Monthly Archives: August 2011

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি – ২

পর্ব – ১

৬. মানুষকে কোনো কিছু বিশ্বাস করানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিজে একটা চমৎকার জীবন যাপন করা

কথা কিংবা যুক্তি-তর্ক দিয়ে মানুষকে যতোটা না বুঝাতে পারবেন, যেটার কথা বলছেন সেটা নিজে করে তার চেয়ে অনেক ভালো বুঝাতে পারবেন। যখন মানুষ আপনাকে দেখবে, আপনার কাজ দেখবে, তখন আপনার ওদেরকে আর আলাদাভাবে বিশ্বাস করানোর দরকার হবে না। তাদেরকে শুধু বলুন আপনি আপনার কাঙ্খিত জিনিসটি অর্জন করেছেন, জীবনে যেখানে পৌঁছাতে চান সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন কিংবা সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন। এরপর তাদেরকে জানান কীভাবে আপনি সেটা অর্জন করলেন বা করছেন। তাহলেই সবাই বুঝতে পারবে আপনি আসলে ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছেননা শুধু।

৭। পৃথিবীর কেউই সবকিছু জেনে বা পেয়ে বসে নেই

সবারই কিছু না কিছু সমস্যা আছে, কিন্তু তারা সেটা গোপন করে চলে। আপনি যখন একজন মানুষকে দেখেন তখন শুধু সে তাকে যেভাবে বাইরের পৃথিবীর কাছে দেখাতে চায় সেটাই দেখেন। আপনি হয়তো ভাবতেও পারবেন না তারা কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, কিংবা যে সুখী অবস্থায় তাদের দেখছেন সে অবস্থায় আসতে তাদের কীসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এটা সবার জন্যে সত্যি – কোটিপতি, ছাত্রছাত্রী, স্মার্ট তরুণ-তরুণী, লাজুক মানুষটি, এবং আর যেকোনো ধরণের মানুষই বলুন না কেনো, তাদের সবারই ভেতরের একটা জগত আছে – বাইরে থেকে তাদেরকে যেমনই মনে হোক না কেনো।

কারো সম্পর্কে সবকিছু জানার আগে কখনোই ভাববেন না সে খুব সহজে জীবনে সবকিছু পেয়ে গেছে।

৮। “আমি জানিনা” – এটা বলায় কোনো লজ্জা নাই

অনেকে কোনো বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করায় লজ্জা পান। এটা নিয়ে কোনো ভাবাভাবির অবকাশ নাই – জাস্ট বলে ফেলুন “আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে জানিনা”। অজ্ঞতা লুকানোর চেয়ে সততা অনেক বেশি স্মার্ট একটা ব্যাপার।

৯। আরো বেশি টাকা কখনোই আপনার সব সমস্যার সমাধান করবে না

আপনার যদি খাবার এবং থাকার জন্যে পর্যাপ্ত টাকা থাকে তাহলে এরচেয়ে বেশি টাকা ছাড়াও আপনি জীবন চালিয়ে নিতে পারবেন। এটা আরো ভালো করে বুঝতে পারবেন যদি আপনি অসচ্ছল অথচ মোটামুটি সুখী এমন মানুষদের সাথে মিশেন। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলি পেতে কোনো টাকা লাগেনা, আর বাদবাকী জিনিসগুলো আপনি যতো দামী ভাবছেন ততোটা দামী না।

১০। আপনার সম্পদ আপনাকে কিনে নেয়

সত্যিকারের দরকারী জিনিসগুলো ছাড়া মানুষের অন্যান্য দামী সম্পত্তি-সম্পদ আসলে অন্যের কাছ থেকে স্বীকৃতি বা এক ধরণের লোক দেখানো ছাড়া কিছুই না। বেঁচে থাকা এবং জীবন যাপনে সুবিধার জন্যে দরকারী না হলে এসব দামী জিনিসপত্র ছাড়া আপনি অনায়াসে আপনার জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন।

যখন আপনি জীবনে দামী জিনিসপত্র ছাড়া চলতে পারবেননা তখন এই জিনিসপত্রগুলি আপনার জীবনকে পরিচালিত করবে। আপনার দামী বাড়ি বা ফ্ল্যাট এবং ঘরের দামী ফার্নিচার থাকার কারণে আপনি অন্য জায়গায় সহজে চলে যেতে পারবেন না, এবং এগুলো পাওয়ার জন্যে আপনাকে সবসময় অনেক বেশি উপার্জন করা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এবং আমার ধারণা এইসব দামী সম্পদ আপনার জীবনকে খুব বেশি সমৃদ্ধ করেনা। জীবনে যতো কম সম্পদ থাকবে ততোই আসলে ভালো।

১১। টেলিভিশনের মতো সময় অপচয়কারী বস্তু পৃথিবীতে আর কিছু নাই

আমার বয়স একুশ হওয়ার আগে আমি টিভি দেখে আমার জীবনের অনেক সময় অপচয় করেছি। আমার মনে হতো “অমুক প্রোগ্রামটি আমাকে দেখতেই হবে”। এখন আমার সেই হারানো প্রতিটি সেকেন্ডের জন্যে খুব দুঃখ হয়। সারা পৃথিবী এগিয়ে চলে যাচ্ছিলো ভবিষ্যতের দিকে আর আমি বসে বসে টিভি দেখছিলাম!

