Author Archives: bilash

ফিলিস্তিন, হায় ফিলিস্তিন!

১।

গত অক্টোবরের ৭ তারিখে হামাসের ইজরায়েলের অভ্যন্তরে হামলায় প্রায় ১২০০ মানুষ মারা যাওয়ার পর ইজরায়েল ফিলিস্তনের উপর ক্রমাগত বোমাবর্ষন এবং স্থল অভিযান পরিচালনা শুরু করে। ইজরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২১,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি মানুষ মারা যায় যার বেশিরভাগই নারী এবং শিশু।

ইজরায়েল (এবং তাদের সবচেয়ে বড় সমর্থক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র) হামাসকে একটা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। তাই হামাসের ৭ই অক্টোবরের হামলাকে একটা সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে চিহ্নিত করে তারা এখন হামাসকে নির্মুল করার অভিযান পরিচালনা করছে। হামাসকে নির্মুল করার নামে ইজরায়েল এখন ফিলিস্তিনিদেরকে এক প্রকার জাতিগত নিধন করছে গাজা এলাকা থেকে।

পুরো মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র ইরান আর ইয়েমেনের হুতিরা হামাস এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে সরাসরি কথা বলছে। হুতিরা নিজেরাই তেমন একটা শক্ত না, তার উপর সৌদি আরব গত ৮/৯ বছর ধরে হুতিদেরকে ক্রমাগত বোমা মেরে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপরও ওরা ওদের যা আছে তাই নিয়ে আমেরিকা এবং ইউরোপের মতো পরাশক্তিদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে লোহিত সাগরে ইজরায়েলমুখী সব জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।

তুরস্কের এরদোগান মাঝে মাঝে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে দুই একটা হম্বি তম্বি বক্তৃতা দিয়েই ফিলিস্তিনের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ শেষ করেন। ইজরায়েলে যাওয়া তেলের একটা বড় অংশ যায় তুরস্কের মধ্য দিয়ে। এবং ইজরায়েলের তেলের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে মুসলিম দেশগুলো।

সৌদি আরব আর আরব আমিরাত প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে ইজরায়েল আর আমেরিকার বন্ধু।

মিশর প্রতি বছর আমেরিকা থেকে শত শত মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা পেয়ে থাকে এক ধরণের ঘুষ হিসেবে। এই ঘুষের বিনিময়ে মিশর ইজরায়েলের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখে আর মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার চামচামি করে থাকে।

লেবানন এবং জর্ডান ইজারায়েলের সীমান্তবর্তী দুই দেশ। দুই দেশই ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু দুটি দেশই সামরিকভাবে দুর্বল, তাই তারা কোনভাবেই ইজরায়েলের সাথে লড়তে যাবে না।

তো এ ধরণের একটা অবস্থায় ফিলিস্তিনের মতো একটা পরাধীন দেশ, যাদের সবকিছু ইজরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে, তারা কীভাবে লড়াই করবে ইজরায়েল সাথে? ইজরায়েল প্রায় পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে অসহায় ফিলিস্তিনিদের নির্মুল  করে দিচ্ছে।

২।

এমন না যে আরব রাষ্ট্রগুলো কখনো ইজরায়েলকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেনি। ইজরায়লের জন্ম থেকে বেশ কয়েকবার আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথেক ইজরায়েলের যুদ্ধ হয়েছিল। প্রতিটি যুদ্ধে ক্ষুদ্র ইজরায়েল আক্রমণকারী সব আরব রাষ্ট্রগুলোকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। ইজরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোকে শুধু পরাজিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, মিশরের বিশাল সিনাই অঞ্চল এবং সিরিয়ার গোলান উপত্যকাও দখল করে নেয় তখন।

১৯৪৮ সালে ইজরায়েল এর জন্মের পরপরই মিশর, সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, এবং সৌদি আরব (মিশরের কমান্ডের অধীনে) ইজরায়েলকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধের পর ইজরায়েল ফিলিস্তিনের আরো অনেক এলাকা দখল করে নেয়।

এরপর থেকে আরো অনেকবার আরব দেশগুলোর সাথে ইজরায়েলের যুদ্ধ হয়, এবং প্রতিটি যুদ্ধে ইজরায়েল জিতে যায়।

এরপর অনেকগুলো দেশ, যেমন মিশর, জর্ডান, তুরস্ক, এবং সম্প্রতি আরব আমিরাত ইজরায়েলকে মেনে নেয় এবং তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

৩।

আমরা মুসলমানরা নামাজের পর মুসলিম “উম্মাহ”‘র জন্যে দোয়া করি, সারা বিশ্বের মুসলমানদের সমৃদ্ধির জন্যে দোয়া করি। কিন্তু সারা বিশ্বের মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থাটা আসলে কেমন?

