Monthly Archives: June 2009

মাইক্রোসফট এর সাতকাহন – পর্ব ১ (ইন্টার্ণশীপ ইন্টারভিউ)

ওহাইও স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ক্লাশ শুরু হয় ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ক্লাস শুরুর সপ্তাহ দুএকের মধ্যে একদিন ইমেইল পেলাম যে আগামী মাসে (অক্টোবর) কোনো এক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্যারিয়ার ফেয়ার অনুষ্টিত হবে। আমেরিকার সব নামকরা কম্পানী সেখানে আসবে এবং তাদের কাছে সরাসরি সিভি (CV) জমা দেওয়া যাবে। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি খুঁজছিলাম কম্পিউটার জায়ান্ট কম্পানীগুলোকে। মেলাটি হচ্ছিলো বিশাল এলাকা জুড়ে, একশ’র বেশি স্টল ছিলো ওখানে। সবার সামনে পেলাম আইবিএম এর স্টল। সোজা গিয়ে বললাম আমি আইবিএমএ কাজ করতে আগ্রহীঃ-) ওরা বললো ওরা সি++ জানা লোক খুঁজছে, তাই আমি মনের আনন্দে আমার সিভি জমা দিলাম। এরপর আরো অনেক কম্পানী দেখলাম কিন্তু গুগল বা মাইক্রোসফটকে কোথাও দেখলাম না। হতাশ হয়ে ফিরে আসছিলাম। ফিরে আসার পথে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম গুগল বা মাইক্রোসফট এই মেলায় এসেছে কিনা। সে বললো সে গুগলের কথা জানেনা কিন্তু মাইক্রোসফট এসেছে এবং তারা অমুক সারির অতো নাম্বার স্টলে আছে। আমি সাথে সাথে লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে মাইক্রোসফটএর স্টল এর দিকে রওয়ানা দিলাম।

মাইক্রোসফট এর স্টল খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো। মাইক্রোসফট থেকে আসা কয়েকজন সেখানে ছিলো যারা সিভি ড্রপ করতে আসা বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কথা বলছিলো। তো একসময় আমার পালা আসলো। ইন্ডিয়ান একটা ছেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়ালো। আমিও হাত বাড়িয়ে হাত মেলালাম। আমি তখনো ছাত্র, মাত্র আমার মাস্টার্স শুরু করেছি, বললাম আমি সামনের গ্রীষ্মের ছুটিতে মাইক্রোসফটএ ইন্টার্ণশীপ করতে আগ্রহী। সে আমার সিভিটি নিলো। ভালো করে দেখলো সেটি। এরপর আমার কিসে আগ্রহ, কী ধরণের কাজ ভালো পারি এসব জিজ্ঞেস করলো। আমিও আমার মতো করে উত্তর দিয়ে গেলাম। এরপর সে বললো সে আমার সিভি সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিবে এবং আমার যোগ্যতার সাথে ম্যাচ করে এমন পজিশন খালি থাকলে আমার সাথে যোগাযোগ করবে। বিদায় নেবার সময় আমার হাতে একটা সুডকু (একধরণের পাজল গেইম) বই ধরিয়ে দিয়ে বললো – “তুমি যেহেতু প্রব্লেম সল্ভিং পছন্দ করো, তাই তোমাকে এই পাজল এর বইটি দিচ্ছি। আমার ধারণা তুমি এটা উপভোগ করবে”।

সেদিন ল্যাবে ফিরে এসে আমি মোটামুটি এই ক্যারিয়ার ফেয়ার এর কথা ভুলেই গেলাম। নতুন পরিবেশে পড়ালেখার চাপে আমার তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। এরমধ্যে একদিন ইমেইল পেলাম মাইক্রোসফট থেকে। “নভেমবর মাসের অমুক তারিখে আমাদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিয়ার এর সাথে তোমার একটা ইন্টারভিউ এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের জানাও তুমি সেসময় এটায় উপস্থিত থাকতে পারবে কিনা”। আমি মনে মনে বললাম, “আবার জিগায়!”। সাথে সাথে ইমেইল এর উত্তর দিলাম – “ধন্যবাদ আমাকে ইন্টারভিউএ আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। আমি ওইদিন যথাসময়ে জায়গামতো উপস্থিত থাকবো”। এরপর ওরা জায়গা ও সময় কনফার্ম করে আরেকটা এমেইল দিয়েছিলো। আমি মনে মনে দিন গুনতে লাগলাম।

ইন্টারভিউ এর দিন ঘনিয়ে আসতে থাকায় আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে প্রাথমিক ইন্টারভিউয়ে আসতে পারে এমন প্রশ্ন ডাউনলোড করে পড়া শুরু করলাম। টুকটাক প্রোগ্রাম লিখে ভুলে যাওয়া প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ এর সিনট্যাক্স ঝালাই করে নিলাম। ইন্টারভিউ এর জায়গাটি ছিলো আমাদের কম্পিউটার সায়েন্স বিজ্ঞান বিভাগের উলটা দিকের বিল্ডিং, তাই সেটি খুঁজে পাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হলো না। ইন্টারভিউ এর দিন আমি যথাসময়ে ইন্টারভিউ এর নির্ধারিত ভবনে যেয়ে পৌঁছালাম। ওখানে ডেস্কে থাকা মেয়েটিকে বললাম আমি কেনো এসেছি। ও কম্পিউটারে আমার নাম দেখে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে আমাকে একটা ফর্ম ধরিয়ে দিলো। ফর্মটি পূরণ করে আমি সোফায় বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম আমার ইন্টারভিউয়ার এর জন্য।

একসময় আমার ইন্টারভিউয়ার আসলো। লম্বা মতোন এক আমেরিকান ভদ্রলোক এসে হাত বাড়িয়ে আমার নাম জিজ্ঞেস করলো আর নিজের পরিচয় দিলো? ও জানালো ও ভিজুয়াল স্টুডিও গ্রুপ এর একজন ম্যানেজার। আমি ওকে অনুসরণ করে ছোট একটি কক্ষে প্রবেশ করলাম। এখানেই আমার ইন্টারভিউ হবে। ও আমার সিভি বের করলো। আমার সিভি দেখে আমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। সিভিতে যেসব স্কিলস এর কথা লিখেছি ওগুলো নিয়ে কয়েক মিনিট আলোচনা করলো। এরপর আমাকে স্ট্রিং সম্পর্কিত একটা প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধান করতে বললো। আমি কাগজে সেটির কোড লিখলাম। আমার কোড নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো। কিভাবে আমার এই কোড আমি ব্রেক করবো সেটা জিজ্ঞেস করলো। এই কোডকে টেস্ট করার জন্য টেস্ট কেইস লিখতে বললো। এরপর আরো কিছু টুকটাক প্রোগ্রামিং প্রশ্ন করে আমার ইন্টারভিউ শেষ করলো। শেষ করার আগে এখানে যা নিয়ম, আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমার কোনো প্রশ্ন আছে কিনা তার জন্য। আমি প্রস্তুত ছিলাম। তাকে মাইক্রোসফট এর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট নিয়ে দুএকটা প্রশ্ন করলাম। ও আমাকে সেগুলোর ব্যাখ্যা দিলো। এভাবে শেষ হলো সেদিনের ইন্টারভিউ পর্ব।