বিংশ শতাব্দীতে টিভি একটা গুরুত্মপূর্ণ জিনিস ছিলো – সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ এবং সংবাদ এর জন্যে। কিন্তু এখন টিভির আর তেমন দরকার নেই। টিভির খবরগুলো সাধারণত পক্ষপাতিত্বপূর্ণ হয় যেখানে আমাদের অনেক বিকল্প সংবাদ মাধ্যম রয়েছে। আর টিভির অনুষ্ঠানগুলো থেকে শেখার প্রায় কিছুই নেই, যদিও এগুলো মানুষের দিন থেকে ঘন্টার পড় ঘন্টা নিয়ে নেয়। অথচ আমরা প্রায়ই অনুযোগ করি আমাদের হাতে সময় নেই!

টেলিভিশন মানুষকে ঘরকুনো করে ফেলে। যদি টেলিভিশনে পছন্দের কোনো অনুষ্ঠান বা খেলা দেখতে চান তাহলে কোনো বন্ধুর বাসায় যেয়ে আড্ডা দিতে দিতে একসাথে দেখুন।

ঘরের ভেতরে বসে টেলিভিশনের স্ক্রীন এর মতো জড় একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে থেকে জীবনকে কোনোভাবের সমৃদ্ধ করতে পারবেননা।

১২। ইন্টারনেট হচ্ছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে উপকারী জিনিস, কিন্তু এটাকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করতে হবে

টেলিভিশন হচ্ছে একটা নির্বোধ জড় স্ক্রীন, তার বিপরীতে ইন্টারনেট হচ্ছে একটা সক্রিয় মাধ্যম। ইন্টারনেট নিয়ে আপনি অনেক কিছু করতে পারবেন, একটা ভার্চুয়াল সামাজিক জগতে ঢুকে যেতে পারবেন। ইন্টারনেট পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে নানাভাবে সংযোগ স্থাপন করে এবং এটা ছাড়া আমার গতো আট বছরের জীবন অনেক কঠিন হতো।

ইন্টারনেটের এতো উপকারিতা সত্ত্বেও এটারো টেলিভিশনের মতোই সময় অপচয় করার সম্ভাবনা আছে। জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্যে ইন্টারনেট ব্যব্যহার করুন, কিন্তু সারাদিন এর মধ্যে পড়ে না থেকে বাইরে যেয়ে সেই সমৃদ্ধ জীবন উপভোগ করুন। টেলিভিশনের জড় স্ক্রীন এর জায়গায় কম্পিউটার এর অনেক কর্মকান্ডভরা স্ক্রীন ব্যবহার করলেই যে আপনার সময়ের সদব্যবহার হবে তা কিন্তু না। বাইরের পৃথিবী অনেক বেশি সুন্দর, বের হোন এবং সেটা উপভোগ করুন।

১৩। বাইরে যেয়ে মানুষের সাথে কিছু সময় কাটান

আমার খুব প্রিয় একটা ওয়েবসাইট হচ্ছে http://www.couchsurfing.org/। যেহেতু আমি নতুন নতুন ভাষা শিখতে আগ্রহী, এই সাইটের মাধ্যমে অনেক ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে আমার অতিথি হিসেবে আমার বাসায় থাকতে দিয়েছি এবং বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে তাদের ভাষা শিখতে পেরেছি।

সত্যিকারের পৃথিবী হচ্ছে বাইরের পৃথিবী – বই, টেলিভিশন, এবং ইন্টারনেটে যে পৃথিবী দেখছেন সেটা না। এই পৃথিবীর দেখা পাবেন আপনি বাইরের মানুষের সাথে মিশলে। নিজেকে লাজুক বা ইন্ট্রোভার্ট হিসেবে ভাবা বন্ধ করুন এবং নিজের ঘরের কিংবা দেশের বাইরে যেয়ে অন্য মানুষের সাথে মিশুন।

