Category Archives: nature

অপরাজিত – ২

Boat_in_river,_Bangladesh

Image source: http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/6/66/Boat_in_river%2C_Bangladesh.jpg

(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর “অপরাজিত” উপন্যাস থেকে নেওয়া)

ইছামতী এই চঞ্চল জীবনধারার প্রতীক। ওর দু’পাড় ভরিয়া প্রতি চৈত্র বৈশাখে কত বনকুসুম, গাছপালা, পাখি-পাখালি, গাঁয়ে গাঁয়ে গ্রামের ঘাট – শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া কত ফুল ঝরিয়া পড়ে, কত পাখির দল আসে যায়, ধারে ধারে কত জেলেরা জাল ফেলে, তীরবর্তী গৃহস্তবাড়িতে হাসি-কান্নার লীলাখেলা হয়, কত গৃহস্ত আসে, কত গৃহস্ত যায় – কত হাসিমুখ শিশু মায়ের সঙ্গে নাহিতে নামে, আবার বৃদ্ধাবস্থায় তাহাদের নশ্বর দেহের রেণু কলস্বনা ইছামতীর স্রোতোজলে ভাসিয়া যায় – এমন কত মা, কত ছেলেমেয়ে, তরুণতরুণী মহাকালের বীথিপথে আসে যায় – অথচ নদী দেখায় শান্ত, স্নিগ্ধ, ঘরোয়া, নিরীহ…

আজকাল নির্জনে বসিলেই তাহার মনে হয়, এই পৃথিবীর একটা আধ্যাত্মিক রুপ আছে, এর ফুলফল, আলোছায়ার মধ্যে জন্মগ্রহণ করার দরুণ এবং শৈশব হইতে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার দরুণ এর প্রকৃত রুপটি আমাদের চোখে পড়ে না। এ আমাদের দর্শন ও শ্রবণগ্রাহ্য জিনিসে গড়া হইলেও আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও ঘোর রহস্যময়, এর প্রতি রেণু যে  অসীম জটিলতায় আচ্ছন্ন – যা কিনা মানুষের বুদ্ধি ও কল্পনার অতীত, এ সত্যটা হঠাৎ চোখে পড়ে না। যেমন সাহেব বন্ধুটি বলিত, “ভারতবর্ষের একটা রুপ আছে, সে তোমরা জান না। তোমরা এখানে জন্মেছ কিনা, অতি পরিচয়ের দোষে সে চোখ ফোটে নি তোমাদের।”

আকাশের রঙ আর এক রকম – দূরের সে গহন হিরাকসের সমুদ্র ঈষৎ কৃষ্ণাভ হইয়া উঠিয়াছে – তার তলায় সারা সবুজ মাঠটা, মাধবপুরের বাঁশবনটা কি অপূর্ব, অদ্ভুত, অপার্থিব ধরনের ছবি ফুটাইয়া তুলিয়াছে!… ও যেন পরিচিত পৃথিবীটা নয়, অন্য কোনো অজানা জগতের কোনো অজ্ঞাত দেবলোকের…

প্রকৃতির একটা যেন নিজস্ব ভাষা আছে। অপু দেখিয়াছে, কতদিন বক্রতোয়ার উপল-ছাওয়া-তটে শাল ঝাড়ের নিচে ঠিক দুপুরে বসিয়া – দূরে নীল আকাশের পটভূমিতে একটা পত্রশূন্য প্রকান্ড কি গাছ – সেদিকে চাহিলেই এমন সব কথা মনে আসিত যা অন্য সময় আসার কল্পনাও করিতে পারিত না – পাহাড়ের নিচে বনফলের জঙ্গলেরও একটা কি বলিবার ছিল যেন। এই ভাষাটা ছবির ভাষা – প্রকৃতি এই ছবির ভাষায় কথা বলেন – এখানেও সে দেখিল গাছপালায়, উইঢিপির পাশে শুকনো খড়ের ঝোপে, দূরের বাঁশবনের সারিতে – সেই সব কথাই বলে – সেই সব ভাবই মনে আনে। প্রকৃতির এই ছবির ভাষাটা সে বোঝে। তাই নির্জন মাঠে, প্রান্তরে, বনের ধারে একা বেড়াইয়া সে যত প্রেরণা পায় – যে পুলক অনুভব করে তা অপূর্ব – সত্যিকার Joy of Life – পায়ের তলার শুকনো লতা-কাটি, দেয়াড়ের চরে রাঙ্গা-রোদ-মাখানো কষাড় ঝোপ, আকন্দের বন, ঘেঁটুবন – তার আত্মাকে এরা ধ্যানের খোরাক যোগায়, এ যেন অদৃশ্য স্বাতী নক্ষত্রের বারি, তারই প্রাণ মুক্তার দানা বাঁধে।

