ধি হচ্ছে আপনার সবচেয়ে কাছের পাঁচ জন মানুষের গড় বুদ্ধির সমান। কথাটার মানে অবশ্য শুধু বুদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় – মানুষের চিন্তা-ভাবনার অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই কথাটা খাটে (যেমন রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি ব্যাপারে আমরা কাছাকাছি ভাবনার মানুষের সাথেই বেশি মিশে – আওয়ামীলীগ-মনা মানুষ আওয়ামীলীগারদের সাথে মিশে বেশি, বিএনপি-মনারা বিএনপি সমর্থকদের সাথে মিশে বেশি, রাজাকার এর ছানারা অন্য রাজাকার ছানাদের সাথে বেশি মিশে, হেফাজতপন্থীরা অন্য তালেবানী কাঠমোল্লাদের সাথে মিশে, ইত্যাদি ইত্যাদি)।

কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার দরকার নেই, তবে এটা বাস্তবতার প্রায় কাছাকাছি একটা সত্যি কথা! আমরা যাদের সাথে আমাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটাই – আমাদের পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, অফিসের সহকর্মী – তাদের দ্বারা আমরা সব সময়ই প্রভাবিত হতে থাকি। যার সাথে যতো বেশি সময় কাটাবো তার দ্বারা ততো বেশি প্রভাবিত হবো। প্রভাব অবশ্য উভয় দিকেই যায় – আপনি প্রভাবিত হওয়ার পাশাপাশি আপনিও অন্যজনকে প্রভাবিত করবেন। তবে যার ব্যক্তিত্ব বেশি দৃঢ় তিনি বেশি প্রভাবিত করতে পারেন অন্যদেরকে।

এই কারণে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিখ্যাত প্রযুক্তি কম্পানী, সিলিকন ভ্যালী ইত্যাদি জায়গায় বুদ্ধিমান, সৃজনশীল মানুষের আনাগোনা বেশি। একবার কোনো কারণে স্মার্ট, ট্যালেন্টেড মানুষের সমাগম শুরু হলে সেখানে তাদের কারণে আরো বেশি স্মার্ট এবং ট্যালেন্টেড মানুষের আসা শুরু হয়। এইভাবে একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সিলিকন ভ্যালী’র মতো জায়গা গড়ে উঠে।

গুগল, ফেইসবুকের মতো বড় বড় টেক কম্পানীগুলোর নতুন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার নেওয়ার সময় একটা লক্ষ্য থাকে নতুন ইঞ্জিনিয়ারের মেধা এবং দক্ষতা যাতে কম্পানীর গড় মেধা এবং দক্ষতার চেয়ে বেশি হয়। এভাবে এক এক জন নতুন ইঞ্জিনিয়ার নেওয়ার মাধ্যমে কম্পানীর ওভারঅল মেধা এবং দক্ষতা বাড়তে থাকে।

আমরা মানুষেরা সাধারণত প্রশংসার কাঙ্গাল (ফেইসবুকের লাইক বাটন উঠে গেলে আমাদের স্ট্যাটাসের সংখ্যা দশ ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে বলে আমার ধারণা!)। এটা দোষের কিছু নয় – প্রশংসা আমাদেরকে ভালো কিছু করতে উৎসাহিত করে। কিন্তু প্রশংসার পাশাপাশি আমাদেরকে সমালোচনা গ্রহণ করার জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু আমরা প্রশংসার জন্যে যতোটা উদগ্রীব সমালোচনা শোনারা জন্যে আমরা প্রায়ই ততোটা প্রস্তুত থাকিনা। কিন্তু আমাদের বুদ্ধি, মেধা, এবং সৃজনশীলতার উন্নতি ঘটাতে হলে প্রশংসার চেয়ে সমালোচনা (গঠনমূলক সমালোচনা – নির্বিচার গালাগালি নয়!) বেশি জরুরী। আমরা যখন আমাদেরকে কম চিন্তাশীল, গাধা টাইপের মানুষ দিয়ে ঘিরে রাখি তখন আমরা প্রচুর প্রশংসা শুনতে পাই। কিন্তু আমরা যতোই মেধাবী, স্মার্ট, এবং সৃজনশীল মানুষ দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখবো ততোই আমাদের চিন্তার এবং কাজের সমালোচনা বাড়তে থাকবে। এবং এই সমালোচনার মাধ্যমেই আমাদের চিন্তা এবং কাজের মান আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। আর মানুষ হিসেবেও আমরা চমৎকার মানুষ হয়ে উঠতে থাকবো।

কেউ এক গাদা প্রশংসা করলেই সে আমার খুব ভালো বন্ধু, আর কেউ আমার কোনো একটা ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিলে সে আমার বন্ধু নয় – এই ধরণের সস্তা টাইপের চিন্তা করলে কোনো দিন নিজের ব্যক্তিগত উন্নতি সাধন করা যাবে না।

কাছের প্রিয় মানুষগুলোর ভালো হওয়া জরুরী, স্মার্ট এবং সৃজনশীল হলে আরো ভালো। কিন্তু আপনি যদি শুধু নিজের গুনগান শোনার জন্যে তোষামোদ টাইপের মানুষ দিয়ে আপনার চারপাশ ভরে রাখেন (আমাদের অনেক নেতা/নেত্রীর মতো!) তাহলে আপনি যে মানুষ হিসেবে খুব ভালো, চমৎকার, দক্ষ একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত!

অপরাজিত – ২

Boat_in_river,_Bangladesh

Image source: http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/6/66/Boat_in_river%2C_Bangladesh.jpg

(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর “অপরাজিত” উপন্যাস থেকে নেওয়া)

ইছামতী এই চঞ্চল জীবনধারার প্রতীক। ওর দু’পাড় ভরিয়া প্রতি চৈত্র বৈশাখে কত বনকুসুম, গাছপালা, পাখি-পাখালি, গাঁয়ে গাঁয়ে গ্রামের ঘাট – শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া কত ফুল ঝরিয়া পড়ে, কত পাখির দল আসে যায়, ধারে ধারে কত জেলেরা জাল ফেলে, তীরবর্তী গৃহস্তবাড়িতে হাসি-কান্নার লীলাখেলা হয়, কত গৃহস্ত আসে, কত গৃহস্ত যায় – কত হাসিমুখ শিশু মায়ের সঙ্গে নাহিতে নামে, আবার বৃদ্ধাবস্থায় তাহাদের নশ্বর দেহের রেণু কলস্বনা ইছামতীর স্রোতোজলে ভাসিয়া যায় – এমন কত মা, কত ছেলেমেয়ে, তরুণতরুণী মহাকালের বীথিপথে আসে যায় – অথচ নদী দেখায় শান্ত, স্নিগ্ধ, ঘরোয়া, নিরীহ…

আজকাল নির্জনে বসিলেই তাহার মনে হয়, এই পৃথিবীর একটা আধ্যাত্মিক রুপ আছে, এর ফুলফল, আলোছায়ার মধ্যে জন্মগ্রহণ করার দরুণ এবং শৈশব হইতে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার দরুণ এর প্রকৃত রুপটি আমাদের চোখে পড়ে না। এ আমাদের দর্শন ও শ্রবণগ্রাহ্য জিনিসে গড়া হইলেও আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও ঘোর রহস্যময়, এর প্রতি রেণু যে  অসীম জটিলতায় আচ্ছন্ন – যা কিনা মানুষের বুদ্ধি ও কল্পনার অতীত, এ সত্যটা হঠাৎ চোখে পড়ে না। যেমন সাহেব বন্ধুটি বলিত, “ভারতবর্ষের একটা রুপ আছে, সে তোমরা জান না। তোমরা এখানে জন্মেছ কিনা, অতি পরিচয়ের দোষে সে চোখ ফোটে নি তোমাদের।”

আকাশের রঙ আর এক রকম – দূরের সে গহন হিরাকসের সমুদ্র ঈষৎ কৃষ্ণাভ হইয়া উঠিয়াছে – তার তলায় সারা সবুজ মাঠটা, মাধবপুরের বাঁশবনটা কি অপূর্ব, অদ্ভুত, অপার্থিব ধরনের ছবি ফুটাইয়া তুলিয়াছে!… ও যেন পরিচিত পৃথিবীটা নয়, অন্য কোনো অজানা জগতের কোনো অজ্ঞাত দেবলোকের…

প্রকৃতির একটা যেন নিজস্ব ভাষা আছে। অপু দেখিয়াছে, কতদিন বক্রতোয়ার উপল-ছাওয়া-তটে শাল ঝাড়ের নিচে ঠিক দুপুরে বসিয়া – দূরে নীল আকাশের পটভূমিতে একটা পত্রশূন্য প্রকান্ড কি গাছ – সেদিকে চাহিলেই এমন সব কথা মনে আসিত যা অন্য সময় আসার কল্পনাও করিতে পারিত না – পাহাড়ের নিচে বনফলের জঙ্গলেরও একটা কি বলিবার ছিল যেন। এই ভাষাটা ছবির ভাষা – প্রকৃতি এই ছবির ভাষায় কথা বলেন – এখানেও সে দেখিল গাছপালায়, উইঢিপির পাশে শুকনো খড়ের ঝোপে, দূরের বাঁশবনের সারিতে – সেই সব কথাই বলে – সেই সব ভাবই মনে আনে। প্রকৃতির এই ছবির ভাষাটা সে বোঝে। তাই নির্জন মাঠে, প্রান্তরে, বনের ধারে একা বেড়াইয়া সে যত প্রেরণা পায় – যে পুলক অনুভব করে তা অপূর্ব – সত্যিকার Joy of Life – পায়ের তলার শুকনো লতা-কাটি, দেয়াড়ের চরে রাঙ্গা-রোদ-মাখানো কষাড় ঝোপ, আকন্দের বন, ঘেঁটুবন – তার আত্মাকে এরা ধ্যানের খোরাক যোগায়, এ যেন অদৃশ্য স্বাতী নক্ষত্রের বারি, তারই প্রাণ মুক্তার দানা বাঁধে।

সন্ধার পুরবী কি গৌরীরাগিণীর মতো বিষাদ-ভরা আনন্দ, নির্লিপ্ত ও নির্বিকার – বহুদূরের ওই নীল কৃষ্ণাভ মেঘরাশি, ঘন নীল, নিথর, গহন আকাশটা মনে যে ছবি আঁকে, যে চিন্তা যোগায়, তার গতি গোমুখী-গঙ্গার মতো অনন্তের দিকে, সে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কথা বলে, মৃত্যুপারের দেশের কথা কয়, ভালবাসা-বেদনা-ভালবাসিয়া হারানো – বহুদূরের এক প্রীতিভরা পুনর্জন্মের বাণী…

এইসব শান্ত সন্ধ্যায় ইছামতীর তীরের মাঠে বসিলেই রক্তমেঘস্তুপ ও নীলাকাশের দিকে চাহিয়া চারিপাশের সেই অনন্ত বিশ্বের কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে বাল্যে এই কাঁটাভরা সাঁইবাবলার ছায়ায় বসিয়া মাছ ধরিতে ধরিতে সে দূর দেশের স্বপ্ন দেখিত – আজকাল চেতনা তাহার বাল্যের সে ক্ষুদ্র গন্ডি পার হইয়া ক্রমেই দূরে আলোকের পাখায় চলিয়াছে – এই ভাবিয়া এক এক সময় সে আনন্দ পায় – কোথাও না যাক – যে বিশ্বের সে একজন নাগরিক, তা ক্ষুদ্র, দীন বিশ্ব নয়। লক্ষ কোটি আলোক-বর্ষ যার গণনার মাপকাঠি, দিকে দিকে অন্ধকারে ডুবিয়া ডুবিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকাদের দেশ, অদৃশ্য ইথারের বিশ্ব যেখানে মানুষের চিন্তাতীত, কল্পনাতীত দূরত্বের ক্রমবর্ধমান পরিধিপানে বিস্তৃত – সেই বিশ্বে সে জন্মিয়াছে…

milky-way

ঐ অসীম শূন্য কত জীবলোকে ভরা – কি তাদের অদ্ভুত ইতিহাস! অজানা নদীতটে প্রণয়ীদের কত অশ্রুভরা আনন্দতীর্থ – সারা শূন্য ভরিয়া আনন্দস্পন্দনের মেলা – ইথারের নীল সমুদ্র বাহিয়া বহু দূরের বৃহত্তর বিশ্বের সে-সব জীবনধারার ঢেউ প্রাতে, দুপুরে, রাতে, নির্জনে একা বসিলেই তাহার মনের বেলায় আসিয়া লাগে – অসীম আনন্দ ও গভীর অনুভূতিতে মন ভরিয়া ওঠে – পরে সে বুঝিতে পারে শুধু প্রসারতার দিকে নয় – যদিও তা বিপুল ও অপরিমেয় – কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চেতনা-স্তরের আর একটা Dimension যেন তার মন খুঁজিয়া পায় – এই নিস্তব্দ শরত-দুপুর যখন অতীতকালের এমনি এক মধুর মুগ্ধ শৈশব-দুপুরের ছায়াপাতে স্নিগ্ধ ও করূণ হইয়া ওঠে তখনই সে বুঝিতে পারে চেতনার এ স্তর বাহিয়া সে বহুদূর যাইতে পারে – হয়তো কোনো অজ্ঞাত সৌন্দর্যময় রাজ্যে, দৈনন্দিন ঘটনার গতানুগতিক অনুভূতিরাজি ও একঘেয়ে মনোভাব যে রাজ্যের সন্ধান দিতে পারিতই না কোনোদিন…