ইন্টারভিউ শেষে আবার আমার ব্যস্ত পড়ালেখার জীবনে ফিরে গেলাম। কিন্তু মনে মনে ভীষণ অপেক্ষা করতে থাকলাম একটা ইমেইল এর জন্য! ওরা যদি আমাকে পছন্দ করে থাকে তাহলে আমাকে ওরা মাইক্রোসফট এর প্রধান অফিস ওয়াশিংটন স্টেইট এর রেডমন্ড নামক শহরে নিয়ে যাবে একদিন সারাদিন ইন্টারভিউ এর জন্য। আমার ইন্টারভিউ মোটামুটি ভালোই হয়েছিলো, কিন্তু সবাই নিশ্চয়ই এখানে ভালো ইন্টারভিউ দেয়! সবাই বলছিলো সাধারণত দুই সপ্তাহের মধ্যে ওরা রেজাল্ট জানিয়ে দেয়, কিন্তু ২ সপ্তাহ চলে গেলেও ওদের ইমেইল এর কোনো দেখা মিললো না। এ পর্যায়ে আমি সব আশা ছেড়ে দিলাম। অবশেষে তিন সপ্তাহ পর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার মেইলবক্সে মাইক্রোসফট থেকে একটা ইমেইল আসলো যে আমাকে মাইক্রোসফট এর প্রধান কার্যালয়ে একদিন সারাদিন ইন্টারভিউ এর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এই ইমেইল পেয়ে আমার খুশি আর দেখে কে। ইন্টার্ণশীপ না পাই, নিদেনপক্ষে মাইক্রোসফট এর খরচে ওদের প্রধান কার্যালয় দেখে ঘুরে তো আসা যাবে!

সামনে ক্রিসমাসের ছুটি থাকায় আমার ইন্টারভিউ ওরা ঠিক করে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। রেডমন্ড যাওয়া-আসার প্লেইন টিকেট, হোটেল এর বিল, থাকা-খাওয়া সবই মাইক্রোসফট বহন করবেঃ-) আমার ফ্লাইট এর দিন ঠিক করি ইন্টারভিউ এর আগেরদিন। কিন্তু ফ্লাইট এর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ভয়েস মেইল পাই এয়ারলাইন্স থেকে যে মত্রারিরিক্ত তুষারপাতের ফলে আমার ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। এর নামই মনে হয় কপাল। আরেকটু বেলা গড়ানোর পর আমি যোগাযোগ করি মাইক্রোসফটএ আমার রিক্রুটার এর সাথে। সে তখন একটু সময় নিয়ে দুই সপ্তাহ পর আমার ইন্টারভিউ এর দিন পুননির্ধারণ করে। আমার অনুরোধে ওরা আমেরিকার তুষারপাতপ্রবণ এলাকা (মিড-ওয়েস্ট এলাকা) এড়িয়ে অন্য শহরের মধ্য দিয়ে কানেক্টিং ফ্লাইট ঠিক করে দেয়।

সৌভাগ্যক্রমে আমার নতুন ইন্টারভিউ এর দিন কোনো ঝামেলা ছাড়াই সিয়াটল এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছাই। সিয়াটল এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রেডমন্ডে আমার হোটলে চলে আসি। বিকেলে মাইক্রোসফট এর সাইদ ভাই আমাকে মাইক্রোসফট ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন। মাইক্রোসফট ক্যাম্পাস একটা বিশাল এলাকা। একশ’র মতো বিল্ডিং আছে এখানে। উইন্ডোজ আর অফিস (ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট ইত্যাদি) এর সবচেয়ে বড় দুটি প্রডাক্ট হলেও সার্চ, এমএসএন, এক্সবক্স, জুন মিউজিক প্লেয়ার, উইন্ডোজ সার্ভার, এসকিএল সার্ভার, ভিজুয়াল স্টুডিও – ইত্যাদি অসংখ্য গ্রুপ এর অফিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো এলাকা জুড়ে। সে যাক, মাইক্রোসফট এর অফিস এবং সফটওয়্যার ব্যবসা নিয়ে আরেকদিন লিখবো। আজ আমার ইন্টারভিউ নিয়ে লেখা যাক।

তো পরদিন আমি সকাল দশটার সময় বিল্ডিং ১৯ এ চলে যাই। বিল্ডিং ১৯ হচ্ছে মাইক্রোসফট এর রিক্রুটিং বিল্ডিং। সকল নতুন চাকুরীপ্রার্থীকে সবার আগে এখানে চেকইন করতে হয়। তো রিসেপশনে যেয়ে নাম বলতেই আমাকে বলা হলো আমার রিক্রুটার একটু পরে এসেই আমাকে নিয়ে যাবে। আমি লবিতে সোফায় বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। একটু পরই আমার রিক্রুটার ডেভিড এসে নিজের পরিচয় দিলো এবং আমাকে নিয়ে ওর অফিসএ নিয়ে গেলো। সেখানে আমার নন-টেকনিকাল ইন্টারভিউ হলো। আমি কেনো মাইক্রোসফটএ কাজ করতে চাই, আর কোন কোন কম্পানীতে এপ্লাই করছি, আমার স্যালারি এক্সপেক্টেশন কেমন, কী ধরণের কাজ আমার পছন্দ এই সব। ঘন্টা খানেক ওর সাথে থেকে ও আমাকে আমার প্রথম টেকনিকাল ইন্টারভিউয়ার এর কাছে পাঠিয়ে দেয়। মাইক্রোসফটএ বিভিন্ন বিল্ডিং এর মধ্যে সারাক্ষণ অনেক শাটল কার চলাচল করে। ও আমাকে সেরকম একটা কারে করে বিল্ডিং ৪০ এ আমার প্রথম ইন্টারভিউয়ার এর কাছে পাঠিয়ে দেয়।