সন্ধার পুরবী কি গৌরীরাগিণীর মতো বিষাদ-ভরা আনন্দ, নির্লিপ্ত ও নির্বিকার – বহুদূরের ওই নীল কৃষ্ণাভ মেঘরাশি, ঘন নীল, নিথর, গহন আকাশটা মনে যে ছবি আঁকে, যে চিন্তা যোগায়, তার গতি গোমুখী-গঙ্গার মতো অনন্তের দিকে, সে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কথা বলে, মৃত্যুপারের দেশের কথা কয়, ভালবাসা-বেদনা-ভালবাসিয়া হারানো – বহুদূরের এক প্রীতিভরা পুনর্জন্মের বাণী…

এইসব শান্ত সন্ধ্যায় ইছামতীর তীরের মাঠে বসিলেই রক্তমেঘস্তুপ ও নীলাকাশের দিকে চাহিয়া চারিপাশের সেই অনন্ত বিশ্বের কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে বাল্যে এই কাঁটাভরা সাঁইবাবলার ছায়ায় বসিয়া মাছ ধরিতে ধরিতে সে দূর দেশের স্বপ্ন দেখিত – আজকাল চেতনা তাহার বাল্যের সে ক্ষুদ্র গন্ডি পার হইয়া ক্রমেই দূরে আলোকের পাখায় চলিয়াছে – এই ভাবিয়া এক এক সময় সে আনন্দ পায় – কোথাও না যাক – যে বিশ্বের সে একজন নাগরিক, তা ক্ষুদ্র, দীন বিশ্ব নয়। লক্ষ কোটি আলোক-বর্ষ যার গণনার মাপকাঠি, দিকে দিকে অন্ধকারে ডুবিয়া ডুবিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকাদের দেশ, অদৃশ্য ইথারের বিশ্ব যেখানে মানুষের চিন্তাতীত, কল্পনাতীত দূরত্বের ক্রমবর্ধমান পরিধিপানে বিস্তৃত – সেই বিশ্বে সে জন্মিয়াছে…

milky-way

ঐ অসীম শূন্য কত জীবলোকে ভরা – কি তাদের অদ্ভুত ইতিহাস! অজানা নদীতটে প্রণয়ীদের কত অশ্রুভরা আনন্দতীর্থ – সারা শূন্য ভরিয়া আনন্দস্পন্দনের মেলা – ইথারের নীল সমুদ্র বাহিয়া বহু দূরের বৃহত্তর বিশ্বের সে-সব জীবনধারার ঢেউ প্রাতে, দুপুরে, রাতে, নির্জনে একা বসিলেই তাহার মনের বেলায় আসিয়া লাগে – অসীম আনন্দ ও গভীর অনুভূতিতে মন ভরিয়া ওঠে – পরে সে বুঝিতে পারে শুধু প্রসারতার দিকে নয় – যদিও তা বিপুল ও অপরিমেয় – কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চেতনা-স্তরের আর একটা Dimension যেন তার মন খুঁজিয়া পায় – এই নিস্তব্দ শরত-দুপুর যখন অতীতকালের এমনি এক মধুর মুগ্ধ শৈশব-দুপুরের ছায়াপাতে স্নিগ্ধ ও করূণ হইয়া ওঠে তখনই সে বুঝিতে পারে চেতনার এ স্তর বাহিয়া সে বহুদূর যাইতে পারে – হয়তো কোনো অজ্ঞাত সৌন্দর্যময় রাজ্যে, দৈনন্দিন ঘটনার গতানুগতিক অনুভূতিরাজি ও একঘেয়ে মনোভাব যে রাজ্যের সন্ধান দিতে পারিতই না কোনোদিন…