নদীর ধারে আজিকার এই আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর নব রুপ সে দেখিতে পাইল। মনে হইল, যুগে যুগে এ জন্মমৃত্যুচক্র কোন বিশাল-আত্মা দেবশিল্পীর হাতে আবর্তিত হইতেছে – তিনি জানেন কোন জীবনের পর কোন অবস্থার জীবনে আসিতে হয়, কখনো বা বৈষম্য – সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি – বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট-

ছ’হাজার বছর আগে হয়তো সে জন্মিয়াছিল প্রাচীন ঈজিপ্টে – সেখানে নলখাগড়া প্যাপিরাসের বনে, নীলনদের রৌদ্রদীপ্ত তটে কোন দরিদ্র ঘরের মা বোন বাপ ভাই বন্ধুবান্ধবদের দলে কবে সে এক মধুর শৈশব কাটাইয়া গিয়াছে – আবার হয়তো জন্ম নিয়াছিল রাইন নদীর ধারে – কর্ক-ওক, বার্চ ও বীচবনের শ্যামল ছায়ায় বনেদি ঘরের প্রাচীন প্রাসাদে, মধ্যযুগের আড়ম্বরপূর্ণ আবহাওয়ায়, সুন্দরমুখ সখীদের দল। হাজার হাজার বছর পর হয়তো সে আবার ফিরিয়া আসিবে – তখন কি মনে পড়িবে এবারকার জীবনটা? – কিংবা কে জানে আর হয়তো এ পৃথিবীতে আসিবে না – ওই যে বটগাছের সারির মাথায় সন্ধ্যার ক্ষীণ প্রথম তারকাটি – ওদের জগতে অজানা জীবনধারার মধ্যে হয়তো এবার নবজন্ম! – কতবার যেন সে আসিয়াছে… জন্ম হইতে জন্মান্তরে, মৃত্যু হইতে মৃত্যুর মধ্য দিয়া… বহু দূর অতীতে ও ভবিষ্যতে বিস্তৃত সে পথটা যেন সে বেশ দেখিতে পাইল… কত নিশ্চিন্দিপুর, কত অপর্ণা, কত দুর্গা দিদি – জীবনের ও জন্মমৃত্যুর বীথিপথ বাহিয়া ক্লান্ত ও আনন্দিত আত্মার সে কি অপরুপ অভিযান… শুধু আনন্দে, যৌবনে, পুণ্যে ও দুঃখে, শোকে ও শান্তিতে…। এই সবটা লইয়া যে আসল বৃহত্তর জীবন – পৃথিবীর জীবনটুকু যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র – তার স্বপ্ন যে শুধুই কল্পনাবিলাস, এ যে হয় তা কে জানে – বৃহত্তর জীবনচক্র কোন দেবতার হাতে আবর্তিত হয় তা কে জানে?… হয়তো এমন সব প্রাণী আছেন যাঁরা মানুষের মতো ছবিতে, উপন্যাসে, কবিতায় নিজেদের শিল্পসৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন না – তাঁরা এক এক বিশ্ব সৃষ্টি করেন – তার মানুষের সুঝে-দুঃখে উখথানে-পতনে আত্মপ্রকাশ করাই তাঁদের পদ্ধতি – কোন মহান বিবর্তনের জীব তাঁর অচিন্ত্যনীয় কলাকুশলতাকে গ্রহে গ্রহে নক্ষত্রে নক্ষত্রে এ-রকম রুপ দিয়াছেন – কে তাঁকে জানে?…

একটি অবর্ণনীয় আনন্দে, আশায়, অনুভূতিতে, রহস্যে মন ভরিয়া উঠিল। প্রাণবন্ত তার আশা, সে অমর ও অনন্ত জীবনের বাণী বনলতার রৌদ্রদগ্ধ শাখাপাত্রের তিক্ত গন্ধ আনে – নীলশূন্যে বালিহাঁসের সাঁই সাঁই রব শোনায়। সে জীবনের অধিকার হইতে তাহাকে কাহারো বঞ্চনা করিবার শক্তি নাই – তার মনে হইল সে দীন নয়, দুঃখী নয়, তুচ্ছ নয় – ওটুকু শেষ নয়, এখানে আরম্ভও নয়। সে জন্মজন্মান্তরের পথিক আত্মা, দূর হইতে কোন সুদূরের নিত্য নূতন পথহীন পথে তার গতি, এই বিপুল নীল আকাশ, অগণ্য জ্যোতির্লোক, সপ্তর্ষিমন্ডল, ছায়াপথ, বিশাল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার জগৎ, বহির্ষদ পিতৃলোক, – এই শত সহস্র শতাব্দী, তার পায়ে-চলার পথ – তার ও সকলের মৃত্যুদ্বারা অস্পৃষ্ট সে বিরাট জীবনটা নিউটনের মহাসমুদ্রের মতো করলেই পুরোভাগে অক্ষুন্নভাবে বর্তমান – নিঃসীম সময় বাহিয়া সে গতি সারা মানব যুগে বাধাহীন হউক।…

অপু তাহাদের ঘাটের ধারে আসিল। ওইখানটিতে এমন এক সন্ধ্যার অন্ধকারে বনদেবী বিশালাক্ষী স্বরুপ চক্রবর্তীকে দেখা দিয়াছিলেন কতকাল আগে!

আজ যদি আবার তাহাকে দেখা দেন!

– তুমি কে?
– আমি অপু।
– তুমি বড় ভালো ছেলে। তুমি কি বর চাও?
– অন্য কিছু চাই নে, এ গাঁয়ের বনঝোপ, নদী, মাঠ, বাঁশবনের ছায়ায় অবোধ, উদ্গ্রীব,  স্বপ্নময় আমার সেই যে দশ বৎসর বয়সের শৈশবটি – তাকে আর একটি বার ফিরিয়ে দেবে দেবী? –

“You enter it by the Ancient way
Through Ivory Gate and Golden”

অপরাজিত…

Le-Meridien-Bora-Bora---Aerial
প্রথম জীবনের সে-সব মাধুরীভরা মুহূর্তগুলি যৌবনের কলকোলাহলে কোথায় মিলাইয়া গেল? কোথায় সে নীল আকাশ, মাঠ, আমের বউলের গন্ধভরা জ্যোৎস্নারাত্রি? পাখি আর ডাকে না, ফুল আর ফোটে না, আকাশ আর সবুজ মাঠের সঙ্গে মেশে না – ঘেঁটুফুলের ঝোপে ফোটা সদ্যফোটা ফুলের তেতো গন্ধ আর বাতাসকে তেতো করে না। জীবনে সে যে রোমান্সের স্বপ্ন দেখিয়াছিল – যে স্বপ্ন তাহাকে একদিন শত দুঃখের মধ্য দিয়া টানিয়া আনিয়াছে, তার সন্ধান তো কই এখনো মিলিল না? এ তো একরঙ্গা ছবির মতো বৈচিত্রহীন, কর্মব্যস্ত, একঘেয়ে জীবন – সারাদিন এখানে অফিসের বদ্ধ জীবন, রোকড়, খতিয়ান, মর্টগেজ, ইনকামট্যাক্সের কাগজের বোঝার মধ্যে পক্ককেশ প্রবীন ঝুনো সংসারাভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের সঙ্গে সপিনা ধরানোর প্রকৃষ্ট উপায় সম্বন্ধে পরামর্শ করা, এটর্নিদের নামে বড় বড় চিঠি মুসাবিদা করা – সন্ধ্যায় পায়রার খোপের মতো অপরিষ্কার নোংরা বাসাবাড়িতে ফিরিয়াই তখনি আবার ছেলে পড়াইতে ছোটা।

অফিসে সে নানা স্থানের ভ্রমণকাহিনী পড়ে, ডেস্কের মধ্যে পুরিয়া রাখে। পুরোনো বইয়ের দোকান হইতে নানা দেশের ছবিওয়ালা বর্ণনাপূর্ণ বই কেনে – নানা দেশের রেলওয়ে বা স্টিমার কোম্পানি যে সব দেশে যাইতে সাধারণকে প্রলুব্ধ করিতেছে – কেহ বলিতেছে, হাওয়াই দ্বীপে এসো একবার – এখানকার নারকেল কুন্জে, ওয়াকিকির বালুময় সমুদ্রবেলায় জোৎস্নারাত্রে যদি তারাভিমুখী ঊর্মিমালার সঙ্গীত না শুনিয়া মর, তবে তোমার জীবন বৃথা।

এল পাশো দেখ নাই। দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার চুনাপাথরের পাহাড়ের ঢালুতে, শান্ত রাত্রির তারাভরা আকাশের তলে কম্বল বিছাইয়া একবারটি ঘুমাইয়া দেখিও।।। শীতের শেষে নুড়িভরা উঁচুনিচু প্রান্তরে কর্কশ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে দু-এক ধরণের মাত্র বসন্তের ফুল প্রথম ফুটিতে শুরু করে, তখন সেখানকার সোডা-আলকালির পলিমাটিপড়া রৌদ্রদীপ্ত মুক্ত তরুবলয়ের রহস্যময় রুপ – কিংবা ওয়ালোয়া হ্রদের তীরে উন্নত পাইন ও ডগলাস ফারের ঘন অরণ্য, হ্রদের স্বচ্ছ বরফগলা জলে তুষারকিরীট মাজামা আগ্নেয়গিরির প্রতিচ্ছায়ার কম্পন – উত্তর আমেরিকার ঘন, স্তব্দ্ধ, নির্জন অরণ্যভূমির নিয়ত পরিবর্তনশীল দৃশ্যরাজি, কর্কশ বন্ধুর পর্বতমালা, গম্ভীরনিনাদী জলপ্রপাত, ফেনিল পাহাড়ি নদীতীরে বিচরণশীল বলগা হরিণের দল, ভালুক, পাহাড়ি ছাগল, ভেড়ার দল, উষ্ন প্রস্রবণ, তুষারপ্রবাহ, পাহাড়ের ঢালুর গায়ের সিডার ও মেপল গাছের বনের মধ্যে বুনো ভ্যালোরিয়ান ও ভায়োলেট ফুলের বিচিত্র বর্ণসমাবেশ – দেখ নাই এসব? এস এস!

টাহিটি! টাহিটি! কোথায় কত দূরে, কোন জোৎস্নালোকিত রহস্যময় কূলহীন স্বপ্নসমুদ্রের পারে, শুভরাত্রে গভীর জলের তলায় যেখানে মুক্তার জন্ম হয়, সাগরগুহায় প্রবালের দল ফুটিয়া থাকে, কানে শুধু দূরশ্রুত সংগীতের মতো তাহাদের অপূর্ব আহবান ভাসিয়া আসে। অফিসের ডেস্কে বসিয়া এক-একদিন সে স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকে – এই সবের স্বপ্নে। এই রকম নির্জন স্থানে, যেখানে লোকালয় নাই, ঘন নারিকেল কুন্জের মধ্যে ছোট কুটিরে, খোলা জানালা দিয়া দূরের নীল সমুদ্র চোখে পড়িবে – তার ওপারে মরকতশ্যাম ছোট ছোট দ্বীপ, বিচিত্র পক্ষীরাজি, অজানা দেশের অজানা আকাশের তলে তারায় আলোয় উজ্জ্বল মাঠটা একটা রহস্যের বার্তা বহিয়া আনিবে – কুটিরের ধারে ফুটিয়া থাকিবে ছোট ছোট বনফুল – শুধু সে আর অপর্ণা।

(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর “অপরাজিত” উপন্যাস থেকে নেওয়া)

Tagged , ,

ভারতের বিএসএফ এর অমানবিকতা এবং আমাদের আত্মমর্যাদাহীনতা

ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের একজন যুবককে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করেছে। এবং এই নির্যাতনের ভিডিওটি ভারতের এবং বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রকাশ হয়েছে। আমি কোনোভাবেই ভিডিওটি পুরো দেখতে পারিনি। একটা মানুষকে হাত-পা বেঁধে একদল অস্ত্রধারী মানুষ এভাবে পেটাচ্ছে – এই দৃশ্য আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। ছোটবেলায় সাপকে মারার জন্যে দেখতাম আমাদের গ্রামের মানুষগুলো লাঠিসোঁটা নিয়ে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তো। বেচারা সাপ কিছুক্ষণ তেড়েবেড়ে একটু পড় একটা প্রাণহীন নিথর দেহে পরিণত হতো। বাংলাদেশী যুবকটির ভাগ্য ভালো, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে প্রাণহীন নিথর দেহে পরিণত করেনি।

মানুষের জীবনের প্রতি কতোটুকু ঘৃণা থাকলে কেউ কাউকে এভাবে পেটাতে পারে। বিএসএফ এর সেই জওয়ানগুলো নিশ্চয়ই তাদের নিজের দেশ ভারতের কোনো মানুষকে ধরে এভাবে পেটাতো না। কিংবা তারা কি কখনো পশ্চিমা কোনো দেশের সাদা চামড়ার কোনো মানুষকে এভাবে পেটাতো কোনোদিন? কোনো চীনা নাগরিককে? এমনকি ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানী কোনো যুবককে? যতো বড়ই অপরাধ করুক না কেনো সে যুবক?