সৌদি আরবের সৌদ বংশ শত বছর ধরে রাজত্ব করে চলছে। মানুষের কোন মতো প্রকাশের অধিকার নাই, নিজের মতো কথা বলা বা লেখার অধিকার নাই, নিজের ইচ্ছে মতো কাপড় চোপড় পরার অধিকার নাই। কয়েকদিন আগ পর্যন্তও মেয়েরা গাড়ি চালাতে পারতোনা। রাজা এবং রাজপুত্রদের শত শত পত্নী এবং উপ-পত্নী আছে।

ইরানের শাসন হচ্ছে কাঠ মোল্লাদের হাতে। সেখানে নৈতিক পুলিশ নামে একধরণের পুলিশ বাহিনী আছে যারা মেয়েদের কাপড় চোপড় পরা পছন্দ না হলে ধরে নিয়ে যায়, এবং কখনো কখনো অত্যাচার করে মেরে ফেলে।

আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, সোমালিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সুদান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান সহ অসংখ্য মুসলিম দেশে প্রায় নিয়মিত যুদ্ধ চলছে – হয় নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ কিংবা প্রতিবেশী মুসলিম দেশের সাথে যুদ্ধ।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক, মিশরের মতো দেশগুলোতে গণতন্ত্রের নামে চলছে হয় স্বৈরতন্ত্র, কিংবা সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ শাসন।

একটা মুসলিম দেশও একটা সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে আবির্ভুত হতে পারেনি।

৪।

কয়েক মাস আগে লিঙ্কডইনে দেখেছিলাম একটা বাংলাদেশী ছেলে লিখেছে তার ইচ্ছা যে সে ফিলিস্তিন যেয়ে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এতে যদি সে মরেও যায় তাতেও সে খুশি – একটা মহৎ কাজ করেতে যেয়ে সে জীবন দিয়েছে!

আমার ধারণা শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক মুসলিম দেশের অনেক তরুণের এই ইচ্ছা এবং স্বপ্ন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে অবিচার, নির্যাতন, আর নিধন হচ্ছে এর জন্যে এ ধরণের ইচ্ছা থাকা খুব একটা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়।

কিন্তু এই তরুণেরা ফিলিস্তিনে যেয়ে ইজরায়েলের ঠিক কী করবে? ইজরায়েলের আছে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান, সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পারমানবিক বোমা, সাবমেরিন, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা। আমাদের ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্রগ্রামের একটা ছেলে যেয়ে সেই এফ-১৬/৩৫ যুদ্ধ বিমানের বিরুদ্ধে ঠিক কী করতে পারবে?

আজকে যদি তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ হতো, তাহলে হয়তো আমরা বখতিয়ার খলজির উদাহরণ দিতে পারতাম। কিংবা ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের ঈমানি জোশে জিতে যাওয়া যুদ্ধের কথা বলতে পারতাম। কিন্তু বর্তমান যুগে ইমানি জোশে যুদ্ধে জেতার কোন সুযোগ  নাই। নেভাদার মরুভূমিতে আমেরিকার বিমান ঘাঁটিতে বসে এক বোতাম টিপে দশ হাজার মাইল দুরের কোন এক জায়গায় ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে নিমিষেই একদল মানুষকে মেরে ফেলা যায়। এই সেদিন ইজরায়েল ইরানের এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে সিরিয়ায় মেরে ফেলল বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে!

বাংলাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেপেলেরা ক্যাম্পাসে রাজনীতির নাম করে চাঁদাবাজি করে; রামদা, পাইপ গান, বা কাটা রাইফেল নিয়ে প্রতিপক্ষকে মেরে কেটে জখম করে দেয়। এরা ফিলিস্তিনের প্রতি অবিচার দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপ্লব সাধন করে ফেলতে পারে, কিন্তু বাস্তবে চাঁদাবাজির টাকার ভাগ পাওয়া কিংবা নেতার মাধ্যমে কিছু অন্যায্য সুযোগ সুবিধা পাওয়ার বাইরে এদের আসলে কোন ক্ষমতাই নাই।

এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইজরায়েলের প্রোপাগান্ডার জবাব দেয়ার মতো জ্ঞান বা পড়ালেখা বাংলাদেশ এবং অনেক মুসলিম দেশের ছেলেপেলের নাই।

ফিলিস্তিনের অনেক তরুণেরা চট্রগ্রামের ভাটিয়ারীর বাংলাদেশ মিলিটারি একডেমি থেকে কমিশন্ড অফিসার হয়ে যায়। কিন্তু তাতে যে কিছু লাভ হচ্ছে না সেটা তো তাদের বর্তমান অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়।

কিন্তু চিন্তা করে দেখুন। বাংলাদেশের হাসিনা এবং খালেদারা একে অপরের সাথে ঝগড়া করার পাশাপাশি দেশটাকে একটা চমৎকার উন্নত/ধনী গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করতো, বাংলাদেশের যদি একটা শক্তিশালী মিলিটারি থাকতো, বাংলাদেশের ডিজিএফআই/এনএসআই যদি সরকার বিরোধীদের পেঁদানিতে ওস্তাদ হওয়ার বাইরে গিয়ে একটা শক্ত চৌকস গোয়েন্দা বাহিনী হতে পারতো, তাহলে আমরা আজকে সত্যিকার অর্থে ফিলিস্তিনকে সাহায্য করতে পারতাম!