১৪। শুধু ইংরেজী ভাষা দিয়ে অন্য দেশের মানুষেকে খুব গভীরভাবে জানতে পারবেন না

আপনার বিদেশ ভ্রমণ যদি অল্প কিছুদিনের হয় তাহলে আপনি ইংরেজী দিয়ে অনায়াসে কিছুদিন চালিয়ে নিতে পারবেন। হোটেল বুক করা, রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দেওয়া, কিংবা একজন ভ্রমণ গাইডের সাথে ইংরেজীতে কথাবার্তা চালিয়ে নেওয়া – সবই করতে পারবেন। হয়তো কিছু স্থানীয় শিক্ষিত বন্ধুবান্ধবও বানিয়ে নিতে পারবেন। আপনার হয়তো মনে হবে আপনি সে দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গিয়েছেন

কিন্তু আপনি আসলে সত্যিকারভাবে কোনো দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবেননা শুধু সেদেশের ইংরেজী জানা মানুষজনের সাথে কথা বলে। শুধুমাত্র ইংরেজী জানলে আপনি সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। আমি আমার ভ্রমণ করা দেশগুলো সম্পর্কে এতো বেশি জানতে পেরেছি কেবলমাত্র তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলার কারণে। ওদের ভাষায় কথা বলতে না পারলে এতো গভীরভাবে তাদের সম্পর্কে জানা আমার পক্ষে অসম্ভব হতো।

যে কেউ চাইলেই একটা নতুন ভাষা শিখতে পারে। আমার বয়স যখন ২১ ছিলো তখনো আমি ভাবতাম এটা সম্ভব না। কিন্তু একদিন আমি সব ফালতু অজুহাত দেখানো বন্ধ করলাম এবং একটা নতুন ভাষা শিখে ফেললাম। কোনো ভাষা তাড়াতাড়ি শেখার গোপন উপায় হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই সেই ভাষায় অল্প অল্প করে কথা বলা শুরু করা।

১৫। অন্য দেশের মানুষজন সম্পর্কে আপনি যা ভাবেন তারা আসলে সেরকম না

পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশই ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে উঠছে। এর মানে এই নয় যে ওরা সব পশ্চিমা দেশগুলো বা আমেরিকার মতো হয়ে উঠছে। সব দেশই ভিন্ন এবং সেটা ট্যুর বইয়ে তাদের সম্পর্কে যা পড়ে এসেছেন সেরকম নয়। ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে প্রথাগত এবং পুঁথিগত ধারণা বাদ দিয়ে খোলা মন নিয় এওদের সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করুন।

আইরিশ মানুষ মানেই যে বিয়ার খায় তা নয়, ব্রাজিলের সবাই ফুটবল খেলেনা কিংবা সাম্বা নাচেনা, এবং জার্মান, ডাচ, ফিলিপিনো সবার সাথে কথা বলে আপনি অবাক হবেন যদি আপনার আগে থেকে পুষে রাখা ধারণা বাদ দিয়ে তাদের সাথে মিশেন।

মানুষের ভিন্নতাকে সম্মান করুন, তাদের কাছে গেলে তাদের সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন। এমনো হতে পারে আপনার সংস্কৃতই ওদের কাছে পশ্চাদপদ মনে হবে!

১৬। জীবন নিয়ে তাড়াহুড়ো করবেন না, সময় নিন

যেসব দেশকে আমাদের কাছে “ধীর গতির” মনে হয়, আমি দেখেছি তারা আসলে তাদের নিজস্ব গতির জীবনে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। যেসব মানুষ কিংবা দেশ সবকিছু তাড়াহূড়ো করে করতে চায় তাদের কাজের কোয়ালিটি আসলে ততোটা ভালো হয়না। সবকিছু সহজভাবে নিন এবং ধীরে ধীরে কাজ করুন।

খাবারের প্রতিটি কামড় উপভোগ করুন, হাঁটার সময় চারপাশ দেখে ধীরে ধীরে হাঁটুন, কারো সাথে কথা বলার সময় তাকে তার কথা পুরোপুরি শেষ করতে দিন এবং সে পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনুন।

দিনের কাজের ভেতর মাঝে মধ্যে কাজ বন্ধ করে বাইরে তাকান, কিংবা চোখ বন্ধ করে একটা বড় নিশ্বাস নিন, বেঁচে থাকার জন্যে নিজেকে সুখী ভাবুন।

১৭। আপনি সবাইকে খুশি করতে পারবেন না

“সফল হওয়ার উপায় হয়তো আমি জানিনা, কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার উপায় হচ্ছে সবাইকে খুশি করতে যাওয়া” – বিল কসবি।

নিজের মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করুন। আপনার যদি আপনার মতামতের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস থাকে এবং সেই মতামত অন্যদের সাথে শেয়ার করেন তাহলে নিশ্চিতভাবে অনেক মানুষ আপনার উপর বিরক্ত হবে, আপনার কথাটা যতোই চমৎকার হোকনা কেনো। যারা আপনার সাথে একমত না এবং আপনার মত পছন্দ করছেনা এটা তাদের সমস্যা, আপনার না।