বিএসএফ যেভাবে বাংলাদেশী মানুষজনদের ধরে মেরে ফেলে, কিংবা পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় বাংলাদেশীদের তারা প্রায় মানুষই মনে করেনা। রাস্তার অপরিচিত কুকুরটিকে গুলি করে মেরে ফেলা যায়, জঙ্গলে সামনে পড়া সাপটিকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা যায়, একদল পিঁপড়াকে দলিত মথিত করে মেরে ফেলা যায় নিমিষে। ভারতের বিএসএফ ঠিক সেই ব্যবহারটিই করে আমাদের সাথে।

কিন্তু কেনো বিএসএফ এমন করে আমাদের সাথে?

আমরা দেশে বসে যতোই মনে করিনা কেনো বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটা গুরুত্মপূর্ণ দেশ, কথাটা কিন্তু খুব একটা সত্যি না। বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা গুরুত্মপূর্ণ অবস্থানে তো নয়ই, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের আসলে তেমন কোনো গুরুত্মই নাই। বাংলাদেশের কোনো খবর বাইরে খুব বেশি গুরুত্ম সহকারে প্রকাশ পায়না, এবং বাংলাদেশকে মোটের উপর একটা অশিক্ষিত, পশ্চাদপদ, এবং দরিদ্র জাতি হিসেবেই বিবেচনা করা হয় বাইরের পৃথিবীতে।

আমরা ভেবে ভেবে সুখ পেতে পারি যে আমেরিকা, ভারত, ইজরায়েল, এবং বাকী পৃথিবী আমাদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করে বসে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাইরের পৃথিবীতে আমাদের নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই খুব একটা। প্রতিবেশি হিসেবে ভারতের কিছুটা মাথাব্যথা থাকতে পারে, কিন্তু সেই পর্যন্তুই। আমাদেরকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা নিয়ে ভারত বসে থাকলে তাদের বছর বছর জিডিপির হার ৭%-৯% হতো না। তারা নিজেদের স্যাটেলাইট, জঙ্গিবিমান, সুপার কম্পিউটার বানাতে পারতো না।

আর আমেরিকার কাছে বাংলাদেশ এতোই তুচ্ছ একটা দেশ যে আমাদেরকে নিয়ে কোনো সময় ব্যয় করাও আমেরিকার জন্যে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার ধারণা বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার একমাত্র মাথাব্যথা হচ্ছে আমরা যেনো আত্মঘাতী জঙ্গি তৈরি করার একটা ঘাঁটি না হয়ে উঠি, যারা একদিন একটা বিমান নিয়ে যেয়ে আমেরিকার মাটিতে বিল্ডিং ধ্বংস করতে যাবে। এর বাইরে বাংলাদেশ এর কাছে আমেরিকার কী পাওয়ার আছে আমার ঠিক মাথায় ঢুকেনা।

আমি জানি নিজেদের সমালোচনা-দুর্বলতার কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগার কথা না। অনেকেই আমার উপরের লেখাগুলো পড়ে আহত হবেন, ক্ষেপে যাবেন, কিংবা একমত হবেননা। কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং চিন্তাভাবনা শেয়ার করলাম এখানে। পছন্দ না হলে সামনে আর পড়ার দরকার নেই, কারণ সামনে আরো আত্ম-সমালোচনা আছেঃ)

ধরুন, বিএসএফ ওই যুবককে না মেরে বাংলাদেশের কোনো সন্ত্রাসীকে মেরেছে। তাহলে কি আপনি এতো কষ্ট পেতেন? এতোটা ক্রুদ্ধ হতেন? খুব সম্ভবত হতেন। এবার বলেন, আমাদের র‍্যাব যখন বাংলাদেশীদের ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলে, গুলি করে লাশ ফেলে রাখে রাস্তায়, তখন আপনার কেমন লাগে? আপনি যদি র‍্যাব দ্বারা বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা সমর্থন করেন তাহলে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যা সমর্থন করেন না কেনো?

ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে যে আপনি পিটিয়ে বা আইন বহির্ভূতভাবে মানুষকে হত্যা সমর্থন করেন, কিন্তু কে সেটা করলো সেটার দিকে খেয়াল করেন। বিএসএফ মারলে দোষ, কিন্তু র‍্যাব মারলে দোষ নয়?

২০০৬ এর ২৮শে অক্টোবর শিবির এর একটা ছেলেকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করলো আওয়ামী লিগের লোকজন, আপনি (যদি আপনি আওয়ামী লীগ সমর্থক হোন আরকি) নিশ্চয়ই সেটা সমর্থন করেন? শিবির যখন রগ কাটে, কিংবা জামাতী রাজাকাররা যখন আমাদের বাংলাদেশীদের, কিংবা বুদ্ধিজীবিদের একাত্তরে হত্যা করেছিলো তখন ওরা নিশ্চয়ই কোনো মানবিকতা দেখায়নি। অতএব, এখন ওদেরকে অমানবিকভাবে মেরে ফেলার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ নেই?

ছাত্রলীগ এর সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোপাকুপি, খুনাখুনি দেখার পর মনে হয় না ছাত্রদল, কিংবা ছাত্র শিবির, কিংবা র‍্যাব-পুলিশ ধরে যদি এদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলতো আপনার (যদি আপনি বিএনপি কিংবা জামাত সমর্থন হোন আরকি) খুবই খুশি লাগতো। আচ্ছা বিএসএফ যদি ছাত্রলীগ এর এই সব গুন্ডাদের ধরে মেরে ওই যুবকের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলতো তাহলে কি আপনার একই রকম খুশি লাগতো?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল সাইদি যুদ্ধাপরাধী নন বলার পর একদল তরুণ যখন তাঁর কক্ষ ভাংচুর করেছে, তখন অনেকে – বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক লোকজন – এটাকে সমর্থন দিয়েছেন। একজন মানুষ যুদ্ধাপরাধী নন, এই মতামত দেওয়ার পর তার অফিস কক্ষ ভাঙ্গা তাদের কাছে কোনো অপরাধ নয়। এখানেও সেই একই যুক্তি – এইসব রাজাকার, আলবদরেরা যখন আমাদের বাংলাদেশীদের ধরে কচুকাটা করেছিলো তখন ওরাতো কোনো মানবিকতা দেখায়নি?

বিএনপির দ্বিতীয় দফা শাসনের সময় “অপারেশন ক্লিন হার্ট” নামে সেনাবাহিনী নামিয়ে দেওয়া হয়েছিলো সাধারণ মানুষকে ধরে ধরে উত্তম মধ্যম দেওয়া, কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্যে। শফিক রেহমানের মতো মানুষেরা সেটার প্রশংসা করে বলেছিলেন সব যুদ্ধে কিছু “কোল্যাটারাল ড্যামেজ” হয়। দেশের ভালো করতে গেলে কিছু মন্দ ঘটতেই পারে। অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় সেনাবাহিনী অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ধরে নির্যাতন করেছে, রাস্তায় থামিয়ে অপমান করেছে, সন্তানের সামনে পিতাকে কান ধরে উঠবস করিয়েছে। মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে পরে বলেছে হার্ট এটাকে সেই মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষেরা হাততালি দিয়েছি আমাদের সেনাবাহিনীর বীরত্ম দেখে।

ব্লগে, ফেইসবুকে আমাদের অসংখ্য মানুষকে (বিশেষ করে পুরুষ মানুষকে) দেখেছি হাসান সাইদ নামক পুরুষটিকে সমর্থন করতে, যে তার স্ত্রী রুমানার নাক কামড়ে ছিড়ে ফেলেছিলো, চোখ অন্ধ করে দিয়েছিলো। কেনো সেই মানুষগুলো হাসান সাইদকে সমর্থন দিয়েছিলো? কারণ রুমানার নাকি এক ইরানী যুবকের সাথে প্রেম ছিলো। অন্য পুরুষের সাথে প্রেম এর শাস্তি হচ্ছে নাক ছিঁড়ে ফেলা, চোখ ঘুঁটে অন্ধ করে দেওয়া! এবং এই মানুষগুলো দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইত্যাদি পড়ুয়া ছেলেমেয়ে!

আমরা আমাদের রিকশাওয়ালাদের পাঁচ টাকার জন্যে মার দিই, গালি দিই। আমাদের ঘরের কাজের লোকজনের সাথে আমরা কৃতদাসের মতো ব্যবহার করি।

আমাদের রাস্তা দিয়ে মেয়েরা হেঁটে যেতে পারেনা। কয়েক’শ চোখ তাকে ধর্ষণ করে বেড়ায়। অসংখ্য মুখ তার সম্পর্কে বাজে, রসালো মন্তব্য করে। এবং এই ধর্ষণকারী চোখগুলি, মুখগুলি আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া তরুণ।

তো বিএসএফ এর এক বাংলদেশী যুবককে নির্দয়ভাবে পেটানোর সাথে আমাদের দেশের এইসব অমানবিকতার সম্পর্ক কী?

সম্পর্ক হচ্ছে আমরা যদি আমাদের নিজেদের মর্যাদা না রাখতে পারি, আমরা যদি বাংলাদেশী হয়ে অন্য বাংলাদেশীদের এতো নির্দয়ভাবে মারতে পারি, পেটাতে পারি, ধর্ষণ করতে পারি, উত্যক্ত করতে পারি, র‍্যাব-সেনাবাহিনী দিয়ে পেটাতে পারি, এবং এতোকিছুর পর আমাদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে সেই অমানবিকতা, নিষ্টুরতা, নির্দয়তা, অসভ্যতা সমর্থন করতে পারি, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা একটা আত্মমর্যাদাহীন, আত্মসম্মানহীন জাতিতে পরিণত হবো এবং সেটা আমরা হচ্ছি।

আমরা যদি আমাদের নিজেদের মর্যাদা নিজেরাই না রাখতে পারি, তাহলে বিএসএফ কি আমাদের সেই মর্যাদা দিবে?