বর্ণনা অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার প্রথম ইন্টারভিউয়ার এর গল্প না বললেই নয়। যেহেতূ তখন লাঞ্চ এর সময় হয়ে গিয়েছেলো, তাই আমার প্রথম ইন্টারভিউটি ছিলো একটা লাঞ্চ ইন্টারভিউ। লাঞ্চ ইন্টারভিউ মানে হচ্ছে ইন্টারভিউয়ার চাকরীপ্রার্থীকে লাঞ্চএ নিয়ে যাবে এবং খাবার খেতে খেতে বিভিন্ন প্রশ্ন করবে। আমার প্রথম ইন্টারভিউয়ারের নাম ছিলো আ্যলেক্স। ও একজন চাইনিজ-আমেরিকান। গতো প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর ধরে আমেরিকাতে আছে। তো ও আমাকে ক্যাফেটারিয়ার দিকে নিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো আমার কী ধরণের খাবার পছন্দ। আমি মাছে ভাতে বাঙ্গালী। ওকে বললাম ঝাল মশলা দেওয়া ইন্ডিয়ান (বাংলাদেশী খাবার বললে ওরা চিনেনা, আমাদের টাইপের খাবারকে ওরা ইন্ডিয়ান খাবার বলে) খাবার আমি পছন্দ করি, আমেরিকান খাবার তখনো আমার মুখে রচে না। ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, “চলো আমার সাথে”। আমাকে নিয়ে সোজা পার্কিং গারাজে যেয়ে ওর বিশাল জীপ গাড়িতে উঠলো। এরপর আমাকে নিয়ে গেলো মায়ুরি নামের এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টএ! মায়ুরিতে ভাত আর মশলা দেওয়া মুরগীর তরকারী খেতে খেতে দিলাম আমার মাইক্রোসফট এর প্রথম ইন্টারভিউ!

এরপর একে একে আরো তিনটি ইন্টারভিউ দিই। প্রত্যেক ইন্টারভিউয়ার তার ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী ইন্টারভিউয়ার এর কাছে পাঠিয়ে দেয়। চার ইন্টারভিউয়ারের প্রথম দুইজন ছিলো উইন্ডোজ নেটওয়ার্কিং গ্রুপ এর, আর শেষের দুজন ছিলো উইন্ডোজ ফান্ডামেন্টালস গ্রুপ এর। শেষ ইন্টারভিউ নেন উইন্ডোজ গ্রুপ এর একজন ডিরেক্টর। তাঁর সাথে কথা বলার সময়ই মনে হয়েছিলো আমার ইন্টারভিউ মনে হয় খারাপ হয়নি। ইন্টারভিউ এর শেষে তিনি যে কথাগুলি বলেছিলেন সেটা এখনো আমার মনে আছে – “ঠিক আছে তুমি তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাও আর মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো। দেখি আমি তোমার জন্য কী করতে পারি”। তাঁর এ ধরণের কথা আমার কাছে খুব পজিটিভ মনে হয়েছিলো!

এর এক সপ্তাহ পরেই আমার সেমেস্টার ফাইনাল পরীক্ষা থাকায় আমি ওইদিন রাতেই ওহাইও ফিরে আসি। পরেরদিন সকালবেলা আমার দাঁতের ডাক্তার এর সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিলো। সকালে আমি আমার দাঁতের স্কেলিং করাচ্ছিলাম। আমার ফোন বন্ধ ছিলো। দাঁতের ক্লিনিক থেকে বের হয়ে মোবাইল অন করতেই দেখি একটা ভয়েস মেইল। মাইক্রোসফট থেকে আমার রিক্রুটার ডেভিড ফোন করেছে। ভয়েস মেইলএ ও জানালো আমার ইন্টারভিউ এর রেজাল্ট রেডি ওর কাছে, আমি যেনো ওকে কল ব্যাক করি। আমারতো তখন বুকের ভেতর ড্রামের বাড়ি হচ্ছে। আমি সাথে সাথেই ওকে কল করি। আর তখনি ও আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো খবরগুলির একটি জানালোঃ মাইক্রোসফট এর দুটি গ্রুপ – উইন্ডোজ ফান্ডামেন্টালস আর উইন্ডোজ নেটওয়ার্কিং – আমাকে সামনের সামারের জন্য একটি ইন্টার্ণশীপ অফার করছে!! গ্রুপ দুইটির ডিরেক্টর দুজন আমাকে ফোন করে তাঁদের গ্রুপ সম্পর্কে বলবেন, এরপর আমি যে গ্রুপ পছন্দ করি সেটিতেই জয়েন করতে পারবো।

এটা ছিলো আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ সময়। নেটওয়ার্কিং এর প্রতি আমার আগ্রহ থাকায় আমি নেটওয়ার্কিং গ্রুপকেই সিলেক্ট করি। অবশ্য ফান্ডামেন্টালস গ্রুপ আমাকে ঘুষ হিসেবে এক্সবক্স গেমস, ওয়েব ক্যাম, বিভিন্ন ধরণের মাক্রোসফট কম্পানী স্যুভেনীর পাঠিয়েছিলো ওদের গ্রুপ এর দিকে আকৃষ্ট করার জন্য! কিন্তু ঘুষ দিয়ে কি আর সবকিছু হয়ঃ-)

২০০৭ এর জুন মাসের ১২ তারিখে আমি মাইক্রোসফটএ উইন্ডোজ নেটওয়ার্কিং গ্রুপ এর ওয়েব ক্লায়েন্ট টিম (যারা http প্রটোকল implement করে) এর একজন ইন্টার্ণ হিসেবে জয়েন করি। শুরু হয় আরেক বিচিত্র আনন্দ যাত্রা। সে যাত্রার খবর আগামী পর্বে। এইবেলা এখানেই ইতি টানি!

ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েব – ইন্টারনেট প্রযুক্তি কোন দিকে যাচ্ছে?