১৮। Cool হওয়ার চেষ্টা করা কিংবা সর্বশেষ ক্রেইজের পেছনে ছোটা আসলে Uncool

যারা সবসময় অন্যের দেখাদেখি নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে তারা আসলে নিজেদের ব্যক্তিত্ব নিয়ে ভয় পায়। নিজের মেরুদন্ড শক্ত করুন, এবং স্রোতের বিপরীতে যাওয়াটাকে যদি আপনার সঠিক পথ মনে হয় তাহলে শক্তভাবে তাই করুন। আজকে যেটা চমকপ্রদ কয়েক বছর পর সেটাই হয়তো সবার অপছন্দের জিনিসে পরিণত হবে।

১৯। ভুল করতে ভই পাবেন না, জীবনে অনেক ভুল করুন

ভুলের মাধ্যমেই আমরা শিখি। সাফল্য আসে অনেক ভুলের পরেই

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি

কিছুদিন আগে একটা ওয়েব সাইটে একটা চমৎকার লেখা পড়ি। ভদ্রলোক গতো আট বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং বিভিন্ন দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতি শিখছেন। তার পৃথিবী ভ্রমনের আট বছর পুর্তি উপলক্ষে তিনি তার ভ্রমন থেকে কী শিখেছেন সেটার একটা লিস্ট দিয়েছেন ভাবলাম অনুবাদ করে ফেলি:)

মূল লেখার লিঙ্কঃ http://www.fluentin3months.com/life-lessons/

আট বছর ধরে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে যে উনত্রিশটি শিক্ষা আমি পেয়েছি
===========================================

আট বছর।
৪১৬ সপ্তাহ, যেটা প্রায় ৩০০০ দিন।

এই দীর্ঘ সময় আমার কোনো নির্ধারিত ঘর ছিলোনা। আমি ঘুরে বেড়িয়েছি দেশ থেকে দেশে, এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে। আমার সারা জীবনের অর্জন করা সব সম্বল আমার ট্রাভেল ব্যাগে করে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি এই সময়টা। এটা ছিলো আমার জীবনের একটা বড় অংশ, এবং আমি এখনো এটা করে চলেছি।

এর আগেও আমি অবশ্য কয়েকটা জায়গায় ভ্রমন করেছি – দুটো গ্রীষ্ম আমেরিকায়, আর এক মাস স্পেইনে। এবং ২০০৩ সালে, আমার একুশতম জন্মদিনের সপ্তাহটিতে, আমি আমার জন্মস্থান আয়ারল্যান্ড ছাড়ি চিরদিনের জন্যে। এর কয়েকদিন আগে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করি, এবং আমি জানতাম এরপর হয়তো আমি আয়ারল্যান্ডে শুধু বেড়াতে আসবো, যদিও আমি জীবনে কখনো আমার পরিবারের সাথে ক্রিসমাস ডিনার না খেয়ে থাকিনি। কিন্তু আয়ারল্যান্ড আর আমার বাড়ি না। এখন থেকে “যেখানে আমি যাবো সেটাই হবে আমার বাড়ি”।

এর আগে আমার জীবনের প্রায় সবটুকু আমি ব্যয় করেছি বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে। কিন্তু সেখানে আমি গুরুত্মপূর্ণ প্রায় কিছুই শিখিনি। বইয়ে লেখা জিনিসগুলো প্রায় সবই আমি আগে থেকে জানতাম, কিন্তু আমি যা হতে চেয়েছি জীবনে সেটা আমি শিখেছি গতো আট বছরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে। এবং আমার নিশ্চিতভাবে এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।

গতোকাল ছিলো আমার ২৯-তম জন্মদিন, এবং এই সপ্তাহে আমার পৃথিবী ভ্রমনের আট বছর পূর্ণ হচ্ছে। তাই ভাবলাম আমার এই আট বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ২৯টি শিক্ষা আপনাদের সাথে শেয়ার করি। এগুলো বেশিরভাগই জীবন নিয়ে সাধারণ কথাবার্তা, কিন্তু এগুলো আমি শিখেছি সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের সাথে মেশার পরঃ

১। সব জায়গায় সব মানুষ আসলে একই জিনিস চায়

যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি অনেক ভিন্ন, আপনি ইটালিয়ান কোটিপতি থেকে শুরু করে গৃহহীন ব্রাজিলিয়ান, নেদারল্যান্ডস এর জেলে, ফিলিপাইনের কম্পিটার প্রোগ্রামার এর সাথে তাদের নিজের ভাষায় তাদের মতো করে কথা বলে দেখবেন যে তারা সবাই জীবনের গুরুত্মপূর্ণ জিনিসগুলোর ব্যাপারে একই রকম চিন্তা করে।

