Tag Archives: Personal

অপরাজিত…

Le-Meridien-Bora-Bora---Aerial
প্রথম জীবনের সে-সব মাধুরীভরা মুহূর্তগুলি যৌবনের কলকোলাহলে কোথায় মিলাইয়া গেল? কোথায় সে নীল আকাশ, মাঠ, আমের বউলের গন্ধভরা জ্যোৎস্নারাত্রি? পাখি আর ডাকে না, ফুল আর ফোটে না, আকাশ আর সবুজ মাঠের সঙ্গে মেশে না – ঘেঁটুফুলের ঝোপে ফোটা সদ্যফোটা ফুলের তেতো গন্ধ আর বাতাসকে তেতো করে না। জীবনে সে যে রোমান্সের স্বপ্ন দেখিয়াছিল – যে স্বপ্ন তাহাকে একদিন শত দুঃখের মধ্য দিয়া টানিয়া আনিয়াছে, তার সন্ধান তো কই এখনো মিলিল না? এ তো একরঙ্গা ছবির মতো বৈচিত্রহীন, কর্মব্যস্ত, একঘেয়ে জীবন – সারাদিন এখানে অফিসের বদ্ধ জীবন, রোকড়, খতিয়ান, মর্টগেজ, ইনকামট্যাক্সের কাগজের বোঝার মধ্যে পক্ককেশ প্রবীন ঝুনো সংসারাভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের সঙ্গে সপিনা ধরানোর প্রকৃষ্ট উপায় সম্বন্ধে পরামর্শ করা, এটর্নিদের নামে বড় বড় চিঠি মুসাবিদা করা – সন্ধ্যায় পায়রার খোপের মতো অপরিষ্কার নোংরা বাসাবাড়িতে ফিরিয়াই তখনি আবার ছেলে পড়াইতে ছোটা।

অফিসে সে নানা স্থানের ভ্রমণকাহিনী পড়ে, ডেস্কের মধ্যে পুরিয়া রাখে। পুরোনো বইয়ের দোকান হইতে নানা দেশের ছবিওয়ালা বর্ণনাপূর্ণ বই কেনে – নানা দেশের রেলওয়ে বা স্টিমার কোম্পানি যে সব দেশে যাইতে সাধারণকে প্রলুব্ধ করিতেছে – কেহ বলিতেছে, হাওয়াই দ্বীপে এসো একবার – এখানকার নারকেল কুন্জে, ওয়াকিকির বালুময় সমুদ্রবেলায় জোৎস্নারাত্রে যদি তারাভিমুখী ঊর্মিমালার সঙ্গীত না শুনিয়া মর, তবে তোমার জীবন বৃথা।

এল পাশো দেখ নাই। দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার চুনাপাথরের পাহাড়ের ঢালুতে, শান্ত রাত্রির তারাভরা আকাশের তলে কম্বল বিছাইয়া একবারটি ঘুমাইয়া দেখিও।।। শীতের শেষে নুড়িভরা উঁচুনিচু প্রান্তরে কর্কশ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে দু-এক ধরণের মাত্র বসন্তের ফুল প্রথম ফুটিতে শুরু করে, তখন সেখানকার সোডা-আলকালির পলিমাটিপড়া রৌদ্রদীপ্ত মুক্ত তরুবলয়ের রহস্যময় রুপ – কিংবা ওয়ালোয়া হ্রদের তীরে উন্নত পাইন ও ডগলাস ফারের ঘন অরণ্য, হ্রদের স্বচ্ছ বরফগলা জলে তুষারকিরীট মাজামা আগ্নেয়গিরির প্রতিচ্ছায়ার কম্পন – উত্তর আমেরিকার ঘন, স্তব্দ্ধ, নির্জন অরণ্যভূমির নিয়ত পরিবর্তনশীল দৃশ্যরাজি, কর্কশ বন্ধুর পর্বতমালা, গম্ভীরনিনাদী জলপ্রপাত, ফেনিল পাহাড়ি নদীতীরে বিচরণশীল বলগা হরিণের দল, ভালুক, পাহাড়ি ছাগল, ভেড়ার দল, উষ্ন প্রস্রবণ, তুষারপ্রবাহ, পাহাড়ের ঢালুর গায়ের সিডার ও মেপল গাছের বনের মধ্যে বুনো ভ্যালোরিয়ান ও ভায়োলেট ফুলের বিচিত্র বর্ণসমাবেশ – দেখ নাই এসব? এস এস!

টাহিটি! টাহিটি! কোথায় কত দূরে, কোন জোৎস্নালোকিত রহস্যময় কূলহীন স্বপ্নসমুদ্রের পারে, শুভরাত্রে গভীর জলের তলায় যেখানে মুক্তার জন্ম হয়, সাগরগুহায় প্রবালের দল ফুটিয়া থাকে, কানে শুধু দূরশ্রুত সংগীতের মতো তাহাদের অপূর্ব আহবান ভাসিয়া আসে। অফিসের ডেস্কে বসিয়া এক-একদিন সে স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকে – এই সবের স্বপ্নে। এই রকম নির্জন স্থানে, যেখানে লোকালয় নাই, ঘন নারিকেল কুন্জের মধ্যে ছোট কুটিরে, খোলা জানালা দিয়া দূরের নীল সমুদ্র চোখে পড়িবে – তার ওপারে মরকতশ্যাম ছোট ছোট দ্বীপ, বিচিত্র পক্ষীরাজি, অজানা দেশের অজানা আকাশের তলে তারায় আলোয় উজ্জ্বল মাঠটা একটা রহস্যের বার্তা বহিয়া আনিবে – কুটিরের ধারে ফুটিয়া থাকিবে ছোট ছোট বনফুল – শুধু সে আর অপর্ণা।

(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর “অপরাজিত” উপন্যাস থেকে নেওয়া)

Tagged , ,