সৌদি আরবের রাজা-বাদশাহরা যদি আজকে নিজের গদি এবং শত শত পত্নী/উপপত্নী রক্ষার চেয়ে দেশকে ধনী ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করতো তাহলে তারাও আজকে আমেরিকার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনকে সাহায্য করতে পারতো।

একই অবস্থা কমবেশি সব মুসলিম রাষ্ট্রের। 

ইরানের কাঠ মোল্লারা হুঙ্কার ছাড়তে ওস্তাদ। কিন্তু সত্যিকারের যুদ্ধক্ষেত্রে তাদেরকে মোটামুটি কখনোই পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে যেমন পুলিশ-মিলিটারি সরকার বিরোধীদের পেঁদানিতে ওস্তাদ, ইরানেও সেখানকার পুলিশ- মিলিটারি সাধারণ মানুষদের ধরে ধরে পেটাতে ওস্তাদ। বাংলাদেশের মিলিটারি যেমন মিয়ানমারের মতো একটা দরিদ্র্য দেশের মিলিটারিরও একটা কেশ ছিঁড়তে পারে না (তারা আট লাখ রোহিঙ্গাদের ধুম করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পর), কিন্তু সাধারণ মানুষদের ধরে নিয়ে যেয়ে পিটিয়ে ভর্তা বানিয়ে দিতে খুবই পারদর্শী (অপারেশন ক্লিন হার্ট, র‍্যাব/ডিজিএফআই কর্তৃক উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া), ইরানের মিলিটারিও তেমনি তাদের বড় বড় অফিসারদেরকে আমেরিকা এবং ইজরায়েল ড্রোন বা যুদ্ধ বিমান দিয়ে মেরে ফেললেও আমেরিকা বা ইজরায়েলের একটা কেশও ছিঁড়তে পারে না।

তুরস্ক মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ও ধনী। কিন্তু আমেরিকা বা ইজরায়েলের বেলায় আসলে তাদের সব কিছু হম্বি তম্বির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গাজাকে ধ্বংস্তুপে পরিণত করার সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট শুধু কথার সমালোচনা করেই দায়িত্ব  শেষ করেছেন।

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র পাকিস্তানের পারমানবিক বোমা আছে। পাকিস্তানের অর্জনের মধ্যে মনে হয় এই একটা জিনিসই আছে শুধু। তাছাড়া দেশটা আসলে একটা অর্ধমৃত দেশ। পাকিস্তানের মিলিটারি আর মোল্লারা মিলে দেশটাকে একটা নরক বানিয়ে রেখেছে। তারা কিভাবে অন্য আরেকটা দেশকে সাহায্য করবে?

৫।

আমেরিকা, ইজরায়েল, বা অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর হাত থেকে বাঁচতে হলে সন্ত্রাসী হামলা করে সাধারণ মানুষদেরকে মেরে কোন লাভ হবে না। বিন লাদেন এর আল কায়েদা, ইরাকের আইসিস, বা আফগানিস্তানের তালেবানের  মতো সন্ত্রাসী এবং বর্বর সংগঠন করে নিজ দেশের মুসলমানদের এবং বিদেশের সাধারণ মানুষদেরকে বোমা মেরে বা কল্লা কেটে আমেরিকা বা ইজরায়েলের একটা কেশও ছেঁড়া যাবে না।

ইজরায়েল (এবং তাদের প্রিয়তম বন্ধু আমেরিকার) কাছ থেকে ফিলিস্তিনকে বাঁচাতে হলে মুসলিম দেশগুলোকে পড়ালেখা করতে হবে। মানুষের প্রতি, মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা সম্পন্ন একটা জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে। ভিন্ন মত ও পথের প্রতি সহনশীল হতে হবে।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেয়েমেদের পড়ালেখার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পড়ালেখার পাশাপাশি গবেষণা করার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাগারগুলোতে অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিন, স্যাটেলাইট, ড্রোন, ইত্যাদি বানানোর গবেষণা করতে হবে। এবং দেশের ভেতরেই এগুলো বানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর আমাদের মিলিটারি যখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী মিলিটারি হয়ে দাঁড়াবে তখন তারা দেশের মানুষকে বাঁচানোর শপথ নিয়ে কাজ করবে, তাদেরকে ধরে নিয়ে পেঁদানি দিতে নয়। সেই শক্তিশালী মিলিটারি তখন আমেরিকা বা ইজরায়েল বা অন্য যে কোন ঔপনিবেশিক বা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের অপকর্মের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্যে সব সময় প্রস্তুত থাকবে। মিয়ানমার এর মতো গরীব, পুঁচকে একটা দেশ আট লাখ মানুষকে আমাদের দেশের দিকে ঠেলে দেয়ার চিন্তা করার আগে নিজদের প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে পরিণতির কথা চিন্তা করে।