সবাই চায় স্বীকৃতি, ভালোবাসা, নিরাপত্তা, বিনোদন, এবং একটা ভবিষ্যতের আশা। এই চাওয়াগুলির প্রকাশ এবং এগুলো পাওয়ার জন্যে সবার কাজে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু এই বাহ্যিক ব্যাপারগুলো উপেক্ষা করলে দেখবেন পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ আসলে প্রায় একই জিনিস চায়।

২। সুখ ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখা বড় ভুল

অসংখ্য মানুষ ভাবে “ওই একটা জিনিস” যদি ঠিক হয়ে যায় “তাহলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে”।

এটা একটা ঘোর (ডিলুশন)।

যখন “ওই একটা জিনিস” ঠিক হবে, তখন “আরো একটা” জিনিস আপনার জীবনে বাকি থেকে যাবে। জীবনে কখনো সবকিছু একসাথে আপনার কাছে ধরা দিবেনা। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জীবনে সুখী হওয়া শুধু একটা জিনিস ঠিক হয়ে যাওয়ার উপর নির্ভর করেনা, এভাবে সুখী হওয়াও যায়না। এরচেয়ে এই মুহুর্তে আপনার যা আছে তা নিয়ে সুখী হোন, বর্তমানকে উপভোগ করুন, এবং একইসাথে ভবিষ্যতের জন্যে জন্যে কাজ করে যান। সাফল্য আসলে একটা ভ্রমন, গন্তব্য নয়!

আপনার জীবনের একটা বড় অংশ যদি একটা বড় কিছুর জন্যে কাজ করে চলে যায় তাহলে সে কাজটি হয়ে যাওয়ার পর আপনার জীবনে আর তেমন কিছুই থাকবেনা। কোনো বড় কিছুর জন্যে কাজ করলেও নিজেকে সুখী হওয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না, কাজটি শেষ হওয়া পর্যন্ত সুখী হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন না, কাজ করতে করতেই সুখী হওয়ার চেষ্টা করুন।

ধীরে ধীরে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন এবং এই ভ্রমন উপভোগ করুন।

অনুষ্টানটি উপভোগ করুন, শেষ দৃশ্যের জন্যে তাড়াহূড়ো করবেন না।

আমাদের জীবন হচ্ছে এখন – অতীত এবং ভবিষ্যত কোনোটাই না।

৩। “একদিন আমার সময় আসবে আর আমি সুখী হবো” – এটা একটা ফালতু চিন্তা। আপনি কখনোই লটারি জিতবেন না। বাস্তববাদী হোন।

অনেকের ভাগ্য নিয়ে একটা অদ্ভুত ধারণা আছে – আল্লাহ/ঈশ্বর/ভগবান/দেবতা কেউ একদিন কোনোভাবে তাদের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিবেন। তারা ভাবেন তারা “সৌভাগ্য পাবার যোগ্য” এবং “একদিন সব এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে” তাদের জন্যে। কেউ কেউ ভাবেন একদিন তারা লটারি জিতবেন কিংবা ভালো কিছু একটা ঘটবে তাদের জীবনে। অনেক মেয়ে ভাবে একদিন তার রাজপুত্র এসে তাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের দেশে!

এই ধরণের ভাবনা আসে পৃথিবী কীভাবে কাজ করে সেটা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা থেকে। হতে পারে আমি ভুল, হয়তো প্রার্থনা বা আশা থেকে ভালো কিছু ঘটতে পারে, হয়তোবা মানুষ হিসেবে ভালো হয়ে থাকতে পারলে একসময় ভালো কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু আশা, প্রার্থনা, এবং ভালো হওয়ার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে চাওয়ার জিনিসটাকে অর্জন করার চেষ্টা করে যেতে দোষ কোথায়?

আমি ব্যক্তিগতভাবে জাদু, জ্বীন-পরী, জ্যোতিষবিদ্যা, কিংবা কোনো অদৃশ্য সত্ত্বায় বিশ্বাস করিনা । এগুলোর ব্যাপারে আমি সন্দিহান এবং আমি বিশ্বাস করি এগুলো সবকিছু অসম্ভব এবং হাস্যকর। এইসব অদৃশ্যে বিশ্বাস না করাটা আমার জীবনকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। একজন বাস্তববাদী মানুষ হিসেবে পৃথিবীকে আমি খুব যুক্তির জায়গা হিসেবে দেখি যেখানে প্রকৃতির তৈরি বৈজ্ঞানিক নিয়ম এবং মানুষের তৈরি সামাজিক নিয়ম অনুসারে সবকিছু চলে। এবং পৃথিবীকে এভাবে দেখার কারণে আমি অনেক সহজভাবে সবকিছু দেখতে পারি।

এই বিশ্বজগত আপনাকে কিছু দেবার জন্যে পণ করে বসে নেই। আপনাকেই আপনার জীবন গুছিয়ে তোলার জন্যে কাজ করে যেতে হবে।

৪। নিয়তি বলে কিছু নাই, এবং এটা একটা সুখবর!