আমি কিন্তু এখানে বিএসএফ এর এই আচরণকে সমর্থন করছিনা, আমি ওদের এই আচরণের কারণ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি মাত্র।

বিএসএফ কখনো আমেরিকার একজন নাগরিককে এভাবে পেটাবেনা। কারণ আমেরিকা নিজেদের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করে এবং ভারতের এই আচরণের সাথে সাথে ভারত সেটার দাঁতভাঙ্গা জবাব পাবে।

আমেরিকা নিজেদের মাটিতে কাউকে অমানবিক নির্যাতন করতে পারেনা বলে (আইনের কারণে) কিউবার গুয়ানতানামোতে নিয়ে বিদেশীদের সাথে এই নিষ্ঠুর, নির্মম আচরণ করে। (ভাগ্যিস ওবামা এসে মানুষ নির্যাতনের এই কল বন্ধ করে দিয়েছে)।

যতোদিন আমরা নিজেরা নিজেদেরকে সম্মান দেওয়া শিখবোনা, আমার ধারণা বিএসএফও ততোদিন আমাদের সাথে এমন আচরণ করে যাবে।

আমরা যদি একটা মর্যাদাবান যাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারি, আমরা যদি নিজেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাত-র‍্যাব-পুলিশ-সেনাবাহিনী-ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-ছাত্র শিবির-সাধারণ মানুষ সবাইকে যদি আইনের শাসনের আওতায় নিয়ে বিচার করি, তাহলেই আমরা একটা চমৎকার সমাজ এবং জাতি গড়তে পারবো।

পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আইনের শাসনের একটা দেশ উন্নত হতে খুব বেশিদিন লাগেনা। এবং আমরা একটা উন্নত দেশ হতে পারলে বিএসএফ আমাদের যুবকদের ধরে নিয়ে পেটানোর পরিবর্তে একজন আমেরিকান নাগরিকের মতো ব্যবহার করবে। আর যদি সেটা না করে তবে বিএসএফকে একটা শক্ত পিটুনী দেওয়ার মতো শক্তিও তখন আমাদের থাকবে। আমাদের সশস্ত্রবাহিনী তখন অপারেশন ক্লিন হার্ট এবং ক্রস ফায়ার বাদ দিয়ে একটা সত্যিকারের শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হবে, যারা সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের সাথে ব্যাটাগিরি না দেখিয়ে ভারতের মতো দেশের সাথে ব্যাটাগিরি দেখানোর সামর্থ্য রাখবে। আর আমাদের তরুণ-তরুণীরা ব্লগে-ফেইসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়াও বাংলাদেশে ভারতের মতো পারমানবিক শক্তি-স্যাটেলাইট-জঙ্গিবিমান-সুপারকম্পিউটার তৈরির জন্যে মেধাবী হওয়ার জন্যে কাজ করবে।

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি – শেষ পর্ব

২০। সানস্ক্রীন ব্যবহার করুন

বেশি রোদ পড়লে ত্বকের ক্ষতি হয়, সানস্ক্রীন ব্যবহার করে ত্বকের যত্ন নিন। এবং নিচের ভিডিওটিতে যতো উপদেশ দেওয়া আছে সেগুলো সব অনুসরণ করার চেষ্টা করুনঃ

বাংলা অনুবাদ

২১। বেশি ভাবাভাবি বন্ধ করে কাজ করুন

বেশি ভাবতে যেয়ে জীবনের দরকারী কাজগুলো প্রায়ই করা হয়ে উঠেনা। আমি আমার জীবনে বেশি ভেবেচিন্তে একটা কাজও করতে পারেনি।

বেশি চিন্তা না করে কাজে নেমে পড়ুন। নাহলে কিছুই আর করা হয়ে উঠবেনা।

২২। সুযোগ পেলেই গান গাইতে, নাচতে চেষ্টা করুন

গান এবং নাচ চমৎকার আর্ট এবং মনকে খুব হালকা করে। নাচানাচি কিংবা গান গাওয়া/শুনার পড় মন ভালো না হতে উপায় নেই!

২৩। নতুন বন্ধু বানানো কঠিন কিছু না, এবং বর্তমান বন্ধুদের সাথে সুসম্পর্ক রাখাও জরুরী

আমি আমার গতো আট বছরের ভ্রমণ করে আসছি পুরোপুরি একা। প্রায়ই আমি একটা নতুন দেশে যে পা রাখি যেখানে আমাকে নিতে আসার কেউ থাকেনা। আমার তেমন কোনো কানেকশন নাই, কিন্তু আমি যেভাবেই হোক নতুন কানেকশন তৈরি করি। ইন্টারনেটে কোথাও কোনো পার্টি হচ্ছে দেখলে আমি সোজা যেয়ে সবাইকে “হ্যালো” বলি। এবং একটু লেগে থাকলে আমি কিছু মানুষকে পেয়ে যাই যাদের সাথে আমি গল্প-গুজব-আড্ডা দিতে পারি।

আপনি যদি বন্ধুত্বপরায়ন, অকপট, এবং মোটামুটি মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখেন তাহলে পৃথিবীর যেকোনো জায়গার যেকোনো মানুষের সাথে আপনি বন্ধুত্ব করতে পারবেন।

২৪। আপনার যা যা আছে তা হারিয়ে যাবার আগে সেগুলোর মূল্য বুঝবেন না

কোনো কিছুকেই খুব সহজপ্রাপ্য হিসেবে ধরে নিবেন না। একদিন রাতে আমার হোটেলে থাকার টাকা ছিলোনা এবং আমাকে বাইরে পাথরের উপর ঘুমাতে হয়েছিলো। সেই থেকে আমি আমার ঘুমানোর জন্যে যে একটা বিছানা এবং বাসা আছে সেটা নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। কারণ আমি জানি পৃথিবীর অনেক মানুষের এই মৌলিক জিনিসগুলোও নাই। কেবল এক রাতের বাইরে ঘুমানোর কষ্ট থেকে আমি এখন প্রতিদিন রাতে আমার বিছানায় ঘুমাতে যাবার আগে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি!

একবার আমার কানের ইনফেকশনের কারনে আমি প্রায় দুই সপ্তাহ কানে কিছু শুনতে পারতামনা। এরপর থেকে আমি আমার শ্রবণশক্তির জন্যে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকি। সুস্থ কান থাকার কারণে আমি চারদিকের এতো সব চমৎকার শব্দ শুনতে পাই!

আমি কখনো আমার খুব কাছের কাউকে মারা যেতে দেখিনি এখনো, কিন্তু আমি আমার পরিবারের কারো সাথে দেখা হলে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে বলি আমি তাদের কতোটা ভালোবাসি। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনদের সাথে আমি কোনো মনোমালিন্য পুষে রাখিনা, এবং আমার মনের কথাটি আমি সবসময় খোলাখুলিভাবে বলে ফেলি।

২৫। অযাচিত অহম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের ভুলের জন্যে ক্ষমা চেয়ে ফেলুন

কারো প্রতি মনে ক্ষোভ পুষে রাখবেননা, এবং সবসময় অন্যের সাথে বিতর্কে জেতার জন্যে মরিয়া হয়ে থাকবেননা। মাঝেমধ্যে নিজের অহমকে ছোট করে মানুষের সাথে মনোমালিন্য এড়ানো যায়। অপরজনের আগে আপনি নিজেই বলে ফেলুন আপনি দুঃখিত। কখনোই যার সাথে সমস্যা হচ্ছে তার ভুল বুঝার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন না। নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে ভুল বুঝাবুঝির সমাধান করে ফেলুন।

২৬। শুধুমাত্র অন্যদের মুগ্ধ করার জন্যে কিছু করা গাধামি

মানুষকে মুগ্ধ করার জন্যে যা-ই করেন না কেনো মানুষ আপনাকে সেই স্বীকৃতিটুকে দিবেনা। মানুষকে যদি বলে বেড়ান যে আপনি কতোগুলো ভাষা জানেন, কিংবা আপনি কতো ধনী, কতো উঁচু লেভেলের মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে, আপনি কতো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, আপনি কতো ভালো কাজ করেন, কোনো কিছুতেই আসলে মানুষের থেকে সেই স্বীকৃতিটুকু আপনি পাবেননা যেটা আপনি চাচ্ছেন। মানুষকে চমকিত করে আপনি নিজে গৌরবান্বিত হতে পারবেননা।

মানুষ তাদের দ্বারাই মুগ্ধ হয় যাদের কাছে গেলে তারা মন খুলে কথা বলতে পারে, এবং যাদের কথা এবং কাজ তাদের কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে। মোটামুটিভাবে বলা যায় আপনি মানুষ হিসেবে ইন্টারেস্টিং হতে পারলেই মানুষ আপনাকে পছন্দ করবে, আপনার দ্বারা মুগ্ধ হবে।

২৭। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ একাকীত্বে ভোগে

একা একা ভ্রমণ করার কারণে যে প্রশ্নটি আমাকে প্রায়ই শুনতে হয় তা হচ্ছে আমার নিজেকে একা লাগে কিনা। এক কথার হচ্ছে – না। আর লম্বা করে উত্তর দিতে গেলে একটা আলাদা পোস্ট লিখতে হবে।

সত্যি কথা বলতে কি পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ একাকীত্বে ভোগে। আর আমি আসলে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক বেশি একা ছিলাম। এখন আমি এমন অনেক মানুষের সাথে মিশি যাদের অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব, সামাজিক-পেশাগত নেটওয়ার্ক আছে। কিন্তু এদের অনেকেই নিজেকে একা ভাবেন কারণ তাদের ধারণা মানুষ তাদেরকে বুঝেনা।

আবার অনেকে পেশাগত কিংবা পারিবারিক কারনে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনদের থেকে দূরে সরে গিয়েছেন এবং এখন নিজেকে একা লাগে।

অনেকেই আমাকে বলেন যে পৃথিবীতে তাদের মতো একা আর কেউ নেই। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমার আসলে আমার নিজ বাড়ি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যেখানে কেউ আমার নাম পর্যন্ত জানেনা সেখানে বরং আমার অনেক ভালো লাগে। আমি নিশ্চিত এই মুহুর্তে পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আমার মতো অবস্থায় আছে যেখানে তারা তাদের প্রিয়জন থেকে অনেক দূরে আছেন।

নিজেকে একা লাগলে ভাববেন না আপনিই একমাত্র এই অবস্থায় আছেন। চারদিকের অনেকেই আপনার মতো একা আছেন এবং তারা নিশ্চিতভাবেই আপনার অবস্থা বুঝতে পারে।

২৮। ভালোবাসা-ই জীবনে সব নয়, তবে কিছু ভালোবাসার মানুষ ছাড়া জীবনটা শূন্য মনে হতে পারে

ভালোবাসা ছাড়াও আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন, কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া জীবনের একটা অংশ খালি মনে হবে। আপনার জীবনে কিছু মানুষ থাকা দরকার যারা আপনাকে ভালোবাসে – বন্ধুবান্ধব, পরিবার, অথবা আপনার প্রেমিক/প্রেমিকা।

২৯। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুলি কেউ আপনাকে কাগজে লিখে দিতে পারবেনা, আপনাকে অবশ্যই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মনে হতো আমি প্রায় সবকিছু জেনে গিয়েছি – এবং জীবনের গুরুত্মপূর্ণ প্রায় সবকিছুই বইয়ে লেখা আছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্মপূর্ণ জিনিসগুলো নির্ভুলভাবে কাগজে লেখা প্রায় অসম্ভব, এবং সেটা আমার এই পোস্ট সম্পর্কেও সত্যি।

যখন সারা পৃথিবীর প্রায় সব জ্ঞান যখন একটা কীবোর্ড এবং মাউস দিয়ে পাওয়া যায়, তখন এটা মনে হতে পারে বাইরের পৃথিবীতে যেয়ে সেই জ্ঞান নিজে অর্জন করার কোনো দরকার নেই। সিনেমা, বই, খবরের কাগজ ইত্যাদির মাধ্যমে এখন মনে হতে পারে আমরা প্রায় সব কিছু সম্পর্কে জেনে যেতে পারি।

এটা একটা ভুল ধারণা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছে মানুষের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

ঘরে বসে বসে নাটক, সিনেমা, কম্পিউটার এর মাধ্যমে পৃথিবী সম্পর্কে জানা বন্ধ করে বাইরে যেয়ে নিজের জীবন থেকে সেই অভিজ্ঞতা লাভ করুন।

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি – ২

পর্ব – ১

৬. মানুষকে কোনো কিছু বিশ্বাস করানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিজে একটা চমৎকার জীবন যাপন করা

কথা কিংবা যুক্তি-তর্ক দিয়ে মানুষকে যতোটা না বুঝাতে পারবেন, যেটার কথা বলছেন সেটা নিজে করে তার চেয়ে অনেক ভালো বুঝাতে পারবেন। যখন মানুষ আপনাকে দেখবে, আপনার কাজ দেখবে, তখন আপনার ওদেরকে আর আলাদাভাবে বিশ্বাস করানোর দরকার হবে না। তাদেরকে শুধু বলুন আপনি আপনার কাঙ্খিত জিনিসটি অর্জন করেছেন, জীবনে যেখানে পৌঁছাতে চান সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন কিংবা সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন। এরপর তাদেরকে জানান কীভাবে আপনি সেটা অর্জন করলেন বা করছেন। তাহলেই সবাই বুঝতে পারবে আপনি আসলে ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছেননা শুধু।

৭। পৃথিবীর কেউই সবকিছু জেনে বা পেয়ে বসে নেই

সবারই কিছু না কিছু সমস্যা আছে, কিন্তু তারা সেটা গোপন করে চলে। আপনি যখন একজন মানুষকে দেখেন তখন শুধু সে তাকে যেভাবে বাইরের পৃথিবীর কাছে দেখাতে চায় সেটাই দেখেন। আপনি হয়তো ভাবতেও পারবেন না তারা কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, কিংবা যে সুখী অবস্থায় তাদের দেখছেন সে অবস্থায় আসতে তাদের কীসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এটা সবার জন্যে সত্যি – কোটিপতি, ছাত্রছাত্রী, স্মার্ট তরুণ-তরুণী, লাজুক মানুষটি, এবং আর যেকোনো ধরণের মানুষই বলুন না কেনো, তাদের সবারই ভেতরের একটা জগত আছে – বাইরে থেকে তাদেরকে যেমনই মনে হোক না কেনো।