আশি’র দশকের শেষের দিকে টিম বার্নার্স-লি যে ওয়েব (Web) নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, সেই ওয়েব যে আজকে এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে সেটা তিনি নিজেই ভেবেছিলেন কিনা সন্দেহ আছে। ওয়েব প্রযুক্তি দিনদিন সমৃদ্ধ হচ্ছে, আমাদের জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর প্রায় সবকিছুই এখন ওয়েবএ পাওয়া যায়। মানুষের সাথে মানুষের এতো সহজ যোগা্যোগ এবং তথ্যের আদান-প্রদান পৃথিবীর ইতিহাসে আগে কখনো হয়নি।

আমরা অনেকেই ইন্টারনেট বলতে যা বুঝি সেটা হচ্ছে আসলে ওয়েব। ওয়েব হচ্ছে ইন্টারনেট এর অনেকগুলো আ্যপ্লিকেশন এর একটি। অন্যান্য আরো কিছু আ্যপ্লিকেশন হচ্ছে ইমেইল, এফটিপি (ফাইল ট্রান্সফার প্রোটোকল), এসএসএইচ (SSH) ইত্যাদি। ইন্টারনেট বলতে বস্তুত এই পৃথিবীব্যাপী নেটওয়ার্কেই বুঝায়। ওয়েবই আসলে সবচেয়ে দৃশ্যমান এবং সবচেয়ে বেশি ব্যাবহৃত ইন্টারনেট আ্যপ্লিকেশন। ওয়েব এর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে তথ্যের সহজলভ্যতা। তথ্য বলতে যে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয় বুঝায় তা কিন্তু নয়। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের যাকিছু জানার প্রয়োজন তাই তথ্য। আমার বন্ধু সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বেড়াতে গেছে সেটি একটি তথ্য, সেখানে ও অনেক ছবি তুলেছে সেই ছবিগুলোও একধরণের তথ্য, সেখানে কোথায় ভালো খাবার পাওয়া যায় সেটাও তথ্য। তথ্যের এই বহুমাত্রিকতা শুরু হয় বিশেষ করে সোশাল নেটওয়ার্কগুলোর প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে।

তথ্য আদান-প্রদানই হয়ে উঠছে ওয়েব ভিত্তিক কম্পানীগুলোর মূল ব্যবসা। গুগলের মূল মিশন হচ্ছে বিশ্বজগতের সব তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ওয়েব এর প্রথম দিকে ব্যাপারটি ছিলো আমাদের নিজেদের দরকারী তথ্য খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে ব্যাপারটি এমন হতে চলেছে যে দরকারী তথ্য আমাদেরকে খুঁজে নিবে। গুগল, মাইক্রোসফট, ইয়াহু, ফেইসবুক, টুইটার, উইকিপিডিয়া, ফ্রেণ্ডফিড, মাইস্পেস, অরকুট, ডিগ, টেকমিম সবাই এই তথ্য প্রবাহ এবং যোগাযোগকে মানুষের আরো কাছে নিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আরএসএস এবং রিয়াল টাইম আপডেট এর মতো প্রযুক্তিগুলো আবিষ্কার হয়েছে এধরণের সেবা দেওয়ার জন্য। গতো কয়েক বছরে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে মানুষ সংবাদের জন্য টেলিভিশন-সংবাদপত্র ইত্যাদির চেয়ে ওয়েব এর কাছেই বেশি যাচ্ছে। সংবাদ পড়ার জন্য আগে মানুষ সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, গুগল নিউজ ইত্যাদি সাইটে গেলেও ইদানিং সোশাল নেটওয়ার্ক এবং ব্লগ হয়ে উঠছে সংবাদের নতুন উৎস।

এ ব্যাপারটা প্রথম আমি খেয়াল করি গতো মার্চ মাসে আমেরিকান এয়ারলাইন্স এর একটি প্লেইন নিউ ইয়র্কের হাডসন নদীতে জরুরী অবতরণ করার পর। এই ঘটনার খবর সবার আগে জনসম্মুখে আসে টুইটারের মাধ্যমে। প্রত্যক্ষদর্শীদের (এবং উদ্ধারকারীদের) মধ্যে অনেকেই টুইটার ব্যবহারকারী ছিলেন এবং তারা প্রতিনিয়ত ছোট ছোট টুইট (১৪০ শব্দের ভেতর এসএমএস এর মতো অনলাইন মেসেজ) দিয়ে ঘটনার আপডেট দিচ্ছিলেন। টুইটারের সুবিধা হলো এটি ব্যবহার করে রিয়াল টাইম সংবাদ দেয়া যায়। এটাকে বলা যায় এসএমএস এর অনলাইন ভার্শন। কিন্তু এসএমএস দিয়ে যেখানে একসাথে একজনকে মেসেজ পাঠানো যায়, টুইটারের সাহায্যে সেখানে আক্ষরিক অর্থেই কয়েক মিলিয়ন মানুষের কাছে মেসেজ পাঠানো যায়। টুইটারের এমন উত্থানের পর সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস এর মতো সংবাদ মাধ্যমগুলো অনেক দুশ্চিন্তায় আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সিএনএন (@cnnbrk) এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস (@nytimes) দুটি’রই টুইটার একাউন্ট আছে! টুইটারকে অনেকেই বলছে গুগল এবং ফেইসবুকের নতুন প্রতিদ্বন্ধী। ফেইসবুকের সর্বশেষ ডিজাইনটি করা হয়েছে আসলে টুইটারকে নকল করে এবং একে টপকে যাওয়ার জন্য। খেয়াল করে দেখবেন ফেইসবুক সারাক্ষণ সবার স্টেটাস আপডেট আপনার পেইজে নিয়ে আসে। অনেক খবর, যেমন মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যু, মানুষ প্রথম জেনেছে ফেইসবুকে বন্ধুদের স্টেটাস মেসেজ থেকে!

টুইটার সর্বশেষ সবাইকে টপকে যায় সাম্প্রতিক ইরানের সাধারণ নির্বাচনের সময়। ইরান সরকারের নানারকম সেন্সরশীপের কারণে ইরানের ভেতরের খবর বাইরে যাবার পথ প্রায় বন্ধ তখন। ইরানের জনগণ তখন টুইটার ব্যবহার করে নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন-সহিংসতার খবর ওয়েবে পোস্ট করতে থাকে। সিএনএন এর মতোন সংবাদ সংস্থা যখন সংবাদ সরবরাহে ব্যর্থ হচ্ছিলো টুইটারের মতো অনলাইন মেসেজিং সাইট তখন হয়ে উঠলো সংবাদের প্রধান উৎস। এমনকি টুইটার তাদের নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষণ কাজ পিছিয়ে দেয় ইরানের সংবাদ প্রবাহ চালু রাখার জন্য। টুইটারের এমন একচেটিয়া আধিপত্য দেখে গুগল আর ফেসবুক তড়িঘড়ি করে চালু করে ফার্সী সার্ভিস

সারা বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর ব্যবহার কমে আসছে ওয়েব এর কারণে। এমনকি বিজ্ঞাপন এর একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে ওয়েবএ। ওয়েব এর বিজ্ঞাপন বাজার যে কতো বড় সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে গুগল। কেবলমাত্র বিজ্ঞাপন এর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে কম্পানীটি। মাইক্রোসফট প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই বাজারের একটা অংশ ধরার জন্য, যার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে তাদের বিং সার্চ ইঞ্জিন এবং উইন্ডোজ আজুর ওয়েব অপারেটিং সিসটেম। সংবাদমাধ্যমগুলো যদি ওয়েবএ তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত না করে তাহলে তাদের ভবিষ্যত যে অন্ধকার সেটা প্রায় নিশ্চিত!