নিয়তি’র দোহাই দিয়ে আমরা অনেকেই জীবনে ভালো কিছু করা থেকে বিরত থাকি। আসল ঘটনা হচ্ছে নিয়তি বলে কিছু নাই ।

আপনার ব্যর্থতা কিংবা সীমাবদ্ধতা আপনার জন্ম কোথায় হয়েছে সেটার উপর নির্ভর করেনা, কিংবা আপনি কাকে চিনেন, আপনার জিন কেমন, আপনার কতো টাকা আছে, আপনার বয়স, আপনার অতীত, বা অন্য কোনো কিছুর সাথেই এর কোনো সম্পর্ক নাই। কোনো কিছুর দোহাই দিয়ে আপনার সীমাবদ্ধতাকে আপনি জাস্টিফাই করতে পারবেননা।

যদি সত্যিকারভাবে সংকল্পবদ্ধ হন, তাহলে জীবনে অর্জন করার অজস্র সুযোগ আছে – আপনি কে কিংবা আপনার কাছে কতো টাকা আছে এটা কোনো ব্যাপারই না।

৫। আপনার থেকে ভিন্ন বিশ্বাস ও মতের মানুষের সাথে কথা বলুন এবং তাদের বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করুন

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সাথে পৃথিবীর অনেক মানুষের বিশ্বাসের কোনো মিল নাই। কিন্তু মানুষ এই ভিন্ন বিশ্বাসে থেকেও জীবনের তাৎপর্য খুঁজে পায়। যদি সবাই আমার মতো বিশ্বাস করতো এবং ভাবতো তাহলে পৃথিবীটা একটা রসকষহীন জায়গায় পরিণত হতো।

অতএব আমি যখন আমার থেক ভিন্ন বিশ্বাসের কোনো মানুষের সাথে মিশি, তখন তাদেরকে আমার বিশ্বাসে নিয়ে আসার চেয়ে তাদের বিশ্বাস তাদের কাছে রেখে একসাথে মিলে চলার চেষ্টা করাই ভালো।

কেউ যখন তার কোনো বিশ্বাস এর ব্যাপারে “১০০% নিশ্চিত” এবং বহু বছর ধরে সেই বিশ্বাস ধারণ করে আসছে, তখন তাকে কিছু চালাকী কথাবার্তার মাধ্যমে তার বিশ্বাস থেকে সরানো যায় না। সবাই কিছু কিছু ব্যাপারে বদ্ধ মনের মানুষ, আমি নিজেও তাই।

কেউ যদি নিজে নিজের বদ্ধ মন থেকে বের হতে না পারে তাহলে তাকে সেটাই বিশ্বাস করতে দেওয়া উচিত। আপনিই ঠিক আর অন্যরা ভুল – পৃথিবীকে এটা বোঝানোর দায়িত্ব নেওয়ার দরকার নাই। কখনো কখনো হয়তো আপনার বিশ্বাসটিই ভুল!

পৃথিবী আরো অনেক বেশি মজার জায়গা হয় যখন সেখানে বিভিন্ন বিশ্বাসের এবং আগ্রহের মানুষ থাকে। আমার নিজের সন্দেহবাদীতা সত্ত্বেও আমি অনেক জ্যোতিষী, হস্তরেখা বিশারদ, অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ, রক্ষণশীল মানুষ, এবং প্রযুক্তিকে ঘৃনা করে এমন অনেক মানুষের সাথে মিশেছি। এবং সেজন্যে আমার জীবন অনেক বেশী বৈচিত্রময় এবং সমৃদ্ধ
হয়েছে।

আপনি যদি শুধুমাত্র যারা আপনার সব কথায় হ্যাঁ বলে এমন মানুষদের সাথে মিশেন তাহলে আপনি কখনো ভুল করছেন কিনা এটা জানার সুযোগ পাবেন না এবং নতুন জিনিস শিখতেও পারবেন না।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?

১। মৃত্যু উপত্যকা

প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরের দূর্ঘটনায় অকালমৃত্যু আমাদের সবার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে। এটা এমন এক ক্ষতি আমাদের জাতির জন্যে যেটা সহজে পূরণ হবার নয়। এমনিতেই আমাদের চলচ্চিত্রের যাচ্ছেতাই অবস্থা, এর মধ্যে একজন চরম প্রতিভাবান নির্মাতাকে হারানো মানে আসলে আমাদের চলচ্চিত্রের আরো অনেকখানি পিছিয়ে যাওয়া।

সড়ক দূর্ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেও আমাদের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে বাসে বাসে সংঘর্ষের পর অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন, যদিও সেই দূর্ঘটনায় ছয়জন হতভাগা মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো।