আমাদেরকে জেনেটিক্স এবং বায়ো টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করতে হবে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করতে হবে।

মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের লেখার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের নিজের পছন্দের কাপড় চোপড় পরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করেতে হবে। কে কী বিশ্বাস করবে, কে কোন ধর্মালয়ে যাবে, কে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাবে, সেটা একান্তই ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। আমার পছন্দ-অপছন্দ কিংবা বিশ্বাস আমি অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারবোনা।

লিঙ্কডইনে ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধে করতে যেতে চাওয়া ছেলেটি ফিলিস্তিনকে অনেক বেশি সাহায্য করতে পারতো যদি সে আজকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্যে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র বানাতে পারতো!

বাংলাদেশের ফেইসবুকে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিপ্লব করা প্রত্যেকেই অনেক বেশি ফিলিস্তিনকে সাহায্য করতে পারতো যদি এরা সবাই মিলে বাংলদেশকে পৃথিবীর অন্যতম ধনী এবং শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতো।

আর একটা ধনী এবং শক্তিশালী দেশ হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা এবং গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা, মানুষের মত ও পথের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা, এবং শত রাজনৈতিক/ধর্মীয়/সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকা সত্বেও অন্য মানুষদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকতে হবে।

অন্যের মত ও পথের প্রতি আমরা যে কী পরিমাণ অসহিষ্ণু সেটা নিয়ে আরেকদিন আরো বিশদভাবে লেখার ইচ্ছা আছে। কিন্তু এখানে শুধু এটাই বলতে চাই যে মানুষ যদি নিজের মতো করে চিন্তা করতে না পারে, নিজের মতো করে কথা বলতে না পারে, নিজের মতো করে কাজ না করতে পারে, নিজের পছন্দের কাপড় চোপড় পরে না পারে, যদি অন্য লোকের কথার ভয়ে থাকতে হয়, যদি পুলিশ-মিলিটারির ভয়ে একটা ভয়ের জীবন যাপন করে কাটিয়ে দিতে হয় পুরো জীবন, তাহলে সেই সমাজ বা দেশ কোনদিন একটা সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হতে পারবে না।

 আর নিজেরা ধ্বজভঙ্গ হয়ে থেকে অন্য দেশকে সাহায্য করার তো প্রশ্নই উঠে না।

৬।

ফিলিস্তিনের দুর্ভাগ্য। সারা দুনিয়ার মানুষে চোখের সামনে দিয়ে তাদেরকে একরকম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে। যারা তাদেরকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত এবং সমব্যথিত – মূলত সব মুসলমান প্রধান দেশগুলো – তারা প্রায় সবাই-ই এক ধরণের স্বেচ্ছা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান বিবর্জিত, মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মানহীন এক সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের সাথে নিজেরা ঝগড়া-ঝাঁটি মারামারি করে এক প্রকার অর্ধমৃত জীবন যাপন করে যাচ্ছে।

ভাগ্য

আমি এক সময় বিশ্বাস করতাম ভাগ্য বলে কিছু নাই, আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে তার প্রত্যেকটি ঘটনার জন্যেই শুধুমাত্র আমরাই দায়ী। জীবনে খুব ভালো করতে হলে আমাদেরকে জাস্ট সময় নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং এক সময় না এক সময় আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেয়ে যাবো।

সম্প্রতি ভাগ্য নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি জীবনে খুব ভালো করতে হলে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, কিন্তু মানুষের জীবনে ভাগ্যের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। আমি এখানে লটারি জেতা টাইপের ভাগ্যের কথা বলছিনা, আমি বলছি আমাদের জীবন-যাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ্য যেভাবে আমাদেরকে প্রভাবিত করে সেটার কথা। আমাদের জীবনের একটা বিরাট অংশের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই!

কারো জন্মের কথাই ধরুণ। কোন দেশে তার জন্ম হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। ২০১৫ সালের জাতিসঙ্ঘের হিসেবে সিয়েরা লিওনের শিশু মৃত্যুর হার শতকরা প্রায় দশ ভাগ। মানে জন্ম নেওয়া প্রতি একশ শিশুর মধ্যে দশটি শিশু তাদের প্রথম জন্মদিন পালন করার আগেই মারা যাবে! যেখানে উন্নত বিশ্বে প্রায় সব দেশেই এই হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তাহলে সিয়েরা লিওনের মতো দরিদ্র দেশগুলোর জন্মের সময় বা তার পরপরেই শিশুগুলোর মারা যাওয়ার এই দায় কার? বেঁচে থাকলে হয়তো ওরা বড় রাজনীতিবিদ হতে পারতো, বিজ্ঞানী হতে পারতো! কে জানে!