কারো সম্পর্কে সবকিছু জানার আগে কখনোই ভাববেন না সে খুব সহজে জীবনে সবকিছু পেয়ে গেছে।

৮। “আমি জানিনা” – এটা বলায় কোনো লজ্জা নাই

অনেকে কোনো বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করায় লজ্জা পান। এটা নিয়ে কোনো ভাবাভাবির অবকাশ নাই – জাস্ট বলে ফেলুন “আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে জানিনা”। অজ্ঞতা লুকানোর চেয়ে সততা অনেক বেশি স্মার্ট একটা ব্যাপার।

৯। আরো বেশি টাকা কখনোই আপনার সব সমস্যার সমাধান করবে না

আপনার যদি খাবার এবং থাকার জন্যে পর্যাপ্ত টাকা থাকে তাহলে এরচেয়ে বেশি টাকা ছাড়াও আপনি জীবন চালিয়ে নিতে পারবেন। এটা আরো ভালো করে বুঝতে পারবেন যদি আপনি অসচ্ছল অথচ মোটামুটি সুখী এমন মানুষদের সাথে মিশেন। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলি পেতে কোনো টাকা লাগেনা, আর বাদবাকী জিনিসগুলো আপনি যতো দামী ভাবছেন ততোটা দামী না।

১০। আপনার সম্পদ আপনাকে কিনে নেয়

সত্যিকারের দরকারী জিনিসগুলো ছাড়া মানুষের অন্যান্য দামী সম্পত্তি-সম্পদ আসলে অন্যের কাছ থেকে স্বীকৃতি বা এক ধরণের লোক দেখানো ছাড়া কিছুই না। বেঁচে থাকা এবং জীবন যাপনে সুবিধার জন্যে দরকারী না হলে এসব দামী জিনিসপত্র ছাড়া আপনি অনায়াসে আপনার জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন।

যখন আপনি জীবনে দামী জিনিসপত্র ছাড়া চলতে পারবেননা তখন এই জিনিসপত্রগুলি আপনার জীবনকে পরিচালিত করবে। আপনার দামী বাড়ি বা ফ্ল্যাট এবং ঘরের দামী ফার্নিচার থাকার কারণে আপনি অন্য জায়গায় সহজে চলে যেতে পারবেন না, এবং এগুলো পাওয়ার জন্যে আপনাকে সবসময় অনেক বেশি উপার্জন করা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এবং আমার ধারণা এইসব দামী সম্পদ আপনার জীবনকে খুব বেশি সমৃদ্ধ করেনা। জীবনে যতো কম সম্পদ থাকবে ততোই আসলে ভালো।

১১। টেলিভিশনের মতো সময় অপচয়কারী বস্তু পৃথিবীতে আর কিছু নাই

আমার বয়স একুশ হওয়ার আগে আমি টিভি দেখে আমার জীবনের অনেক সময় অপচয় করেছি। আমার মনে হতো “অমুক প্রোগ্রামটি আমাকে দেখতেই হবে”। এখন আমার সেই হারানো প্রতিটি সেকেন্ডের জন্যে খুব দুঃখ হয়। সারা পৃথিবী এগিয়ে চলে যাচ্ছিলো ভবিষ্যতের দিকে আর আমি বসে বসে টিভি দেখছিলাম!

বিংশ শতাব্দীতে টিভি একটা গুরুত্মপূর্ণ জিনিস ছিলো – সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ এবং সংবাদ এর জন্যে। কিন্তু এখন টিভির আর তেমন দরকার নেই। টিভির খবরগুলো সাধারণত পক্ষপাতিত্বপূর্ণ হয় যেখানে আমাদের অনেক বিকল্প সংবাদ মাধ্যম রয়েছে। আর টিভির অনুষ্ঠানগুলো থেকে শেখার প্রায় কিছুই নেই, যদিও এগুলো মানুষের দিন থেকে ঘন্টার পড় ঘন্টা নিয়ে নেয়। অথচ আমরা প্রায়ই অনুযোগ করি আমাদের হাতে সময় নেই!

টেলিভিশন মানুষকে ঘরকুনো করে ফেলে। যদি টেলিভিশনে পছন্দের কোনো অনুষ্ঠান বা খেলা দেখতে চান তাহলে কোনো বন্ধুর বাসায় যেয়ে আড্ডা দিতে দিতে একসাথে দেখুন।

ঘরের ভেতরে বসে টেলিভিশনের স্ক্রীন এর মতো জড় একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে থেকে জীবনকে কোনোভাবের সমৃদ্ধ করতে পারবেননা।

১২। ইন্টারনেট হচ্ছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে উপকারী জিনিস, কিন্তু এটাকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করতে হবে

টেলিভিশন হচ্ছে একটা নির্বোধ জড় স্ক্রীন, তার বিপরীতে ইন্টারনেট হচ্ছে একটা সক্রিয় মাধ্যম। ইন্টারনেট নিয়ে আপনি অনেক কিছু করতে পারবেন, একটা ভার্চুয়াল সামাজিক জগতে ঢুকে যেতে পারবেন। ইন্টারনেট পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে নানাভাবে সংযোগ স্থাপন করে এবং এটা ছাড়া আমার গতো আট বছরের জীবন অনেক কঠিন হতো।

ইন্টারনেটের এতো উপকারিতা সত্ত্বেও এটারো টেলিভিশনের মতোই সময় অপচয় করার সম্ভাবনা আছে। জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্যে ইন্টারনেট ব্যব্যহার করুন, কিন্তু সারাদিন এর মধ্যে পড়ে না থেকে বাইরে যেয়ে সেই সমৃদ্ধ জীবন উপভোগ করুন। টেলিভিশনের জড় স্ক্রীন এর জায়গায় কম্পিউটার এর অনেক কর্মকান্ডভরা স্ক্রীন ব্যবহার করলেই যে আপনার সময়ের সদব্যবহার হবে তা কিন্তু না। বাইরের পৃথিবী অনেক বেশি সুন্দর, বের হোন এবং সেটা উপভোগ করুন।

১৩। বাইরে যেয়ে মানুষের সাথে কিছু সময় কাটান

আমার খুব প্রিয় একটা ওয়েবসাইট হচ্ছে http://www.couchsurfing.org/। যেহেতু আমি নতুন নতুন ভাষা শিখতে আগ্রহী, এই সাইটের মাধ্যমে অনেক ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে আমার অতিথি হিসেবে আমার বাসায় থাকতে দিয়েছি এবং বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে তাদের ভাষা শিখতে পেরেছি।

সত্যিকারের পৃথিবী হচ্ছে বাইরের পৃথিবী – বই, টেলিভিশন, এবং ইন্টারনেটে যে পৃথিবী দেখছেন সেটা না। এই পৃথিবীর দেখা পাবেন আপনি বাইরের মানুষের সাথে মিশলে। নিজেকে লাজুক বা ইন্ট্রোভার্ট হিসেবে ভাবা বন্ধ করুন এবং নিজের ঘরের কিংবা দেশের বাইরে যেয়ে অন্য মানুষের সাথে মিশুন।

১৪। শুধু ইংরেজী ভাষা দিয়ে অন্য দেশের মানুষেকে খুব গভীরভাবে জানতে পারবেন না

আপনার বিদেশ ভ্রমণ যদি অল্প কিছুদিনের হয় তাহলে আপনি ইংরেজী দিয়ে অনায়াসে কিছুদিন চালিয়ে নিতে পারবেন। হোটেল বুক করা, রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দেওয়া, কিংবা একজন ভ্রমণ গাইডের সাথে ইংরেজীতে কথাবার্তা চালিয়ে নেওয়া – সবই করতে পারবেন। হয়তো কিছু স্থানীয় শিক্ষিত বন্ধুবান্ধবও বানিয়ে নিতে পারবেন। আপনার হয়তো মনে হবে আপনি সে দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গিয়েছেন

কিন্তু আপনি আসলে সত্যিকারভাবে কোনো দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবেননা শুধু সেদেশের ইংরেজী জানা মানুষজনের সাথে কথা বলে। শুধুমাত্র ইংরেজী জানলে আপনি সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। আমি আমার ভ্রমণ করা দেশগুলো সম্পর্কে এতো বেশি জানতে পেরেছি কেবলমাত্র তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলার কারণে। ওদের ভাষায় কথা বলতে না পারলে এতো গভীরভাবে তাদের সম্পর্কে জানা আমার পক্ষে অসম্ভব হতো।

যে কেউ চাইলেই একটা নতুন ভাষা শিখতে পারে। আমার বয়স যখন ২১ ছিলো তখনো আমি ভাবতাম এটা সম্ভব না। কিন্তু একদিন আমি সব ফালতু অজুহাত দেখানো বন্ধ করলাম এবং একটা নতুন ভাষা শিখে ফেললাম। কোনো ভাষা তাড়াতাড়ি শেখার গোপন উপায় হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই সেই ভাষায় অল্প অল্প করে কথা বলা শুরু করা।

১৫। অন্য দেশের মানুষজন সম্পর্কে আপনি যা ভাবেন তারা আসলে সেরকম না

পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশই ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে উঠছে। এর মানে এই নয় যে ওরা সব পশ্চিমা দেশগুলো বা আমেরিকার মতো হয়ে উঠছে। সব দেশই ভিন্ন এবং সেটা ট্যুর বইয়ে তাদের সম্পর্কে যা পড়ে এসেছেন সেরকম নয়। ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে প্রথাগত এবং পুঁথিগত ধারণা বাদ দিয়ে খোলা মন নিয় এওদের সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করুন।

আইরিশ মানুষ মানেই যে বিয়ার খায় তা নয়, ব্রাজিলের সবাই ফুটবল খেলেনা কিংবা সাম্বা নাচেনা, এবং জার্মান, ডাচ, ফিলিপিনো সবার সাথে কথা বলে আপনি অবাক হবেন যদি আপনার আগে থেকে পুষে রাখা ধারণা বাদ দিয়ে তাদের সাথে মিশেন।

মানুষের ভিন্নতাকে সম্মান করুন, তাদের কাছে গেলে তাদের সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন। এমনো হতে পারে আপনার সংস্কৃতই ওদের কাছে পশ্চাদপদ মনে হবে!

১৬। জীবন নিয়ে তাড়াহুড়ো করবেন না, সময় নিন

যেসব দেশকে আমাদের কাছে “ধীর গতির” মনে হয়, আমি দেখেছি তারা আসলে তাদের নিজস্ব গতির জীবনে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। যেসব মানুষ কিংবা দেশ সবকিছু তাড়াহূড়ো করে করতে চায় তাদের কাজের কোয়ালিটি আসলে ততোটা ভালো হয়না। সবকিছু সহজভাবে নিন এবং ধীরে ধীরে কাজ করুন।

খাবারের প্রতিটি কামড় উপভোগ করুন, হাঁটার সময় চারপাশ দেখে ধীরে ধীরে হাঁটুন, কারো সাথে কথা বলার সময় তাকে তার কথা পুরোপুরি শেষ করতে দিন এবং সে পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনুন।

দিনের কাজের ভেতর মাঝে মধ্যে কাজ বন্ধ করে বাইরে তাকান, কিংবা চোখ বন্ধ করে একটা বড় নিশ্বাস নিন, বেঁচে থাকার জন্যে নিজেকে সুখী ভাবুন।

১৭। আপনি সবাইকে খুশি করতে পারবেন না

“সফল হওয়ার উপায় হয়তো আমি জানিনা, কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার উপায় হচ্ছে সবাইকে খুশি করতে যাওয়া” – বিল কসবি।

নিজের মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করুন। আপনার যদি আপনার মতামতের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস থাকে এবং সেই মতামত অন্যদের সাথে শেয়ার করেন তাহলে নিশ্চিতভাবে অনেক মানুষ আপনার উপর বিরক্ত হবে, আপনার কথাটা যতোই চমৎকার হোকনা কেনো। যারা আপনার সাথে একমত না এবং আপনার মত পছন্দ করছেনা এটা তাদের সমস্যা, আপনার না।