নৌপথেও আমাদের দেশে প্রায়ই লঞ্চডুবি হয়। বছর বছর শত শত মানুষ মারা যায় তাতে।

কয়দিন পরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে রাস্তায় পড়ে মরে থাকে কিশোরের মৃতদেহ। ইট, রড দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে রাখি তরুণদের, যে আমাদেরই কারো না কারো স্বজন, পরিচিত জন।

আমাদের র‍্যাব-পুলিশ তো মানুষ মারাকে কৌতুকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। রাত তিনটার সময় র‍্যাবের গাড়ি থেকে পালাতে যেয়ে গুলি খেয়ে মরে যায় কোনো তরুন, তার মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকে কোনো দেশীও অস্ত্র! বিচার বিভাগ নামে যে একটা প্রতিষ্ঠান আছে সেটা মনে হয় আমাদের র‍্যাব-পুলিশের লোকজন কোনোভাবেই মানতে রাজী নন।

২। এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়!

তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর খবরের কাগজে, ফেইসবুক, টুইটার, ব্লগে মানুষের হাহাকার উঠেছে। সবারই মোটামুটি এক কথা – এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়! এ কোন দেশে আছি আমরা, আমাদের কি সরকার নেই? আমরা কি আফ্রিকার কোন যুদ্ধপীড়িত দেশ? এই লাশের মিছিল থামানোর দায়িত্ব কি কারো নয়?

৩। অযোগ্য রাজনীতিবিদ-আমলা-পুলিশ

রাজনীতিবিদরা আমাদের দেশের চিরকালীন ভিলেন। বাজের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে? বানিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজশ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সড়ক দূর্ঘটনায় কেউ মারা গেছে? যোগাযোগ মন্ত্রী করেটা কী? জঙ্গিরা বোমা ফাটিয়েছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজের দলের উপকার ছাড়া আর কোনো কাজে আগ্রহী না। শেয়ার বাজার পড়ে গেছে? অর্থ মন্ত্রী নিজেই এই চক্রের সাথে জড়িত!

হয়তো ব্যাপারটি সত্যি। আমাদের রাজনীতিবিদদের অদক্ষতা এবং অসততা আমরা আমাদের সামনেই দেখে চলেছি।

রাজনীতিবদদের সাথে আমাদের ভিলেনের তালিকায় আছে দুর্নীতিপরায়ণ এবং অদক্ষ আমলা এবং পুলিশ বাহিনী। রাজনীতিবিদদের সাথে তাল মিলিয়ে এই মানুষগুলোর কর্মকান্ডও দিন দিন আমাদের কষ্টের এবং দেশকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন ভঙ্গের পেছনে অনেক অবদান রাখছে।

৪। অযোগ্য আরো অনেকে

শুধু কি রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ নিয়ে আমাদের অভিযোগ?

– আমাদের শিক্ষকদের নিয়েও আমাদের অনেক হতাশা, তারা দিনের পর দিন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাজনীতি করে চলেছেন।
– হতাশা আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের নিয়ে যারা আমাদের আশা অনেক উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে বারবার নিরাশ করছে। ফুটবল খেলোয়াড়দের নিয়ে আমাদের হতাশা তো এমন পর্যায়ে যে আমাদের আর কোনো আশাই নাই ওদের নিয়ে।
-আমাদের বিজ্ঞানীরা খুব কমই গর্ব করার মতো কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছেন এখন পর্যন্ত।
– আমাদের চলচ্চিত্র এমন পর্যায়ে যে আমাদের মধবিত্ত, উচ্চবিত্ত সমাজ চলচ্চিত্র প্রায় বর্জন করে চলেছেন।
– আন্তর্জাতিক কোনো ক্রীড়া প্রতযোগিতায় আমাদের কখনো তেমন কোনো সাফল্য নাই।
– বিজ্ঞান-প্রকৌশলে আমাদের কোনো বড় অর্জন নাই। আমাদের বড় বড় ব্রিজ, বিল্ডিং ইত্যাদি এখনো বিদেশী প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হয়।
– আমাদের বাস-ট্রাক ড্রাইভাররা খেয়াল খুশি মতো গাড়ি চালায় আর মানুষ মারে?

এই লিস্ট এর অন্ত নেই। মনের সুখে যোগ করুন আপনার অভিযোগটি।

এবং এর প্রতিটির জন্যে আমরা নিয়ম করে বকাঝকা, গালাগাল করে যাচ্ছি অদক্ষ, অযোগ্য মানুষগুলোকে। আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের যে কী পরিমান গালি খেতে হয় সেটা ফেইসবুক, ব্লগিং না থাকলে মনে হয় আমার জানা হতো না!

৫। আমি ছাড়া আর সবাই খারাপ, অযোগ্য?