ভালো গ্রেইড পাওয়ার জন্যে ভালো করে লেখা পড়া করা যায়, ভালো খেলোয়াড় হতে হলে খুব ভালো কোচের অধীনে বছরের পর বছর অনুশীলন করা যায়, কিন্তু আমাদের জন্মের সময় কেমন পরিবারে জন্ম হবে আমাদের সেটা আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো? কারো বাবা-মা কেমন হবে, তারা কি নিজেদের মধ্যে কুৎসিতভাবে ঝগড়াঝাঁটি করবে নাকি চমৎকারভাবে তাদের সন্তানদেরকে মানুষ করবে? যে পরিবারে তার জন্ম হবে সেই পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছল্য না থাকলে তারা কিভাবে ছেলেমেয়েদের বড় করবে? পরিবারের সদস্যদের যদি সবচেয়ে বড় চিন্তা থাকে যে ঘরে চাল আসবে কিভাবে, কিংবা আগামী মাসের বাড়িভাড়া আসবে কোত্থেকে তাহলে সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরা ক্যালকুলাস এর অঙ্ক কিভাবে সল্ভ করবে? কিংবা কিভাবে ক্রিকেট বা ফুটবল বা দাবা খেলা প্র্যাকটিস করবে?

সন্তান যখন মায়ের পেটে থাকে তখন মা’র খাবার থেকে সন্তান পুষ্টি পায়, মা মানসিক চাপ বা রোগে থাকলে সেটা সন্তানকে প্রভাবিত করে, সন্তান বড় হলে তারও অপুষ্টি বা মানসিক সমস্যার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একটা শিশু মায়ের পেটে থাকা- কালীন সময়ে এভাবে মায়ের অসুখ বা অপুষ্টি নিজের ভেতরে নিয়ে নিলে বড় হয়ে যাওয়ার পর সেটা থেকে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।

আরেকটা গুরুত্মপূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে একজনের জন্ম কোন দেশে হচ্ছে সেই ব্যাপারটি। আমার জন্ম যদি বুরুন্ডি বা রোয়ান্ডায় হতো তাহলে এতদিনে হয়তো আমি শিশুযোদ্ধা হয়ে গৃহযুদ্ধে কয়েকশ মানুষকে মেরে ফেলতাম কিংবা নিজে আরেক শিশু-যোদ্ধার গুলিতে কিংবা রামদা’র কোপে মরে যেতাম। আবার একজনের জন্ম বাংলাদেশে হচ্ছে নাকি সুইজারল্যান্ডে হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে সে কী ধরণের সামাজিক নিয়ম-কানুনের মধ্যে বড় হবে, কী ধরণের রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বড়ো হবে, কতোটুকু দুর্নীতি-সন্ত্রাস দেখে বড় হবে। প্রত্যেক ধরণের পরিবেশের নিজস্ব প্রভাব আছে মানুষের বড় হওয়ার উপর।

দেশের উপর নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থা, নারীদের নিরাপত্তা এবং অধিকার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার, ইত্যাদি। একটা মেয়ে কি রাত দশ’টার সময় শিস দিতে দিতে বাসায় ফিরতে পারবে নাকি ফেরার পথে গুন্ডা-বদমাশ (কিংবা পুলিশ?) এর হাতে নিগৃহীত হবে সেটাও নির্ভর করে সে কোন দেশে জন্ম নিয়েছে তার উপর।

জন্ম ছাড়াও আরো অনেক ধরণের ভাগ্যের ব্যাপার আছে। অনেক মানুষ আছে যারা অল্প সময় ঘুমিয়ে সারাদিন ফুরফুরা মেজাজে কাজ করে যেতে পারে। আপনার আমার যেখানে আট-নয় ঘণ্টা ঘুমিয়েও সারাদিন গা ম্যাজ-ম্যাজ করে সেখানে এইসব মানুষেরা মাত্র পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ঘুমিয়েও অনায়াসে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। এই মানুষেরা জেনেটিক-ভাবেই কম ঘুমের জন্যে তৈরি হয়ে থাকে। বাড়তি সময়টা কাজে লাগিয়ে তারা আমাদের মতো আমজনতার চেয়ে অনেক এগিয়ে যেতে পারে!

অনেকে জন্ম নেয় একটা চমৎকার ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) নিয়ে। ঠান্ডা-সর্দি-জ্বর তাদের সহজে কাবু করতে পারেনা। আর যাদের এর উল্টোটা হয় তাদের প্রায় সারা বছরই সর্দি, কাশি, হাঁচি, ইত্যাদি লেগে থাকে; সামান্য ঠাণ্ডা লাগলে বা ধুলা লাগলে শরীর খারাপ হয়ে যায়।

মানুষের লম্বা হওয়াটাও একটা মোটামুটি ভাগ্যের (জেনেটিক্স) এর ব্যাপার। লম্বা মানুষেরা সাধারণত বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে লম্বা মানুষেরা সাধারণত খাটো মানুষদের থেকে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়। আর আত্মবিশ্বাস না থাকলে জীবনে উন্নতি করা প্রায় অসম্ভব!

রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে কতো মেয়ের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে কে জানে!

আরেকটা ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে একটা মানুষের জন্ম কোন সময়টাতে হয়েছে সেটার উপর। একটা মোটামুটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই –  আশি-নব্বই দশকের কমিপিউটার বিপ্লব, নব্বই-দুই হাজার দশকের ইন্টারনেট বিপ্লব, আর দুই হাজার দশ দশকের মোবাইল বিল্পব – এই সময়গুলোতে যারা তরুণ ছিলো এবং এই প্রযুক্তি-গুলো আয়ত্ব করেছে, তারা এখন অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। অন্যরা পরে এসে যতোই চেষ্টা করুক না কেন যারা ইতিমধ্যে এগিয়ে গিয়েছে তাদের ধরাটা এখন অনেক কঠিন হবে। প্রথম দলটি শুধুমাত্র তাদের জন্ম সময়ের কারণেই এই সুবিধাটা লাভ করেছে।

উপরে যে উদাহরণগুলোতে ভাগ্যের ব্যাপারটা মোটামুটি পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। কিন্তু ভাগ্য আরো সুক্ষ্মভাবেও কাজ করে থাকে!

ধরুণ আমাদের সাস্টের বা বুয়েটের একটা টিম এর সদস্যরা প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট এর জন্যে একেবারে কলেজ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। ভার্সিটির থার্ড/ফোর্থ ইয়ারে উঠতে উঠতে ওদের প্রায় চার-পাঁচ বছরের ভালো প্রোগ্রামিং অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। তো ধরুণ ওরা একটা অনলাইন কন্টেস্টে অংশ নিচ্ছে বুয়েট বা সাস্ট এর ল্যাব রুম থেকে। ওরা কন্টেস্টটা করছে পৃথিবীর সেরা প্রোগ্রামিং দলগুলের সাথে, যারা রাশিয়া, চায়না, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অংশ নিচ্ছে। যদি আমরা ধরেও নিই আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা অন্য দেশগুলোর বেশিরভাগের চেয়ে ভালো, আমাদের দেশের বিদ্যমান অন্য সব সমস্যার কারণে ওদের এই যোগ্যতা দিয়েও ওরা প্রত্যাশিত ফল নাও পেতে পারে। যেমন, ওরা যখন প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে অংশ নেওয়ার জন্যে বাসা থেকে রওয়ানা দিয়েছে, তখন ওদের অনেকেরই হয়তো গাড়ি থাকবে না। প্রচণ্ড কাঠফাটা রোদে ওরা হয়তো সিএনজি বা রিকশার জন্যে আধা ঘন্টা-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে এরপর রিকশা বা সিএনজি পাবে। এরপর প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে কন্টেস্ট ভেন্যুতে আসতে আসতে ওদের উপর এক ধরণের মনস্তাত্বিক চাপ (Stress) পড়ে যাবে। এখন ওদের যোগ্যতা যতোই ভালো হোক না কেন, এই অযাচিত স্ট্রেস এর কারণে ওদের ফলাফল স্বাভাবিক এর চেয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ইউরোপ আমেরিকার প্রতিযোগীরা হয়তো নিজস্ব গাড়ি বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ধরে গুন গুন গান গাইতে গাইতে তাদের ল্যাবে এসে কন্টেস্ট করছে!

এরকম পরোক্ষভাবে ভাগ্যের কাজ করার আরো উদাহরণ আছে। কিছু জিনিস সরাসরি বুঝা যায় না, কিন্তু খুবই সূক্ষ্মভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে।

ধরুণ বাংলাদেশের কোন একটা দল বিদেশে খেলতে গেছে। এই দলটি খুবই  ভালো খেলে, তাদের একাধিক বিদেশী কোচ আছে, খেলোয়াড়দের প্রত্যেকেই মাসে লাখ লাখ টাকা বেতন পায়। যেকোন খেলারই একটা বড় অংশ হচ্ছে মনস্তাত্বিক। আমাদের খেলোয়াড়রা তাদের খেলায় যথেষ্ট ভালো হলেও তাদের মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে তারা তাদের দক্ষতার কতোটুকু ঢেলে দিতে পারবে। আমাদের বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে তাদের মানসিক অবস্থা তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, কিংবা দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলী দ্বারা নেগেটিভভাবে প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি অন্য দেশের প্রতিযোগীদের চেয়ে। কোন খেলোয়াড়ের হয়তো মা’র শরীর খারাপ ছিল, হাসপাতালে নেওয়ার পর ধর্মঘটের কারণে ওর মা’র চিকিৎসা হচ্ছে না। আরেকজনের হয়তো ভাই অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীর হাতে পড়ে ছুরির আঘাত পেয়েছে। কিংবা পরিবারের কারো কিছু না হোক, দেশে হরতালকারীরা কোথাও জ্বালাও-পোড়াও করে হয়তো কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে। এ ধরণের যেকোন নেগেটিভ খবরে আমাদের খেলোয়াড়দের মানসিক প্রস্তুতি পভাবিত হতে বাধ্য। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা হয়তো আগের দিন তাদের গার্লফ্রেন্ডদের সাথে সারা বিকাল আর সন্ধ্যা ঘোরাঘুরি করে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে হোটেলে ফিরে এসেছে!