নদীর ধারে আজিকার এই আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর নব রুপ সে দেখিতে পাইল। মনে হইল, যুগে যুগে এ জন্মমৃত্যুচক্র কোন বিশাল-আত্মা দেবশিল্পীর হাতে আবর্তিত হইতেছে – তিনি জানেন কোন জীবনের পর কোন অবস্থার জীবনে আসিতে হয়, কখনো বা বৈষম্য – সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি – বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট-

ছ’হাজার বছর আগে হয়তো সে জন্মিয়াছিল প্রাচীন ঈজিপ্টে – সেখানে নলখাগড়া প্যাপিরাসের বনে, নীলনদের রৌদ্রদীপ্ত তটে কোন দরিদ্র ঘরের মা বোন বাপ ভাই বন্ধুবান্ধবদের দলে কবে সে এক মধুর শৈশব কাটাইয়া গিয়াছে – আবার হয়তো জন্ম নিয়াছিল রাইন নদীর ধারে – কর্ক-ওক, বার্চ ও বীচবনের শ্যামল ছায়ায় বনেদি ঘরের প্রাচীন প্রাসাদে, মধ্যযুগের আড়ম্বরপূর্ণ আবহাওয়ায়, সুন্দরমুখ সখীদের দল। হাজার হাজার বছর পর হয়তো সে আবার ফিরিয়া আসিবে – তখন কি মনে পড়িবে এবারকার জীবনটা? – কিংবা কে জানে আর হয়তো এ পৃথিবীতে আসিবে না – ওই যে বটগাছের সারির মাথায় সন্ধ্যার ক্ষীণ প্রথম তারকাটি – ওদের জগতে অজানা জীবনধারার মধ্যে হয়তো এবার নবজন্ম! – কতবার যেন সে আসিয়াছে… জন্ম হইতে জন্মান্তরে, মৃত্যু হইতে মৃত্যুর মধ্য দিয়া… বহু দূর অতীতে ও ভবিষ্যতে বিস্তৃত সে পথটা যেন সে বেশ দেখিতে পাইল… কত নিশ্চিন্দিপুর, কত অপর্ণা, কত দুর্গা দিদি – জীবনের ও জন্মমৃত্যুর বীথিপথ বাহিয়া ক্লান্ত ও আনন্দিত আত্মার সে কি অপরুপ অভিযান… শুধু আনন্দে, যৌবনে, পুণ্যে ও দুঃখে, শোকে ও শান্তিতে…। এই সবটা লইয়া যে আসল বৃহত্তর জীবন – পৃথিবীর জীবনটুকু যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র – তার স্বপ্ন যে শুধুই কল্পনাবিলাস, এ যে হয় তা কে জানে – বৃহত্তর জীবনচক্র কোন দেবতার হাতে আবর্তিত হয় তা কে জানে?… হয়তো এমন সব প্রাণী আছেন যাঁরা মানুষের মতো ছবিতে, উপন্যাসে, কবিতায় নিজেদের শিল্পসৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন না – তাঁরা এক এক বিশ্ব সৃষ্টি করেন – তার মানুষের সুঝে-দুঃখে উখথানে-পতনে আত্মপ্রকাশ করাই তাঁদের পদ্ধতি – কোন মহান বিবর্তনের জীব তাঁর অচিন্ত্যনীয় কলাকুশলতাকে গ্রহে গ্রহে নক্ষত্রে নক্ষত্রে এ-রকম রুপ দিয়াছেন – কে তাঁকে জানে?…

একটি অবর্ণনীয় আনন্দে, আশায়, অনুভূতিতে, রহস্যে মন ভরিয়া উঠিল। প্রাণবন্ত তার আশা, সে অমর ও অনন্ত জীবনের বাণী বনলতার রৌদ্রদগ্ধ শাখাপাত্রের তিক্ত গন্ধ আনে – নীলশূন্যে বালিহাঁসের সাঁই সাঁই রব শোনায়। সে জীবনের অধিকার হইতে তাহাকে কাহারো বঞ্চনা করিবার শক্তি নাই – তার মনে হইল সে দীন নয়, দুঃখী নয়, তুচ্ছ নয় – ওটুকু শেষ নয়, এখানে আরম্ভও নয়। সে জন্মজন্মান্তরের পথিক আত্মা, দূর হইতে কোন সুদূরের নিত্য নূতন পথহীন পথে তার গতি, এই বিপুল নীল আকাশ, অগণ্য জ্যোতির্লোক, সপ্তর্ষিমন্ডল, ছায়াপথ, বিশাল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার জগৎ, বহির্ষদ পিতৃলোক, – এই শত সহস্র শতাব্দী, তার পায়ে-চলার পথ – তার ও সকলের মৃত্যুদ্বারা অস্পৃষ্ট সে বিরাট জীবনটা নিউটনের মহাসমুদ্রের মতো করলেই পুরোভাগে অক্ষুন্নভাবে বর্তমান – নিঃসীম সময় বাহিয়া সে গতি সারা মানব যুগে বাধাহীন হউক।…