এই যে চারদিকে এতো খারাপ মানুষ, অযোগ্য মানুষের দল এরা কোথাকার মানুষ, কোন দেশের মানুষ?

এরাই কি “আমরা” নয়? এরা কি আমাদের পরিবার, স্বজন, বন্ধু, পরিচিত কেউ নয়?

আয়নার সামনে দাঁড়ালে যে মানুষটাকে দেখা যায় সে কতোটুকু ভালো? কতটুকু যোগ্য?

নিজের ভালোত্ব বাড়ানোর জন্যে জীবনে কী করেছি? দক্ষতা, যোগ্যতা বাড়ানোর জন্যে কী করেছি? দেশের ভালোর জন্যে কী করেছি? নাকি নিজেকে অযোগ্য রেখে দিয়ে দেশকে আশা করেছি যোগ্য হতে? দেশ কি পনের কোটি মানুষের বাইরের কিছু? পনের কোটি মানুষ যদি যোগ্য হয়ে না উঠে, তাহলে দেশ কিভাবে যোগ্য হবে?

৬। এই মৃত্য উপত্যকা আসলে আমি, আপনি, এবং আমাদের আগের প্রজন্মের তৈরি!

কিশোর এবং তরুণ বয়সে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল পড়ালেখা। এর সাথে খেলাধুলা আর কিছু সাংস্কৃতিক কাজে জড়িত হওয়া। আমি এর কোনোটাই ভালোভাবে করতে পারিনি। আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে মেরে আলসেমী করে আমার সময় নষ্ট করেছি। সেজন্যেই আজ আমার কাজে দক্ষতা আন্তর্জাতিক মানের না। আমাদের দেশ যে পিছিয়ে আছে অন্য অনেক দেশ থেকে সে ব্যাপারে আমি অবদান রাখছি।

আমার ধারণা একই কথা আপনার ক্ষেত্রেও সত্যি। সেটা না হলে আপনার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনি এখন আমাদের দেশের জন্যে কিছু করুন এবং আমাদেরকেও পথ দেখান।

আমাদের চেয়ে বড় দোষ আমাদের আগের প্রজন্মের। আমাদের বাবা-মা’র। আমি দুঃখিত আপনার অনুভুতিতে আঘাত লাগলে, কিন্তু আমাদের আগের প্রজন্ম আমাদেরকে একটা জঘন্য বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।

তারা আমাদের একটা স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়েছে সত্যি (সেজন্যে তাদের কাছে সীমাহীন কৃতজ্ঞতা), কিন্তু তারা আমাদের উপহার দিয়েছেন একটা দুর্নীতিতে শ্রেষ্ট দেশ। দেশের প্রতি মায়া-মমতাহীন একদল রাজনীতিবিদ। ছাত্র রাজনীতি নামক ভয়াবহ সন্ত্রাসী এবং পশ্চাদপদ একটা ব্যবস্থা যেটা আমাদের সমাজকে, দেশকে তিলতিল করে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

তারা আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেন নি। যখনি আমি একটা অযোগ্য বালক-বালিকা কিংবা কিশোর-কিশোরী দেখি, তখনি আমার সেই বালক-বালিকা কিংবা কিশোর-কিশোরীর বাবা-মা’র প্রতি এক ধরনের রাগ কাজ করে। বাবা-মা চাইলে সন্তানদের সঠিকভাবে বড় করে তোলা খুব কঠিন কিছু না। আমাদের সীমিত সম্পদ, কিন্তু এটা দিয়েই আমাদের শুরু করতে হবে। কোনো দেশই প্রথমের উন্নত হয়ে শুরু করেনি!

এই অযোগ্য আমি, আপনি, আর আমাদের আগের প্রজন্ম থেকে তৈরি হয়েছে আমাদের রাজনীতিবিদগন, আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা, আমাদের ফুটবলাররা, চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারা, ঘাতক বাস ড্রাইভার, খুনী র‍্যাব-পুলিশ।

৭। পরিবর্তন শুরু হতে হবে নিজের থেকে

যে দেশের স্বপ্ন দেখি আমরা (এবং প্রতিনিয়ত সেই স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ভুগি) সে দেশ পেতে হলে আগে নিজেকে ভালো, যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।

পনের কোটি মানুষের বেশির ভাগ মানুষ যেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলতে পারবে “আমি সত্যিকারভাবে একজন ভালো মানুষ, যোগ্য মানুষ, অন্তত পক্ষে সেরকম হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি” সেদিন শুধুমাত্র আমরা আমাদের স্বপ্নের দেশ পাবো। তার আগ পর্যন্ত কেবল “নিজে ভালো, অন্যরা খারাপ” বলে গলা ফাটিয়ে যাবো, কিংবা বিভিন্ন উন্নত দেশের এম্ব্যাসিতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কোনোমতে এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে পালানোর চেষ্টা করে যাবো।