পৃথিবীজুড়ে ওয়েবএ প্রাপ্ত সার্ভিসগুলো মানুষের জীবনকে অনেক সহজ করে দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো দিবে। অনলাইনে কেনাকাটা, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে ফেইসবুকের মাধ্যমে ফিরে পাওয়া, বাসার যাবতীয় বিল কম্পিউটারে কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে সেরে ফেলা, বাস-ট্রেইন-প্লেইন এর টিকেট কয়েক মিনিটের মধ্যে অনলাইনে কিনে ফেলা, যে কোন ঘটনা-দুর্ঘটনার খবর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্লগ ও সোশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পেয়ে যাওয়া ইত্যাদি সুবিধা ইতোমধ্যে সবাই পেতে শুরু করেছে। এই গতিতে প্রযুক্তি চলতে থাকলে আর দশ-বিশ বছরের মধ্যে জীবন যে কতো সহজ হয়ে যাবে সেটা এখন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ওয়েব সেবা’র ব্যাপ্তি কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোনের সাহায্যে। ওয়েব একসেস সমৃদ্ধ মোবাইল ফোনকে এখন বলা হয় স্মার্ট ফোন। কপমিউটার এর চেয়ে অনেক বেশি বহনযোগ্য হওয়ায় মোবাইল এর মাধ্যমে আরো বেশি মানুষকে ওয়েব সেবার আওতায় নিয়ে আসা যাচ্ছে। আ্যপলের আইফোন, গুগলের এন্ড্রয়েড, মাইক্রোসফট এর উইন্ডোজ মোবাইল – এগুলো সবই প্রায় ডেস্কটপ কম্পিউটার এর সমান ক্ষমতা সম্পন্ন অপারেটিং সিসটেম মোবাইল এর জন্য। এভাবে মোবাইল ফোনগুলো হয়ে উঠছে একেকটি বহনযোগ্য কম্পিউটার। আমার জীবনের প্রথম কম্পিউটার ছিলো এএমডি কে৬ টু যার প্রসেসর স্পিড ছিলো ৪৫০ MHz. আ্যপলের সর্বশেষ আইফোন এর প্রসেসর স্পিড হচ্ছে ৬৫০ MHz!

ওয়েব কম্পানীগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে মানুষ বেশি বেশি সেবা পাচ্ছে কম মূল্যে বা (প্রায়ই) বিনা মূল্যে। গুগল, মাইক্রোসফট, ফেইসবুক, টুইটার, ফ্রেন্ডফিড এর মতো কম্পানীগুলো বাঘা বাঘা কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রযুক্তিকে আরো বেশি মানুষের কাজে লাগানোর জন্য। এতে ওদের ব্যবসা হচ্ছে ঠিক, কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতার চাকাও ঘুরছে সামনের দিকে। মানুষের জীবন হয়ে উঠছে আরো আরামদায়ক। দুখের বিষয় আমরা বাংলাদেশে থেকে এর অনেক কিছুই পাচ্ছিনা শুধুমাত্র ভালো গতির ইন্টারনেট আর নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ এর অভাবে। আর এভাবেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি বাকী পৃথিবী থেকে। আমাদের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী – এরা যেদিন নিজেদের পরিবারের বাইরে দেশের মানুষের কথা ভাবা শুরু করবেন এবং যেদিন আমাদের দেশের মানুষেরা জীবনকে আরো বেশি ভালোবাসা শুরু করবে, আরো সাহসী আর এডভেঞ্চারাস হয়ে উঠবে, সেদিন থেকে বদলে যাওয়া শুরু করবে আমাদের দেশ!

“ভালোবাসার কাজটি খুঁজে নিতে হবে” – স্টিভ জবস এর বিখ্যাত সমাবর্তন বক্তৃতা

স্টিভ জবস আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। ২০০৫ সালে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হন। সেখানে দেওয়া তাঁর বক্তৃতাটি ছিলো অসাধারণ একটি বক্তৃতা। সত্যি কথা বলতে কি এটা আমার জীবনে শোনা/পড়া সেরা বক্তৃতা। দুর্ভাগ্যক্রমে অনুবাদের পর এর আবেগ অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে! তবুও অনুবাদ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। মূল ইংরেজী বক্তৃতাটি পাওয়া যাবে এখানেঃ http://news-service.stanford.edu/news/2005/june15/jobs-061505.html

ভালোবাসার কাজটি খুঁজে নিতে হবে
======================

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আসতে পেরে আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি। আমি কখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করিনি। সত্যি কথা বলতে কি, আজকেই আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান সবচেয়ে কাছ থেকে দেখছি। আজ আমি তোমাদেরকে আমার জীবনের তিনটি গল্প বলবো। তেমন আহামরী কিছু না। শুধু তিনটা গল্প।

প্রথম গল্পটি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এক সূতোয় বাঁধা নিয়ে (connecting the dots)।

রিড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ছয় মাসের মাথায় আমি মোটামুটি পড়ালেখা ছেড়ে দিই। অবশ্য পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার আগে প্রায় বছর দেড়েক এটা সেটা কোর্স নিয়ে কোনমতে লেগেছিলাম। তো কেনো আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছিলাম?

ঘটনার শুরু আমার জন্মের আগে থেকে। আমার আসল মা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবিবাহিতা তরুণী গ্রাজুয়েট ছাত্রী। আমার জন্মের আগে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে কারো কাছে দত্তক দিবেন। মা খুব চাচ্ছিলেন আমাকে যারা দত্তক নিবেন তাদের যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী থাকে। তো একজন আইনজীবি এবং তাঁর স্ত্রী আমাকে দত্তক নেওয়ার জন্য রাজি হলো। কিন্তু আমার জন্মের পর তাঁদের মনে হলো তাঁরা আসলে একটা কন্যা শিশু চাচ্ছিলেন।

অতএব আমার বর্তমান বাবা-মা, যারা অপেক্ষমাণ তালিকাতে ছিলেন, গভীর রাতে একটা ফোন পেলেন – “আমাদের একটা অপ্রত্যাশিত ছেলে শিশু আছে, আপনারা ওকে নিতে চান?” “অবশ্যই!” – আমার বাবা-মা’র তড়িৎ উত্তর। আমার আসল মা পরে জানতে পেরেছিলেন যে আমার নতুন মা কখনো বিশ্ববিদ্যালয় আর নতুন বাবা কখনো হাই স্কুলের গন্ডি পেরোননি। তিনি দত্তক নেবার কাগজপত্র সই করতে রাজী হননি। কয়েক মাস পরে অবশ্য তিনি রাজী হয়েছিলেন, আমার নতুন বাবা-মা এই প্রতিজ্ঞা করার পর যে তারা একদিন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন।