অপু তাহাদের ঘাটের ধারে আসিল। ওইখানটিতে এমন এক সন্ধ্যার অন্ধকারে বনদেবী বিশালাক্ষী স্বরুপ চক্রবর্তীকে দেখা দিয়াছিলেন কতকাল আগে!

আজ যদি আবার তাহাকে দেখা দেন!

– তুমি কে?
– আমি অপু।
– তুমি বড় ভালো ছেলে। তুমি কি বর চাও?
– অন্য কিছু চাই নে, এ গাঁয়ের বনঝোপ, নদী, মাঠ, বাঁশবনের ছায়ায় অবোধ, উদ্গ্রীব,  স্বপ্নময় আমার সেই যে দশ বৎসর বয়সের শৈশবটি – তাকে আর একটি বার ফিরিয়ে দেবে দেবী? –

“You enter it by the Ancient way
Through Ivory Gate and Golden”

হেমন্ত – দেশে ও বিদেশে

fallleaves00831

এখানে এখন হেমন্ত কাল চলছে। অবশ্য চলছে বলা ঠিক হবে না, চলে যাচ্ছে। আমেরিকাতে হেমন্ত বেশিদিন থাকে না। কিন্তু যে কয়দিন থাকে সে সময়টাতে পুরো প্রকৃতি অপার্থিবভাবে রঙ্গিন হয়ে উঠে। সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য।

blue-sky51

যখনি এখানে হেমন্ত আসে তখনি আমার মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের হেমন্তের কথা। বাংলাদেশেও হেমন্ত খুব একটা বেশি সময় ধরে থাকে না। নভেম্বর মাসটাই মূলত হেমন্ত। হেমন্তের আকাশ থাকে অবিশ্বাস্য রকমের নীল। পুরো আকাশ জুড়ে শুধু নীলের খেলা। সারা আকাশে এক ফোটা মেঘের দেখা নেই। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ ধীরে ধীরে কোমল হয়ে আসে। শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত আসতে আসতে সেই রোদ হয়ে উঠে অতি মনোরম। ফসলের মাঠ হয়ে উঠে সবুজ আর হলুদ।

দেশে থাকতে হেমন্ত আমাকে কেমন অন্যরকম করে তুলতো। বাতাসে, রোদ্দুরে কেমন যেন মিষ্টি একটা ভাব। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিশ্বাস নিলেই প্রকৃতির সতেজতাকে নিজের ভেতরে নিয়ে যাওয়া যায়। আকাশটা মনে হতো বিশাল বক্ষ হয়ে পৃথিবীর অনেক কাছে চলে এসেছে। চৈত্রের আকাশে চিলেরা ডানা মেলে যেভাবে ঘুরে ঘুরে উড়ে, হেমন্তের আকাশে আমার ঠিক তেমনি উড়তে ইচ্ছে করতো। আমার মুক্ত আকাশে স্কাই ডাইভিং করার ইচ্ছেটা মনে হয় এই হেমন্তের আকাশ দেখেই হয়েছে!

ঢাকাতে তো আকাশ দেখার মতো খোলা জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। সৌভাগ্যক্রমে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে ঢাকার বাইরে, সিলেটে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শহরের বাইরে, একেবারে গ্রাম এলাকায়। চারদিকে ছিল ছোট-বড় টিলা। আর অনেক দূরে, দিগন্তের কাছাকাছি ছিল ভারতের উঁচু উঁচু পাহাড়। ওগুলো ছিল হিমালয় থেকে বের হওয়া শাখাপ্রশাখা। ছোট-বড় পাহাড়ের পেছনে আদিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ যে কতো সুন্দর সেটা যারা দেখেনি তাদের বলে বোঝানো যাবে না। কাছের সবুজ পাহাড় কিংবা দূরের কালচে নীল পাহাড় আঁকাবাঁকা হয়ে মিশে গেছে দিগন্তে, সে এক অপূর্ব দৃশ্য!