আমাদের মা-বাবা’রা সারা জীবন মেয়েদের সাথে কথা বলাটা বারণ করে এসে বিয়ের বয়স হলে বলে “কিরে তুই মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারিস না কেন?” সমাজে ছেলে-মেয়েদের মেলা-মেশার মধ্যে কঠোর কারফিউ জারি থাকার ফলে আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিপরীত লিঙের মানুষের মনস্তত্ব বোঝাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মাথা উঁচু করে পরিষ্কার গলায় কথা বলাটা খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয়না। সব সময় একটা পুতু পুতু শ্রদ্ধা-শ্রদ্ধা ভাব না থাকলে মনে করা হয় বেয়াদবি করছে। এ কারণেই বিদেশে এসে আমারা টেকনিক্যালি ভালো করলেও প্রতিষ্ঠানের উপরের লেভেল উঠতে পারি না। দশজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে পরিষ্কারভাবে কথা বলতে গেলে আমাদের গলা শুকিয়ে যায়। বাংলাদেশের রেডিও-টিভিতে কারো সাক্ষাৎকার নিলে খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথাগুলো শুনবেন। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রতি দশজনের মধ্যে নয় জন মানুষই একটা বাক্য ঠিকভাবে সুন্দর করে পরিষ্কারভাবে বলতে পারে না। উচ্চারণের কথা বাদই  দিলাম, মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যে যেসব শব্দ ব্যবহার করা দরকার সেগুলোই আমরা অন্যের সামনে বলার সময় ভুলে যাই! রাজনীতিবিদ বলেন, সরকারী কর্মকর্তা বলেন, রাস্তার পথচারী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বলেন – সবারই এই অবস্থা।

আমি আমাদের সমালোচনার জন্যে এই কথাগুলো বলছিনা। আমি বলছি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থায় জন্ম নেওয়ার এবং বড় হওয়ার কারণে আমরা অনেক কিছুতে ভয়াবহ রকমের পিছিয়ে আছি। এবং অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবন চেষ্টা করেও অনেক দোষ-ত্রুটি থেকে আর বের হওয়া যায় না।

***

উপরের আলোচনার পর মনে হতে পারে বুঝি আমাদের কোন আশা নাই। জন্মের স্থানের কারণে আমরা বুঝি সারা জীবনের জন্যে পিছিয়ে গেলাম!

না, জন্মের কারণে আমাদের সারা জীবনের জন্যে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেই সম্ভাবনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জীবনে সফলও হওয়া যায়! জীবনে ভাগ্যের প্রভাব আছে – খুব বেশিই আছে – কিন্তু জীবনে কঠোর পরিশ্রমের প্রভাবও  আছে। এবং খুব বেশি রকমই আছে।

আগামী পর্বে সেটা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা থাকলো।

বুক রিভিউ – সেপিঅ্যান্সঃ মানব (প্র)জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

Sapiens-book

 

ইতিহাসের প্রফেসর ইউভাল হারারির Sapiens: A Brief History of Humankind বইটা গত বছর বের হওয়ার কয়েক মাস আগেই আমাজন ডট কমে প্রি-অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় গত এক বছরে বইটা আর পড়া হয়ে ওঠেনি। তাই গত কয়েক সপ্তায় একেবারে পণ করে প্রতিদিন কয়েক পৃষ্ঠা করে পড়ে বইটা অবশেষে শেষ করেছি! এত পছন্দের একটা বই আর এত কষ্ট (!) করে পড়লাম তাই ভাবলাম একটা রিভিউ লিখে ফেলি!

বইটা চারশ পৃষ্ঠার চেয়ে সামান্য কয়েক পৃষ্ঠা বেশি, কিন্তু এর মধ্যে প্রফেসর হারারি মানুষের গত ৭০,০০০ বছরের ইতিহাসকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন।

আমাদের মানুষের যেই প্রজাতি যাকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় হোমো সেপিঅ্যান্স (Homo Sapiens) বলা হয় তার উদ্ভব গঠে প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে। কিন্তু আমাদের সত্যিকারের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি শুরু হয় প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে। হারারি এটার নাম দিয়েছেন “বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব” (Cognitive Revolution)। ইতিহাস নামক যে বিষয়টা আমরা পড়ি বা জানি তার শুরু এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের সময় থেকেই। এর আগের মানুষের যে আমাদের মানুষের মত বুদ্ধি ছিল এর তেমন কোন প্রমাণও পাওয়া যায়না।