১৭ বছর পর আমি সত্যি সত্যি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি বোকার মতো প্রায় স্ট্যানফোর্ডের সমান খরচের একটা বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিয়েছিলাম। এবং আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত পিতামাতার সব জমানো টাকা আমার পড়ালেখার খরচের পেছনে চলে যাচ্ছিলো। ছয় মাস এভাবে যাওয়ার পর আমি এর কোন মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জীবনে কী করতে চাই সে ব্যাপারে আমার তখনো কোন ধারণা ছিলোনা, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা এ ব্যাপারে কিভাবে সাহায্য করবে সেটাও আমি বুঝতে পারছিলাম না। অথচ আমি আমার বাব-মা’র সারা জীবনের জমানো সব টাকা এর পেছনে দিয়ে দিচ্ছিলাম। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং আশা করলাম যে সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ওই সময়ের প্রেক্ষিতে এটা একটা ভয়াবহ সিদ্ধান্ত মনে হতে পারে, কিন্তু এখন পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিলো। যেই মুহুর্তে আমি বিশ্ববিদ্যালয়
ছেড়ে দিলাম সেই মুহুর্ত থেকে আমি আমার অপছন্দের অথচ ডিগ্রীর জন্য দরকারী কোর্সগুলো নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারলাম, এবং আমার পছন্দের কোর্সগুলো নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে গেলো।

অবশ্য ব্যাপারটি অতোটা সুখকর ছিলোনা। ছাত্রহলে আমার কোন রুম ছিলোনা, তাই আমি আমার বন্ধুদের রুমে ফ্লোরে ঘুমাতাম। ব্যবহৃত কোকের বোতল ফেরত দিয়ে আমি পাঁচ সেন্ট করে পেতাম (প্রতি বোতল) যেটা দিয়ে আমি আমার খাবার কিনতাম। প্রতি রবিবার আমি সাত মাইল হেঁটে শহরের অপর প্রান্তে অবস্থিত হরে কৃষ্ণ মন্দিরে যেতাম শুধুমাত্র একবেলা ভালো খাবার খাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি এটাকে পছন্দ করতাম। আমার কৌতুহল এবং ইনটুইশন অনুসরণ করে আমার জীবনে আমি যতোকিছু করেছি পরবর্তীতে সেটাই আমার কাছে মহামূল্যবান হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। একটা উদাহরণ দিইঃ

সেই সময় রীড কলেজ সম্ভবত দেশের সেরা ক্যালিগ্রাফী কোর্সগুলো করাতো। ক্যাম্পাসের প্রত্যেকটি পোস্টার, প্রতিটি লেবেল করা হতো হাতে করা ক্যালিগ্রাফী দিয়ে। যেহেতু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম না, তাই আমি যেকোনো কোর্স নিতে পারতাম। তাই ভাবলাম ক্যালিগ্রাফী কোর্স নিয়ে ক্যালিগ্রাফী শিখবো। আমি সেরিফ এবং স্যান সেরিফ টাইপফেইস শিখলাম, বিভিন্ন অক্ষরের মধ্যে স্পেস কমানো বাড়ানো শিখলাম, ভালো টাইপোগ্রাফী কিভাবে করতে হয় সেটা শিখলাম। ব্যাপারটা ছিলো দারুণ সুন্দর, ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা আর্ট। এবং এটা আমাকে বেশ আকর্ষণ করতো।

এই ক্যালিগ্রাফী জিনিসটা কখনো কোনো কাজে আসবে এটা আমি কখনো ভাবিনি। কিন্তু, দশ বছর পর যখন আমরা আমাদের প্রথম ম্যাকিন্টস কম্পিউটার ডিজাইন করি তখন এর পুরো ব্যাপারটাই আমাদের কাজে লেগেছিলো। ম্যাক কম্পিটার টাইপোগ্রাফী সমৃদ্ধ প্রথম কম্পিটার। আমি যদি দশ বছর আগে সেই ক্যালিগ্রাফী কোর্সটা না নিতাম তাহলে ম্যাক কম্পিউটারে কখনো মাল্টিপল টাইপফেইস এবং আনুপাতিক দুরত্মের ফন্ট থাকতো না। আর যেহেতু উইন্ডোজ ম্যাক এর এই ফন্ট নকল করেছে, বলা যায় কোনো কম্পিউটারেই এই ধরণের ফন্ট থাকতো না। আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয় না ছাড়তাম তাহলে আমি কখনোই ওই ক্যালিগ্রাফী কোর্সে ভর্তি হতাম না, এবং কম্পিউটারে হয়তো কখনো
এতো সুন্দর ফন্ট থাকতো না। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় এই সব বিচ্ছিন্ন ঘটোনাগুলোকে এক সুতোয় বাঁধা অসম্ভব ছিলো, কিন্তু দশ বছর পর সবকিছু একেবারে পরিস্কার বোঝা গিয়েছিলো!

তুমি কখনোই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে এক সূতায় বাঁধতে পারবেনা। এটা শুধুমাত্র পেছনে তাকিয়েই সম্ভব। অতএব, তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো একসময় একটা ভালো পরিণামের দিকে যাবে ভবিষ্যতে। তোমাকে কিছু না কিছুর উপর বিশ্বাস করতেই হবে – তোমার মন, ভাগ্য, জীবন, কর্ম, কিছু একটা। এই বিশ্বাস আমাকে কখনোই ব্যর্থ করে দেয়নি, বরং আমার জীবনের সব বড় অর্জনে বিশাল ভুমিকা রেখছে।

আমার দ্বিতীয় গল্পটি ভালোবাসা আর হারানো নিয়ে।

আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম। আমি আমার জীবনের প্রথম দিকেই আমার ভালোবাসার কাজ খুঁজে পেয়েছিলাম। ওজ আর আমি আমার বাবা-মা’র বাড়ির গারাজে এপল কম্পানী শুরু করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিলো ২০ বছর।