১৮। Cool হওয়ার চেষ্টা করা কিংবা সর্বশেষ ক্রেইজের পেছনে ছোটা আসলে Uncool

যারা সবসময় অন্যের দেখাদেখি নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে তারা আসলে নিজেদের ব্যক্তিত্ব নিয়ে ভয় পায়। নিজের মেরুদন্ড শক্ত করুন, এবং স্রোতের বিপরীতে যাওয়াটাকে যদি আপনার সঠিক পথ মনে হয় তাহলে শক্তভাবে তাই করুন। আজকে যেটা চমকপ্রদ কয়েক বছর পর সেটাই হয়তো সবার অপছন্দের জিনিসে পরিণত হবে।

১৯। ভুল করতে ভই পাবেন না, জীবনে অনেক ভুল করুন

ভুলের মাধ্যমেই আমরা শিখি। সাফল্য আসে অনেক ভুলের পরেই

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি

কিছুদিন আগে একটা ওয়েব সাইটে একটা চমৎকার লেখা পড়ি। ভদ্রলোক গতো আট বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং বিভিন্ন দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতি শিখছেন। তার পৃথিবী ভ্রমনের আট বছর পুর্তি উপলক্ষে তিনি তার ভ্রমন থেকে কী শিখেছেন সেটার একটা লিস্ট দিয়েছেন ভাবলাম অনুবাদ করে ফেলি:)

মূল লেখার লিঙ্কঃ http://www.fluentin3months.com/life-lessons/

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি
===========================================

আট বছর।
৪১৬ সপ্তাহ, যেটা প্রায় ৩০০০ দিন।

এই দীর্ঘ সময় আমার কোনো নির্ধারিত ঘর ছিলোনা। আমি ঘুরে বেড়িয়েছি দেশ থেকে দেশে, এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে। আমার সারা জীবনের অর্জন করা সব সম্বল আমার ট্রাভেল ব্যাগে করে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি এই সময়টা। এটা ছিলো আমার জীবনের একটা বড় অংশ, এবং আমি এখনো এটা করে চলেছি।

এর আগেও আমি অবশ্য কয়েকটা জায়গায় ভ্রমন করেছি – দুটো গ্রীষ্ম আমেরিকায়, আর এক মাস স্পেইনে। এবং ২০০৩ সালে, আমার একুশতম জন্মদিনের সপ্তাহটিতে, আমি আমার জন্মস্থান আয়ারল্যান্ড ছাড়ি চিরদিনের জন্যে। এর কয়েকদিন আগে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করি, এবং আমি জানতাম এরপর হয়তো আমি আয়ারল্যান্ডে শুধু বেড়াতে আসবো, যদিও আমি জীবনে কখনো আমার পরিবারের সাথে ক্রিসমাস ডিনার না খেয়ে থাকিনি। কিন্তু আয়ারল্যান্ড আর আমার বাড়ি না। এখন থেকে “যেখানে আমি যাবো সেটাই হবে আমার বাড়ি”।

এর আগে আমার জীবনের প্রায় সবটুকু আমি ব্যয় করেছি বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে। কিন্তু সেখানে আমি গুরুত্মপূর্ণ প্রায় কিছুই শিখিনি। বইয়ে লেখা জিনিসগুলো প্রায় সবই আমি আগে থেকে জানতাম, কিন্তু আমি যা হতে চেয়েছি জীবনে সেটা আমি শিখেছি গতো আট বছরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে। এবং আমার নিশ্চিতভাবে এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।

গতোকাল ছিলো আমার ২৯-তম জন্মদিন, এবং এই সপ্তাহে আমার পৃথিবী ভ্রমনের আট বছর পূর্ণ হচ্ছে। তাই ভাবলাম আমার এই আট বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ২৯টি শিক্ষা আপনাদের সাথে শেয়ার করি। এগুলো বেশিরভাগই জীবন নিয়ে সাধারণ কথাবার্তা, কিন্তু এগুলো আমি শিখেছি সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের সাথে মেশার পরঃ

১। সব জায়গায় সব মানুষ আসলে একই জিনিস চায়

যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি অনেক ভিন্ন, আপনি ইটালিয়ান কোটিপতি থেকে শুরু করে গৃহহীন ব্রাজিলিয়ান, নেদারল্যান্ডস এর জেলে, ফিলিপাইনের কম্পিটার প্রোগ্রামার এর সাথে তাদের নিজের ভাষায় তাদের মতো করে কথা বলে দেখবেন যে তারা সবাই জীবনের গুরুত্মপূর্ণ জিনিসগুলোর ব্যাপারে একই রকম চিন্তা করে।

সবাই চায় স্বীকৃতি, ভালোবাসা, নিরাপত্তা, বিনোদন, এবং একটা ভবিষ্যতের আশা। এই চাওয়াগুলির প্রকাশ এবং এগুলো পাওয়ার জন্যে সবার কাজে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু এই বাহ্যিক ব্যাপারগুলো উপেক্ষা করলে দেখবেন পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ আসলে প্রায় একই জিনিস চায়।

২। সুখ ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখা বড় ভুল

অসংখ্য মানুষ ভাবে “ওই একটা জিনিস” যদি ঠিক হয়ে যায় “তাহলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে”।

এটা একটা ঘোর (ডিলুশন)।

যখন “ওই একটা জিনিস” ঠিক হবে, তখন “আরো একটা” জিনিস আপনার জীবনে বাকি থেকে যাবে। জীবনে কখনো সবকিছু একসাথে আপনার কাছে ধরা দিবেনা। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জীবনে সুখী হওয়া শুধু একটা জিনিস ঠিক হয়ে যাওয়ার উপর নির্ভর করেনা, এভাবে সুখী হওয়াও যায়না। এরচেয়ে এই মুহুর্তে আপনার যা আছে তা নিয়ে সুখী হোন, বর্তমানকে উপভোগ করুন, এবং একইসাথে ভবিষ্যতের জন্যে জন্যে কাজ করে যান। সাফল্য আসলে একটা ভ্রমন, গন্তব্য নয়!

আপনার জীবনের একটা বড় অংশ যদি একটা বড় কিছুর জন্যে কাজ করে চলে যায় তাহলে সে কাজটি হয়ে যাওয়ার পর আপনার জীবনে আর তেমন কিছুই থাকবেনা। কোনো বড় কিছুর জন্যে কাজ করলেও নিজেকে সুখী হওয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না, কাজটি শেষ হওয়া পর্যন্ত সুখী হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন না, কাজ করতে করতেই সুখী হওয়ার চেষ্টা করুন।

ধীরে ধীরে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন এবং এই ভ্রমন উপভোগ করুন।

অনুষ্টানটি উপভোগ করুন, শেষ দৃশ্যের জন্যে তাড়াহূড়ো করবেন না।

আমাদের জীবন হচ্ছে এখন – অতীত এবং ভবিষ্যত কোনোটাই না।

৩। “একদিন আমার সময় আসবে আর আমি সুখী হবো” – এটা একটা ফালতু চিন্তা। আপনি কখনোই লটারি জিতবেন না। বাস্তববাদী হোন।

অনেকের ভাগ্য নিয়ে একটা অদ্ভুত ধারণা আছে – আল্লাহ/ঈশ্বর/ভগবান/দেবতা কেউ একদিন কোনোভাবে তাদের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিবেন। তারা ভাবেন তারা “সৌভাগ্য পাবার যোগ্য” এবং “একদিন সব এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে” তাদের জন্যে। কেউ কেউ ভাবেন একদিন তারা লটারি জিতবেন কিংবা ভালো কিছু একটা ঘটবে তাদের জীবনে। অনেক মেয়ে ভাবে একদিন তার রাজপুত্র এসে তাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের দেশে!

এই ধরণের ভাবনা আসে পৃথিবী কীভাবে কাজ করে সেটা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা থেকে। হতে পারে আমি ভুল, হয়তো প্রার্থনা বা আশা থেকে ভালো কিছু ঘটতে পারে, হয়তোবা মানুষ হিসেবে ভালো হয়ে থাকতে পারলে একসময় ভালো কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু আশা, প্রার্থনা, এবং ভালো হওয়ার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে চাওয়ার জিনিসটাকে অর্জন করার চেষ্টা করে যেতে দোষ কোথায়?

আমি ব্যক্তিগতভাবে জাদু, জ্বীন-পরী, জ্যোতিষবিদ্যা, কিংবা কোনো অদৃশ্য সত্ত্বায় বিশ্বাস করিনা । এগুলোর ব্যাপারে আমি সন্দিহান এবং আমি বিশ্বাস করি এগুলো সবকিছু অসম্ভব এবং হাস্যকর। এইসব অদৃশ্যে বিশ্বাস না করাটা আমার জীবনকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। একজন বাস্তববাদী মানুষ হিসেবে পৃথিবীকে আমি খুব যুক্তির জায়গা হিসেবে দেখি যেখানে প্রকৃতির তৈরি বৈজ্ঞানিক নিয়ম এবং মানুষের তৈরি সামাজিক নিয়ম অনুসারে সবকিছু চলে। এবং পৃথিবীকে এভাবে দেখার কারণে আমি অনেক সহজভাবে সবকিছু দেখতে পারি।

এই বিশ্বজগত আপনাকে কিছু দেবার জন্যে পণ করে বসে নেই। আপনাকেই আপনার জীবন গুছিয়ে তোলার জন্যে কাজ করে যেতে হবে।

৪। নিয়তি বলে কিছু নাই, এবং এটা একটা সুখবর!

নিয়তি’র দোহাই দিয়ে আমরা অনেকেই জীবনে ভালো কিছু করা থেকে বিরত থাকি। আসল ঘটনা হচ্ছে নিয়তি বলে কিছু নাই ।

আপনার ব্যর্থতা কিংবা সীমাবদ্ধতা আপনার জন্ম কোথায় হয়েছে সেটার উপর নির্ভর করেনা, কিংবা আপনি কাকে চিনেন, আপনার জিন কেমন, আপনার কতো টাকা আছে, আপনার বয়স, আপনার অতীত, বা অন্য কোনো কিছুর সাথেই এর কোনো সম্পর্ক নাই। কোনো কিছুর দোহাই দিয়ে আপনার সীমাবদ্ধতাকে আপনি জাস্টিফাই করতে পারবেননা।

যদি সত্যিকারভাবে সংকল্পবদ্ধ হন, তাহলে জীবনে অর্জন করার অজস্র সুযোগ আছে – আপনি কে কিংবা আপনার কাছে কতো টাকা আছে এটা কোনো ব্যাপারই না।

৫। আপনার থেকে ভিন্ন বিশ্বাস ও মতের মানুষের সাথে কথা বলুন এবং তাদের বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করুন

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সাথে পৃথিবীর অনেক মানুষের বিশ্বাসের কোনো মিল নাই। কিন্তু মানুষ এই ভিন্ন বিশ্বাসে থেকেও জীবনের তাৎপর্য খুঁজে পায়। যদি সবাই আমার মতো বিশ্বাস করতো এবং ভাবতো তাহলে পৃথিবীটা একটা রসকষহীন জায়গায় পরিণত হতো।

অতএব আমি যখন আমার থেক ভিন্ন বিশ্বাসের কোনো মানুষের সাথে মিশি, তখন তাদেরকে আমার বিশ্বাসে নিয়ে আসার চেয়ে তাদের বিশ্বাস তাদের কাছে রেখে একসাথে মিলে চলার চেষ্টা করাই ভালো।

কেউ যখন তার কোনো বিশ্বাস এর ব্যাপারে “১০০% নিশ্চিত” এবং বহু বছর ধরে সেই বিশ্বাস ধারণ করে আসছে, তখন তাকে কিছু চালাকী কথাবার্তার মাধ্যমে তার বিশ্বাস থেকে সরানো যায় না। সবাই কিছু কিছু ব্যাপারে বদ্ধ মনের মানুষ, আমি নিজেও তাই।

কেউ যদি নিজে নিজের বদ্ধ মন থেকে বের হতে না পারে তাহলে তাকে সেটাই বিশ্বাস করতে দেওয়া উচিত। আপনিই ঠিক আর অন্যরা ভুল – পৃথিবীকে এটা বোঝানোর দায়িত্ব নেওয়ার দরকার নাই। কখনো কখনো হয়তো আপনার বিশ্বাসটিই ভুল!

পৃথিবী আরো অনেক বেশি মজার জায়গা হয় যখন সেখানে বিভিন্ন বিশ্বাসের এবং আগ্রহের মানুষ থাকে। আমার নিজের সন্দেহবাদীতা সত্ত্বেও আমি অনেক জ্যোতিষী, হস্তরেখা বিশারদ, অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ, রক্ষণশীল মানুষ, এবং প্রযুক্তিকে ঘৃনা করে এমন অনেক মানুষের সাথে মিশেছি। এবং সেজন্যে আমার জীবন অনেক বেশী বৈচিত্রময় এবং সমৃদ্ধ
হয়েছে।

আপনি যদি শুধুমাত্র যারা আপনার সব কথায় হ্যাঁ বলে এমন মানুষদের সাথে মিশেন তাহলে আপনি কখনো ভুল করছেন কিনা এটা জানার সুযোগ পাবেন না এবং নতুন জিনিস শিখতেও পারবেন না।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?