হেমন্তের সারা দিন ধরে চলে মিষ্টি, মায়াবী আলোর খেলা। আকাশে আলো, বাতাসে আলো, আলো আমার চোখে, আলো আমার মুখে, আলো আমার প্রাণে… আমি গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি – “আলো আমার আলো, ওগো আলো ভুবন ভরা, আলো নয়ন ধোয়া আমার আলো হৃদয় হরা; নাচে আলো নাচে ও ভাই আমার প্রাণের কাছে, বাজে আলো বাজে ও ভাই হৃদয় বীণার মাঝে…”। এ আলো গ্রীষ্মের খররৌদ্রতপ্ত আলো নয়, এ আলো এক অতি মনোরম মনপ্রাণ জাগানিয়া আলো। আর সন্ধ্যার গোধূলীর আলো তো এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পুরো পশ্চিম আকাশ জুড়ে চলে লাল এর খেলা। এ লাল রঙ কোন পৃথিবীর রঙ নয়, সে এক অপার্থিব ধরণের আলোর নাচ চলে হেমন্তের সন্ধ্যা গুলোতে। সিলেটের সন্ধ্যার আকাশ
আমার চেয়ে কেউ বেশি সময় নিয়ে দেখেছে বলে মনে হয় না!

বাংলাদেশের হেমন্ত যেমন গাঢ় নীল আকাশ আর মনোরম আলো দিয়ে চেনা যায়, আমেরিকার হেমন্ত তেমনি চেনা যায় গাছের পাতা রঙ্গিন হয়ে উঠা এবং কিছুদিন পর তার ঝরে যাওয়া দেখে। এখানে হেমন্তকে বলা হয় “Fall”, যার অর্থ পতন বা পড়া। এখানে প্রায় সব গাছের পাতা ঝরে পড়ে হেমন্তে। কিন্তু পাতা ঝরে পড়ার আগে সেগুলো বিচিত্র সব রঙ ধারণ করে। সেই রঙ এর বর্ণনা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এতো সুন্দর সেই রঙের বাহার, এতো বিচিত্র রকমের সেই রঙগুলো, সেই রঙ দেখলে সাথে সাথে মনেও তা ধরে যায়। লাল, হলুদ, আর সবুজের যতো রকমফের সম্ভব আমেরিকার হেমন্তে সেই সব রঙ দেখা যায় গাছের পাতাতে।

প্রকৃতি মনে হয় ভয়াবহ সৌন্দর্য্য বেশিক্ষণ রাখতে চায় না আমাদের সামনে। তাই হেমন্তও বেশিদিন থাকে না কোথাও। বাংলাদেশে নীল আকাশের বুকে স্বপ্নের উড়াউড়ি শুরু না হতেই আস্তে আস্তে শীত চলে আশে কুয়াশার চাদরে, নরম রোদের সূর্যটাকে আরো নরম করে দিয়ে। আমেরিকায় গাছের পাতাগুলির রঙ্গে মন রাঙ্গানোর সাথে সাথেই শুরু হয় পাতা ঝরা। রাস্তাঘাট সব ভরে যায় মরা, নিস্তেজ রঙ্গিন পাতায়। আর কনকনে শীতের বাতাস ঝাপ্টা দিয়ে জানিয়ে দেয় সে আসছে…

হেমন্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবনের উপভোগের বস্তুগুলোর স্বল্পস্থায়ীত্বের কথা। এ জীবনে কিছুই থাকে না চিরকাল ধরে। না সুখ, না স্বপ্ন, না সৌন্দর্য্য। কিন্তু সুখ-স্বপ্ন-সৌন্দর্য্য উপভোগ করার ইচ্ছা ও মানসিকতা থাকলে ওগুলো ঘুরে ফিরে আসতেই থাকবে, আমাদের শুধু চোখ মেলে দেখতে হবে চারপাশে।

Tagged , , , , ,