আমরা কঠিন পরিশ্রম করেছিলাম – ১০ বছরের মাথায় এপল কম্পিউটার গারাজের ২ জনের কম্পানী থেকে ৪০০০ এম্পলয়ীর ২ বিলিয়ন ডলারের কম্পানীতে পরিণত হয়। আমার বয়স যখন ৩০ হয় তার অল্প কিছুদিন আগে আমরা আমাদের সেরা কম্পিউটার – ম্যাকিন্টস – বাজারে ছাড়ি। আর ঠিক তখনি আমার চাকরি চলে যায়। কিভাবে একজন তার নিজের প্রতিষ্ঠিত কম্পানী থেকে চাকরিচ্যুত হয়? ব্যাপারটি এমনঃ এপল যখন অনেক বড়ো হতে লাগলো তখন আমি কম্পানীটি খুব ভালোভাবে চালাতে পারবে এমন একজনকে নিয়োগ দিলাম। প্রথম বছর সবকিছু ভালোভাবেই গেলো। কিন্তু এরপর তার সাথে আমার চিন্তাভাবনার বিভাজন স্পষ্ট হওয়া শুরু হলো। এবং পরিচালনা পর্ষদ তার পক্ষ নিলো। অতএব, ৩০ বছর বয়সে আমি কম্পানী থেকে আউট হয়ে গেলাম। এবং খুব ভালোভাবে আউট হলাম। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন এক নিমিষে আমার হাতছাড়া হয়ে গেলো। ঘটনাটা আমাকে বেশ ভেঙ্গে দিয়েছিলো।

এরপরের কয়েক মাস আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি কী করবো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি আগের প্রজন্মের উদ্যোগতাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছি – আমার হাতে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা আমি করতে পারিনি। আমি ডেভিড প্যাকার্ড এবং বব নয়েস এর সাথে দেখা করে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইলাম। একবার ভাবলাম ভ্যালী ছেড়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি একটা ব্যাপার অনুভব করতে লাগলাম – আমি আমার কাজকে এখনো ভালোবাসি! এপলের ঘটনাগুলি সেই সত্যকে এতোটুকু বদলাতে পারেনি। আমাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, কিন্তু আমি এখনো আমার কাজকে ভালোবাসি। তাই আমি আবার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

প্রথমে এটা তেমন মনে হয়নি, কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম এপল থেকে চাকরিচ্যুত হওয়াটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো ঘটনা। সফল হবার ভার চলে যেয়ে আমি তখন নতুন করে শুরু করলাম। কোন চাপ নেই, সবকিছু সম্পর্কে আগের চেয়ে কম নিশ্চিত। ভারমুক্ত হয়ে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সৃজনশীল সময়ে যাত্রা শুরু করলাম।

পরবর্তী পাঁচ বছরে আমি নেক্সট এবং পিক্সার নামে দুটো কম্পানী শুরু করি, আর প্রেমে পড়ি এক অসাধারণ মেয়ের যাকে আমি পরে বিয়ে করি। পিক্সার থেকে আমরা পৃথিবীর প্রথম এনিমেশন ছবি “টয় স্টোরী” তৈরি করি। পিক্সার বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল এনিমেশন স্টুডিও। এরপর ঘটে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা। এপল নেক্সটকে কিনে নেয় এবং আমি এপলএ ফিরে আসি। এবং নেক্সটএ আমরা যে প্রযুক্তি তৈরি করি সেটা এখন এপল এর বর্তমান ব্যবসার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। অন্যদিকে লরেন আর আমি মিলে তৈরি করি একটা সুখী পরিবার।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত এগুলোর কিছুই ঘটতো না যদি না আমি এপল থেকে চাকরিচ্যুত হতাম। এটা ছিলো খুব তেতো একটা ওষুধ আমার জন্য, কিন্তু আমার মনে হয় রোগীর সেটা দরকার ছিলো। কখনো কখনো জীবন তোমাকে মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে। তখন বিশ্বাস হারাইওনা। আমি নিশ্চিত যে জিনিসটা আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো সেটা হচ্ছে – আমি আমার কাজকে ভালোবাসতাম। তোমাকে অবশ্যই তোমার ভালবাসার কাজটি খুঁজে পেতে হবে। তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে যেভাবে তোমার খুঁজে পেতে হয়, ভালোবাসার কাজটিকেও তোমার সেভাবে খুঁজে পেতে হবে। তোমার জীবনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকবে তোমার কাজ, তাই জীবন নিয়ে সন্তুস্ট হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে চমৎকার কোনো কাজ করা। আর কোনো কাজ তখনি চমৎকার হবে যখন তুমি তোমার কাজকে ভালোবাসবে। যদি এখনো তোমার ভালোবাসার কাজ খুঁজে না পাও তাহলে খুঁজতে থাকো। অন্য কোথাও স্থায়ী হয়ে যেওনা। তোমার মন আর সব জিনিসের মতোই তোমাকে জানিয়ে দিবে যখন তুমি তোমার ভালোবাসার কাজটি খুঁজে পাবে। যে কোনো সম্পর্কের মতোই, তোমার কাজটি যতো সময় যাবে ততোই ভালো লাগবে। সুতরাং খুঁজতে থাকো যতক্ষন না ভালোবাসার কাজটি পাচ্ছো। অন্য কোন কাজে স্থায়ী হয়ো না।

আমার শেষ গল্পটি মৃত্যু নিয়ে।

আমার বয়স যখন ১৭ ছিলো তখন আমি একটা উদ্ধৃতি পড়েছিলামঃ “তুমি যদি প্রতিটি দিন এটা ভেবে পার কর যে আজই তোমার জীবনের শেষ দিন, তাহলে একদিন তুমি সত্যি সঠিক হবে”। এই লাইনটা আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিলো, এবং সেই থেকে গতো ৩৩ বছর আমি প্রতিদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করি – “আজ যদি আমার জীবনের শেষ দিন হতো তাহলে আমি কি যা যা করতে যাচ্ছি আজ তাই করতাম, নাকি অন্য কিছু করতাম?” যখনি এই প্রশ্নের উত্তর “না” হতো পরপর বেশ কিছু দিন, আমি জানতাম আমার কিছু একটা পরিবর্তন করতে হবে।

“আমি একদিন মরে যাবো” – এই কথাটা মাথায় রাখা আমার জীবনে আমাকে বড় বড় সব সিদ্ধান্ত নিতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। কারণ সবকিছু – সকল আশা-প্রত্যাশা, গর্ব, ব্যর্থতার ভয় বা লজ্জা – এইসব কিছু মৃত্যুর মুখে নাই হয়ে যায়, শুধুমাত্র সত্যিকারের গুরুত্মপূর্ণ জিনিসগুলোই টিকে থাকে। তোমার কিছু হারানোর আছে এই চিন্তা দূর করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এটা মনে রাখা যে একদিন তুমি মরে যাবে। তুমি নগ্ন হয়েই আছো।