১। মৃত্যু উপত্যকা

প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরের দূর্ঘটনায় অকালমৃত্যু আমাদের সবার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে। এটা এমন এক ক্ষতি আমাদের জাতির জন্যে যেটা সহজে পূরণ হবার নয়। এমনিতেই আমাদের চলচ্চিত্রের যাচ্ছেতাই অবস্থা, এর মধ্যে একজন চরম প্রতিভাবান নির্মাতাকে হারানো মানে আসলে আমাদের চলচ্চিত্রের আরো অনেকখানি পিছিয়ে যাওয়া।

সড়ক দূর্ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেও আমাদের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে বাসে বাসে সংঘর্ষের পর অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন, যদিও সেই দূর্ঘটনায় ছয়জন হতভাগা মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো।

নৌপথেও আমাদের দেশে প্রায়ই লঞ্চডুবি হয়। বছর বছর শত শত মানুষ মারা যায় তাতে।

কয়দিন পরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে রাস্তায় পড়ে মরে থাকে কিশোরের মৃতদেহ। ইট, রড দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে রাখি তরুণদের, যে আমাদেরই কারো না কারো স্বজন, পরিচিত জন।

আমাদের র‍্যাব-পুলিশ তো মানুষ মারাকে কৌতুকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। রাত তিনটার সময় র‍্যাবের গাড়ি থেকে পালাতে যেয়ে গুলি খেয়ে মরে যায় কোনো তরুন, তার মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকে কোনো দেশীও অস্ত্র! বিচার বিভাগ নামে যে একটা প্রতিষ্ঠান আছে সেটা মনে হয় আমাদের র‍্যাব-পুলিশের লোকজন কোনোভাবেই মানতে রাজী নন।

২। এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়!

তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর খবরের কাগজে, ফেইসবুক, টুইটার, ব্লগে মানুষের হাহাকার উঠেছে। সবারই মোটামুটি এক কথা – এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়! এ কোন দেশে আছি আমরা, আমাদের কি সরকার নেই? আমরা কি আফ্রিকার কোন যুদ্ধপীড়িত দেশ? এই লাশের মিছিল থামানোর দায়িত্ব কি কারো নয়?

৩। অযোগ্য রাজনীতিবিদ-আমলা-পুলিশ

রাজনীতিবিদরা আমাদের দেশের চিরকালীন ভিলেন। বাজের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে? বানিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজশ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সড়ক দূর্ঘটনায় কেউ মারা গেছে? যোগাযোগ মন্ত্রী করেটা কী? জঙ্গিরা বোমা ফাটিয়েছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজের দলের উপকার ছাড়া আর কোনো কাজে আগ্রহী না। শেয়ার বাজার পড়ে গেছে? অর্থ মন্ত্রী নিজেই এই চক্রের সাথে জড়িত!

হয়তো ব্যাপারটি সত্যি। আমাদের রাজনীতিবিদদের অদক্ষতা এবং অসততা আমরা আমাদের সামনেই দেখে চলেছি।

রাজনীতিবদদের সাথে আমাদের ভিলেনের তালিকায় আছে দুর্নীতিপরায়ণ এবং অদক্ষ আমলা এবং পুলিশ বাহিনী। রাজনীতিবিদদের সাথে তাল মিলিয়ে এই মানুষগুলোর কর্মকান্ডও দিন দিন আমাদের কষ্টের এবং দেশকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন ভঙ্গের পেছনে অনেক অবদান রাখছে।

৪। অযোগ্য আরো অনেকে

শুধু কি রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ নিয়ে আমাদের অভিযোগ?

– আমাদের শিক্ষকদের নিয়েও আমাদের অনেক হতাশা, তারা দিনের পর দিন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাজনীতি করে চলেছেন।
– হতাশা আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের নিয়ে যারা আমাদের আশা অনেক উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে বারবার নিরাশ করছে। ফুটবল খেলোয়াড়দের নিয়ে আমাদের হতাশা তো এমন পর্যায়ে যে আমাদের আর কোনো আশাই নাই ওদের নিয়ে।
-আমাদের বিজ্ঞানীরা খুব কমই গর্ব করার মতো কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছেন এখন পর্যন্ত।
– আমাদের চলচ্চিত্র এমন পর্যায়ে যে আমাদের মধবিত্ত, উচ্চবিত্ত সমাজ চলচ্চিত্র প্রায় বর্জন করে চলেছেন।
– আন্তর্জাতিক কোনো ক্রীড়া প্রতযোগিতায় আমাদের কখনো তেমন কোনো সাফল্য নাই।
– বিজ্ঞান-প্রকৌশলে আমাদের কোনো বড় অর্জন নাই। আমাদের বড় বড় ব্রিজ, বিল্ডিং ইত্যাদি এখনো বিদেশী প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হয়।
– আমাদের বাস-ট্রাক ড্রাইভাররা খেয়াল খুশি মতো গাড়ি চালায় আর মানুষ মারে?

এই লিস্ট এর অন্ত নেই। মনের সুখে যোগ করুন আপনার অভিযোগটি।

এবং এর প্রতিটির জন্যে আমরা নিয়ম করে বকাঝকা, গালাগাল করে যাচ্ছি অদক্ষ, অযোগ্য মানুষগুলোকে। আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের যে কী পরিমান গালি খেতে হয় সেটা ফেইসবুক, ব্লগিং না থাকলে মনে হয় আমার জানা হতো না!

৫। আমি ছাড়া আর সবাই খারাপ, অযোগ্য?

এই যে চারদিকে এতো খারাপ মানুষ, অযোগ্য মানুষের দল এরা কোথাকার মানুষ, কোন দেশের মানুষ?

এরাই কি “আমরা” নয়? এরা কি আমাদের পরিবার, স্বজন, বন্ধু, পরিচিত কেউ নয়?

আয়নার সামনে দাঁড়ালে যে মানুষটাকে দেখা যায় সে কতোটুকু ভালো? কতটুকু যোগ্য?

নিজের ভালোত্ব বাড়ানোর জন্যে জীবনে কী করেছি? দক্ষতা, যোগ্যতা বাড়ানোর জন্যে কী করেছি? দেশের ভালোর জন্যে কী করেছি? নাকি নিজেকে অযোগ্য রেখে দিয়ে দেশকে আশা করেছি যোগ্য হতে? দেশ কি পনের কোটি মানুষের বাইরের কিছু? পনের কোটি মানুষ যদি যোগ্য হয়ে না উঠে, তাহলে দেশ কিভাবে যোগ্য হবে?

৬। এই মৃত্য উপত্যকা আসলে আমি, আপনি, এবং আমাদের আগের প্রজন্মের তৈরি!

কিশোর এবং তরুণ বয়সে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল পড়ালেখা। এর সাথে খেলাধুলা আর কিছু সাংস্কৃতিক কাজে জড়িত হওয়া। আমি এর কোনোটাই ভালোভাবে করতে পারিনি। আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে মেরে আলসেমী করে আমার সময় নষ্ট করেছি। সেজন্যেই আজ আমার কাজে দক্ষতা আন্তর্জাতিক মানের না। আমাদের দেশ যে পিছিয়ে আছে অন্য অনেক দেশ থেকে সে ব্যাপারে আমি অবদান রাখছি।

আমার ধারণা একই কথা আপনার ক্ষেত্রেও সত্যি। সেটা না হলে আপনার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনি এখন আমাদের দেশের জন্যে কিছু করুন এবং আমাদেরকেও পথ দেখান।

আমাদের চেয়ে বড় দোষ আমাদের আগের প্রজন্মের। আমাদের বাবা-মা’র। আমি দুঃখিত আপনার অনুভুতিতে আঘাত লাগলে, কিন্তু আমাদের আগের প্রজন্ম আমাদেরকে একটা জঘন্য বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।

তারা আমাদের একটা স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়েছে সত্যি (সেজন্যে তাদের কাছে সীমাহীন কৃতজ্ঞতা), কিন্তু তারা আমাদের উপহার দিয়েছেন একটা দুর্নীতিতে শ্রেষ্ট দেশ। দেশের প্রতি মায়া-মমতাহীন একদল রাজনীতিবিদ। ছাত্র রাজনীতি নামক ভয়াবহ সন্ত্রাসী এবং পশ্চাদপদ একটা ব্যবস্থা যেটা আমাদের সমাজকে, দেশকে তিলতিল করে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

তারা আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেন নি। যখনি আমি একটা অযোগ্য বালক-বালিকা কিংবা কিশোর-কিশোরী দেখি, তখনি আমার সেই বালক-বালিকা কিংবা কিশোর-কিশোরীর বাবা-মা’র প্রতি এক ধরনের রাগ কাজ করে। বাবা-মা চাইলে সন্তানদের সঠিকভাবে বড় করে তোলা খুব কঠিন কিছু না। আমাদের সীমিত সম্পদ, কিন্তু এটা দিয়েই আমাদের শুরু করতে হবে। কোনো দেশই প্রথমের উন্নত হয়ে শুরু করেনি!

এই অযোগ্য আমি, আপনি, আর আমাদের আগের প্রজন্ম থেকে তৈরি হয়েছে আমাদের রাজনীতিবিদগন, আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা, আমাদের ফুটবলাররা, চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারা, ঘাতক বাস ড্রাইভার, খুনী র‍্যাব-পুলিশ।

৭। পরিবর্তন শুরু হতে হবে নিজের থেকে

যে দেশের স্বপ্ন দেখি আমরা (এবং প্রতিনিয়ত সেই স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ভুগি) সে দেশ পেতে হলে আগে নিজেকে ভালো, যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।

পনের কোটি মানুষের বেশির ভাগ মানুষ যেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলতে পারবে “আমি সত্যিকারভাবে একজন ভালো মানুষ, যোগ্য মানুষ, অন্তত পক্ষে সেরকম হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি” সেদিন শুধুমাত্র আমরা আমাদের স্বপ্নের দেশ পাবো। তার আগ পর্যন্ত কেবল “নিজে ভালো, অন্যরা খারাপ” বলে গলা ফাটিয়ে যাবো, কিংবা বিভিন্ন উন্নত দেশের এম্ব্যাসিতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কোনোমতে এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে পালানোর চেষ্টা করে যাবো।

সমালোচনা

সম্প্রতি আমেরিকান লেখক, দার্শনিক এলবার্ট হাবার্ড একটা দুর্দান্ত উদ্ধৃতি পড়লামঃ “To avoid criticism do nothing, say nothing, be nothing”. অর্থ্যাৎ, সমালোচনা এড়াতে চাইলে কিছু করো না, বলো না, হয়ো না। যার জীবনে কোনো অর্জন নেই, যে পৃথিবী ধ্বংস হলো কি গড়লো এটা নিয়ে মাথা ঘামায়না তাকে নিয়ে কেউ সমালোচনা করার তেমন কিছু খুঁজে পায়না। যখনি আপনি কিছু করতে যাবেন, কিছু একটা বলতে যাবেন, কিছু একটা হতে যাবেন, পৃথিবী দুইভাগ হয়ে যাবে। একদল আপনাকে প্রশংসা করবে, আপনি আরো এগিয়ে যান সেই কামনা করবে, আর আরেকদল আপনার মুন্ডুপাত করবে। জীবনের বাস্তবতায় স্বাগতম!

পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষটির বিরুদ্ধেও অনেক সমালোচনা হয়। সত্যিকথা বলতে কি, “সবচেয়ে ভালো মানুষ” নামে কিছুর আসলে অস্তিত্ব নেই। আপনার কাছে যিনি অনেক ভালো মানুষ, অনেক শ্রদ্ধার পাত্র, অন্যের কাছে তিনি হয়তো ততোটাই বাজে লোক।

আমরা মানুষেরা আমাদের পরিবেশের দ্বারা তৈরি। আমরা যে পরিবেশে বড় হয়েছি, আমাদের বাবা-মা আমাদের যে শিক্ষা আর মূল্যবোধ শিখিয়েছেন, আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যা শিখেছি, চারদিকের পরিচিত আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধব থেকে আমরা যে জ্ঞ্যান লাভ করেছি, বই-পত্র-টেলিভিশন-সিনেমা ইত্যাদি থেকে আমরা সংস্কৃতি-চেতনা শিখছি, সেসব ব্যবহার করে আমরা আমাদের চারপাশকে বিচার করি, মূল্যায়ন করি। এবং প্রত্যেক মানুষের বড় হয়ে উঠা, শিক্ষার বিষয়বস্তু একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন। ফেইসবুক, টুইটারের কল্যানে মানুষের “সামাজিক গ্রাফ” দেখা যায় এখন। এই সামাজিক গ্রাফ থেকেই মানুষ তার বিচার-বিবেচনা তৈরি করে, পৃথিবীকে দেখার লেন্স বানায়।

আমি অনেক মেধাবী এবং গুনী মানুষকে চিনি যারা শুধু উটকো সমালোচনার ভয়ে নিজের নিরাপদ বলয়ের বাইরে বের হননা। “কী দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে, ভালোই তো আছি” – এটা হচ্ছে তাদের চিন্তা। এবং তাদেরকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতির সাথে সাথে আমাদের সমালোচনার বারুদও অনেক তাড়াতাড়ি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপনি হয়তো কোনো গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্যে একটা স্কুল করে দিলেন। দুইটা পত্রিকায় আপনাকে নিয়ে বিশাল প্রশংসাসূচক লেখা ছাপা হতে না হতেই অন্য তিনটা পত্রিকায় আপনার নামে যাবতীয় কুৎসা ছড়ানো হবে। পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, কর্পোরেট শক্তির ইন্ধনে আপনি যে স্কুলের নাম করে তলে তলে বিশাল ষড়যন্ত্র করে বসে আছেন সেটা নিয়ে অনেক কেচ্ছা কাহিনী ছাপানো হবে। অথচ আপনি শুধু ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার একটা ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন, এই যা।

আমি যখন প্রথম বিদেশে পড়তে আসি তখন এখানকার একজন বাংলাদেশী অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন বাংলাদেশে একজন মানুষের ক্ষতি করা অনেক সহজ কিন্তু কারো উপকার করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। তাঁর কথাটি ভালো করে বুঝিনি তখন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কেনো তিনি ওরকম একটি কথা বলেছিলেন। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা চারদিকের নেগেটিভ জিনিসে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে এখন আর মানুষের ভালোত্বে বিশ্বাস করি না সহজে। কেউ যে বিনা কারণে ভালো হতে পারে, স্বার্থহীন হতে পারে এটা বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হয়।

আমি সবসময় যে উপমাটার কথা ভাবি আমাদের বিচার-বিবেচনা নিয়ে সেটা হলোঃ আমরা আমাদের চারপাশকে হয় গাফফার চৌধুরী কিংবা শফিক রেহমানের দৃষ্টিতে দেখি। এই দুইজন মেধাবী মানুষ বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের আইকন সমর্থক। “সূর্য পূর্বদিকে উঠে” এটা নিয়ে রচনা লিখতে দিলে এরা খুব সুন্দর করে প্রমান করতে পারবে সূর্য পূর্বদিকে উঠাটা কিভাবে হাসিনার/খালেদার কৃতিত্ব কিংবা আওয়ামীলীগ/বিএনপির ষড়যন্ত্র। কোনো কিছু সাদাকালো চোখে দেখার ক্ষমতা এরা হারিয়ে ফেলেছেন। স্পেইডকে স্পেইড বলার ক্ষমতা আর এদের নাই। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে আমাদেরও সবসময় একটা পক্ষ নিয়েই পৃথিবীটাকে দেখতে হবে। হয় আওয়ামীলীগ, না হয় বিএনপি, না হয় জামাত, না হয় সমাজতন্ত্র।

আমাদের একদল ডক্টর ইউনুসকে শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি তিনি মানুষের ভালো করতে চান। ভালো করতে পারছেন কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ সেটা আমরা বিশ্বাস করি। আবার আরেকদল বিশ্বাস করি তিনি পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, কর্পোরেটবাদী, সামন্ততান্ত্রিক বিশ্ব মোড়লদের প্রতিনিধি। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র্য দূর করার নামে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের কাছে পাচার করা। আমাদের একদল মানুষ জাফর ইকবাল স্যারের নামে পাগল, আবার আরেকদল তাঁকে ইসলাম এর শত্রু, আওয়ামীলীগের দালাল মনে করে। অনেকে প্রথম আলোকে একটা সৎ পত্রিকা মনে করি, অন্তত সৎ থাকার চেষ্টা করে বলে মনে করি। আরেকদল ভাবি প্রথম আলো সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার। একইভাবে বড় বড় বহুজাতিক কম্পানীগুলোকে আমরা মনে করি শয়তানের দোসর, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের গরীব মানুষদেরকএ শোষণ করে সব টাকা বিদেশে পাচার করা।

আমাদের অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয় আমেরিকা, ভারত এবং অন্যদের চক্রান্তের কথা ভেবে ভেবে। আজকে আমেরিকা যে এতো উন্নত হয়ে উঠেছে এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সব টাকা শোষণ করে হয়েছে। এবং অন্যনায় গরীব দেশেরও। আচ্ছা আমেরিকা না হয় বিশ্ব মোড়ল। সুইজারল্যান্ড এর কথা ধরি। কিংবা ফিনল্যান্ড। অথবা নিউজিল্যান্ড। এরা এতো উন্নত হয়েছে কোন দেশকে শোষণ করে? কখনোতো শুনিনি এই দেশগুলো অন্যে দেশকে মিয়ে মাথা ঘামাতে। কাউকে শোষণ না করে যে শুধুমাত্র একটা চমৎকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস, মানুষের ভালো কামনা করে যে উন্নত হওয়া যায় সেটা তো আমেরিকা আর ইংল্যান্ড কে বাদ দিয়ে বাদবাকী উন্নত দেশগুলোর দিইকে তাকালেই বুঝা যায়। জীবন যে কতো সুন্দর হতে পারে, জীবন-যাপন যে কতো আরামদায়ক হতে পারে আধুনিক সভতার কল্যানে সেটা এসব উন্নত দেশে গেলে বুঝা যায়। আমরা কবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নিয়ে বেহুদা চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশটাকে সেরকম উন্নত করতে পারবো?

আমরা কেনো উন্নত হতে পারছিনা? আমাদের কেনো মনে হয় চারদিকের সবাই খারাপ, সবাই ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী? আমি আমার সাম্প্রতিক একটা লেখায় বলেছিলামঃ

“যেসব মানুষের নিজের উপর শ্রদ্ধা কম তারা বেশি (কু)সংস্কারে ভোগে। অর্থাৎ যেসব মানুষ আসলে নিজের যোগ্যতা নিয়ে খুশি নয়, নিজের উপর নিজের খুব বেশি শ্রদ্ধা নাই, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে, তারা সাধারণত মানুষকে নিয়ে বেশি নেগেটিভ কথা বলে। অন্যের ভালো কিছু দেখলে তারা সহজে খুশি হতে পারেনা, তাদের প্রথম চিন্তাটি হয় নেগেটিভ। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতে পারেনা এরা।”

আমরা যদি বিশ্বাস করি ইউনুস খারাপ তাহলে কেনো আমরা নিজেরা একটা নতুন মডেলের প্রতিষ্ঠান গড়ে ভালো কাজটি করে দেখাইনা? প্রথম আলো খারাপ; ঠিক আছে, তাহলে ভালো পত্রিকা কোনটি? একটাও না? আপনি নিজে একটা পত্রিকা বানিয়ে দেখিয়ে দিন ভালো পত্রিকা কেমন হতে পারে। ফোন কম্পানীগুলো খারাপ? দেশের গরীব মানুষের টাকা চুষে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে? চলেন আমরা নতুন একটা ফোন কম্পানী বানাই। কিংবা আমাদের সরকারকে চাপ দেই যাতে এমন আইন তৈরি করে যেটা দিয়ে মানুষের স্বার্থ রক্ষা হবে আরো ভালো করে। হাজার হোক সরকার তো আমাদের, ওরা তো আর বিদেশী শক্তি নাই।

দুঃখজনকভাবে একই কথা খাটে আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আমরা সবাই (এই লেখকসহ) রাজনীতিবিদদের ঢালাও সমালোচনা করি, কিন্তু আমরা কেউই নিজেরা রাজনীতিতে জড়াতে চাইনা। হাসিনা-খালেদার হাজার দোষত্রুটি সত্ত্বেও ওরাই কিন্তু রাজনীতি নামের কষ্টকর পেশাটি করে যাচ্ছে, এবং আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের জন্যে মোটামুটি সন্তোষজনক একটা জিডিপি বৃদ্ধির হার বজায় রেখেছে গতো দুই দশক ধরে। আমরা আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ বানাতে চাই, কিন্তু রাজনীতিবিদ বানাতে চাইনা। মেধাবী ছেলেমেয়েরা যদি রাজনীতিতে না যায়, তাহলে ছাত্রদল-ছাত্রলীগের ছাত্ররাজনীতিবিদ নামের অর্ধশিক্ষিত ছাত্ররা রাজনীতিতে যেয়ে দেশের ভবিষ্যতের আরো বারোটা বাজাবে। আমি জানি রাজনীতিতে যোগ দেওয়া অনেক কঠিন, বর্তমান রাজনীতিবিদ এবং ছাত্ররাজনীতির গুন্ডারা এটাকে আরো কঠিন করে রেখেছে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। কিন্তু তাই বলে তো বসে থাকলে চলবেনা, একটা না একটা পথ বের করতেই হবে এটাকে সংশোধনের জন্যে। রাজনীতির বাইরে থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে এই ট্রেন্ড পরিবর্তন করার।

যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পৃথিবীতে “নিখুঁত” বলে কিছু নেই। মানুষও নিখুঁত হতে পারেনা। পরম শদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সাইদ স্যারকে নিয়েও কতো বাজে কথা শুনেছি। এবং এটা হবেই। এর একটা ভালো দিক হচ্ছে সমালোচনা আমাদেরকে, আমাদের কাজকে আরো শুদ্ধ করে। “নিখুঁতত্ত্ব” এর দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায় সমালোচনার মাধ্যমে। যতোদিন মানুষ থাকবে ততোদিন মানুষের ভিন্ন মত থাকবে। ঘটনাক্রমে এটা গণতন্ত্র নামক শাসন ব্যাবস্থার সৌন্দর্য্য! পৃথিবীর সব উন্নত দেশগুলোতে যে কার্যকর একটা গণতন্ত্র আছে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!

যারা সমালোচনার ভয়ে বসে না থেকে নিজের মনের কথা বলে ফেলে, দেশের জন্যে কিছু একটা করার চেষ্টা করে ফেলে, নিজে কিছু একটা হতে চেষ্টা করে তাদের নিয়ে প্রয়াত আমারিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট একটা যুগান্তকারী কথা বলেছিলেনঃ

“It’s not the critic who counts, not the man who points out how the strong man stumbled, or when the doer of deeds could have done better. The credit belongs to the man who is actually in the arena; whose face is marred by dust and sweat and blood; who strives valiantly; who errs and comes short again and again; who knows the great enthusiasms, the great devotions and spends himself in a worth cause; who at the best, knows in the end the triumph of high achievement; and who at the worst if he fails, at least fails while daring greatly, so that his place shall never be with those cold and timid souls who know neither victory nor defeat।”

অনুবাদঃ

যারা সমালোচনা করছে তারা গুরুত্মপূর্ণ না। যারা আঙ্গুল উঁচু করে দেখিয়ে দিচ্ছে শক্ত মানুষটি কিভাবে হোঁচট খাচ্ছে তারাও গুরুত্মপূর্ণ না। যারা বাইরে থেকে উপদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছে কিভাবে কাজটা আরো ভালোভাবে করা যেতো ওরাও গুরুত্মপূর্ণ না। সব কৃতিত্ব হচ্ছে তাঁর যিনি আসলে সত্যিকার মাঠে নেমে যুদ্ধ করছেন। যাঁর মুখ এবং দেহ ধূলা, ঘামে, এবং রক্তে রঞ্জিত। যিনি জীবন দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যিনি বারবার ভুল করছেন এবং জয়ের একেবারে শেষ মাথায় এসে পৌঁছাচ্ছেন। যিনি চরম উৎসাহ, আগ্রহ, সাধনা নিয়ে নিজেকে একটা অর্থপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করেছেন। যিনি বিজয়ী হওয়ার কৃতিত্বের কথা জানেন, কিংবা যদি জয়ী হতে নাও পারেন, অন্ততপক্ষে বীরের মতো চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অতএব, তাঁর স্থান কখনোই সেইসব ভীরু এবং দূর্বল মানুষের সাথে হবেনা যারা জয় কিংবা পরাজয় কোনোটার স্বাদ কখনো পায়নি।