অতএব নিজের মনকে না শোনার কোনো কারণই নাই।

প্রায় এক বছর আগে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে। সকাল ৭:৩০ এ আমার একটা স্ক্যান হয় এবং এতে পরিস্কারভাবে আমার প্যানক্রিয়াসএ একটা টিউমার দেখা যায়। আমি তখনো জানতাম না প্যানক্রিয়াস জিনিসটা কী। আমার ডাক্তাররা বললেন এই ক্যান্সার প্রায় নিশ্চিতভাবে আরোগ্য, এবং আমার আয়ু আর তিন থেকে ছয় মাস আছে। আমার ডাক্তার আমাকে বাসায় ফিরে যেয়ে সব ঠিকঠাক করতে বললেন। সোজা কথায় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়া।

এরমানে হচ্ছে তুমি তোমার সন্তানদের আগামী দশ বছরে যা বলবে বলে ঠিক করেছো তা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বলতে হবে। এরমানে হচ্ছে সবকিছু গোছগাছ করে রাখা যাতে তোমার পরিবারের সবার জন্য ব্যাপারটি যথাসম্ভব কম বেদনাদায়ক হয়। এরমানে হচ্ছে সবার থেকে বিদায় নিয়ে নেওয়া।

এভাবে সেদিন সারাদিন গেলো। সেদিন সন্ধ্যায় আমার একটা বায়োপসি হলো। তারা আমার গলার ভেতর দিয়ে একটা এন্ডোস্কোপ নামিয়ে দিলো, এরপর আমার পেটের ভেতর দিয়ে যেয়ে আমার ইনটেস্টাইন থেকে সুঁই দিয়ে কিছু কোষ নিয়ে আসলো। আমাকে অজ্ঞান করে রেখেছিলো তাই আমি কিছুই দেখিনি। কিন্তু আমার স্ত্রী পরে আমাকে বলেছিলো যে আমার ডাক্তাররা যখন এন্ডোস্কোপি থেকে পাওয়া কোষগুলি মাইক্রোস্কোপ এর নিচে রেখে পরীক্ষা করা শুরু করলো তখন তারা প্রায় কাঁদতে শুরু করেছিলো, কারণ আমার যে ধরণের প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার হয়েছিলো সেটার আসলে সার্জারীর মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব। আমার সেই সার্জারী হয়েছিলো এবং এখন আমি সুস্থ্য।

এটাই আমার মৃত্যুর সবচেয়ে কাছাকাছি যাওয়া, এবং আমি আশা করি আরো কয়েক দশকের জন্যও এটা তাই যেনো হয়। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি যাওয়ার এই বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণে মৃত্যু সম্পর্কে এখন আমি অনেক বেশি জানি, যেটা আমি জানতাম না যদি না এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না যেতামঃ

কেউই মরতে চায় না। এমনকি যারা বেহেশতে যেতে চায়, তারাও সেখানে যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি মরে যেতে চায় না। কিন্তু এরপরও মৃত্যুই আমাদের সবার গন্তব্য। কেউই কখনো এটা থেকে পালাতে পারেনি। এবং সেটাই হওয়া উচিৎ, কারণ মৃত্যু সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে বড় আবিস্কার। এটা জীবনের পরিবর্তনের এজেন্ট। মৃত্যু পুরনোকে ধুয়ে মুছে নতুনের জন্য জায়গা করে দেয়। এই মুহুর্তে তোমরা হচ্ছো নতুন, কিন্তু খুব বেশিদিন দূরে নয় যেদিন তোমরা পুরনো হয়ে যাবে এবং তোমাদেরও ধুয়ে মুছে ফেলা হবে। নাটকীয়ভাবে বলার জন্য দুঃখিত, কিন্তু এটা খুবই সত্যি।

তোমাদের সময় সীমিত, অতএব, অন্য কারো জীবন যাপন করে সময় নষ্ট করো না। কোনো মতবাদের ফাঁদে পড়ো না, অর্থ্যাৎ অন্য কারো চিন্তা-ভাবনা দিয়ে নিজের জীবন চালিয়ো না। তোমার নিজের ভেতরের কন্ঠকে অন্যদের চিন্তা-ভাবনার কাছে আটকাতে দিও না। আর সবচেয়ে বড় কথাঃ নিজের মন আর ইনটুইশন এর কথা শোনার সাহস রাখবে। ওরা ঠিকই জানে তুমি আসলে কি হতে চাও। বাকী সব কিছু ততোটা গুরুত্মপূর্ণ নয়।

আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন একটা পত্রিকা বের হতো যার নাম ছিলো “The Whole Earth Catalog” (সারা পৃথিবীর ক্যাটালগ). এটা ছিলো আমার প্রজন্মের একটা বাইবেল। এটা বের করেছিলেন স্টুয়ার্ড ব্র্যান্ড নামে এক ভদ্রলোক যিনি মেনলো পার্কের কাছেই থাকতেন। তিনি পত্রিকাটিকে কাব্যময়তা দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। এটা ছিলো ষাট এর দশকের শেষ দিককার কথা – কম্পিউটার এবং ডেস্কটপ পাবলিশিং তখনো শুরু হয়নি। তাই পত্রিকাটি বানানো হতো টাইপরাইটার, কাঁচি, এবং পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে। পত্রিকাটিকে ৩৫ বছর আগের পেপারব্যাক গুগল বলা যায়ঃ অনেক তত্ত্ব-তথ্যে সমৃদ্ধ আর মহৎ উদ্দেশ্যে নিবেদিত।

স্টুয়ার্ট এবং তার টিম পত্রিকাটির অনেকগুলি সংখ্যা বের করেছিলো। পত্রিকাটির জীবন শেষ হয় একটা সমাপ্তি সংখ্যা দিয়ে। এটা ছিলো সত্তর এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, আমার বয়স ছিলো তোমাদের বয়সের কাছাকাছি। সমাপ্তি সংখ্যার শেষ পাতায় একটা ভোরের ছবি ছিলো। তার নিচে ছিলো এই কথাগুলিঃ “ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো”। এটা ছিলো তাদের বিদায় বার্তা। ক্ষুধার্ত থেকো। বোকা থেকো। এবং আমি নিজেও সবসময় এটা মেনে চলার চেষ্টা করে এসেছি। এবং আজ তোমরা যখন পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি ছেড়ে আরো বড় জীবনের গন্ডিতে প্রবেশ করছো, আমি তোমাদেরকেও এটা মেনে চলার আহবান জানাচ্ছি।

ক্ষুধার্ত থেকো। বোকা থেকো।

সবাইকে ধন্যবাদ।