এই সময় আমরা ভাষার সৃষ্টি করি। মানুষের মাঝে যোগাযোগ অনেক দৃঢ় হয় ভাষার কারণে। মানুষ দল বেঁধে চলা শুরু করে। এবং পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বারের মত মানুষ আফ্রিকার জঙ্গল থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

মজার ব্যাপার হলো এই সময় মানুষের শুধু একটা প্রজাতি ছিল না। মানুষের প্রায় পাঁচ/ছয়টা প্রজাতি ছিল তখন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল নিয়ান্ডারথাল (Neandarthal) মানুষেরা। কিভাবে নিয়ান্ডারথাল এবং অন্যান্য মানুষ প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হলো সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত নয়।

প্রায় ১১,০০০ বছর আগে শুরু হয় “কৃষি বিপ্লব”। কৃষি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত মানুষ ছিল মূলত শিকারি (Hunter-gatherer)। মানুষ নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে পশুপাখি শিকার কিংবা বিভিন্ন ধরণের পাতা-লতা-ফল-মূল খেয়ে বেঁচে থাকতো এবং এক জায়গায় বেশি দিন থাকতো না। কিন্তু কৃষি কাজ আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ চাষের জমি নির্ধারণ করে এর চারপাশে বসতি গড়া শুরু করে। প্রফেসর হারারির মতে কৃষি বিপ্লব মানুষকে আগের চেয়ে অসুখী এবং দুর্বল করে দেয়। আগে মানুষ বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিকর খাবার খেতে পারতো, শিকার করার কারণে মানুষের শরীর অনেক শক্ত ছিল। কিন্তু কৃষি কাজ করতে যেয়ে মানুষ এক ধরণের খাবার খেতে অভ্যস্ত হওয়া শুরু করে। আর কৃষি কাজের জন্যে ঝুঁকে ঝুঁকে কাজ করার ফলে মানুষের শারীরিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।

প্রায় ৫০০ বছর আগে শুরু হয় “বৈজ্ঞানিক বিপ্লব”। বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের হাত ধরে আসে “শিল্প বিপ্লব” এবং গত কয়েক দশকে শুরু হয় “তথ্য বিপ্লব” এবং “জৈব-প্রযুক্তি বিপ্লব”।

বইটির মূল বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে রাজত্ব করতে পেরেছে যেখানে ৭০,০০০ বছরের আগেও মানুষের চেয়ে বন-মানব বা শিম্পাঞ্জির শক্তি অনেক বেশি ছিল এবং বুদ্ধিও প্রায় সমান পর্যায়ে ছিল। মানুষের কী সেই গুণ যার দ্বারা মানুষ অন্য সব পশু পাখি এবং পুরো পৃথিবীকেই তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে?

এর উত্তর হারারি দিয়েছেন এভাবেঃ মানুষের রূপকথা (myth – মিথ) বা গল্প বানানো এবং সেই মিথ অন্যদের বিশ্বাস করানোর ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে মানুষের সাফল্যের মূলমন্ত্র। পুরো বই জুড়ে হারারি অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন মানুষের বানানো মিথের। যেমন – আমেরিকা একটা মিথ। বাংলাদেশ একটা মিথ। ফেইসবুক একটা মিথ। আমেরিকা, বাংলাদেশ, বা ফেইসবুক এই সব গুলোর অস্তিত্ব কিন্তু আমাদের মনে। আমেরিকা এবং বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে যেই মানুষগুলো থাকে তারা আমেরিকা এবং বাংলাদেশ নামক “দেশ” এর ধারণাকে মেনে নিয়ে এই মিথ তৈরি করেছে। কয়েক’শ বছর আগেও পৃথিবীতে কোন দেশ ছিল না। তখন ছিল সাম্রাজ্য – মিশরীয় সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য, অটোমান সাম্রাজ্য, অ্যাজটেক সাম্রাজ্য, ইনকা সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইত্যাদি। তখন মিথ ছিল সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক। এর আগের মিথ ছিল ধর্ম কেন্দ্রিক। এর আগে ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে ছোট ছোট নানা গোত্র এবং গোষ্টি। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সাম্রাজ্য, গোত্র, ধর্ম, কোম্পানি, দেশ, ইত্যাদি নানা ধারণার তৈরি করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে।

তেমনিভাবে ফেইসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট ইত্যাদি কম্পানী কিন্তু কিছু ধারণা ছাড়া আর কিছু নয়। এদের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নাই। সরকার নামে একটা মিথের মাধ্যমে আমরা কম্পানী নামের একটা মিথ এর আইনগত একটা অস্তিত্ব বজায় রাখি। সেই আইনও আরেকটা মিথ!

একটা খুব পরিচিত মিথ হচ্ছে টাকা। টাকা জিনিসটা বাস্তবে শুধু একটা কাগজ। কিন্তু আমরা সবাই টাকায় বিশ্বাস করি বলেই টাকার এত মূল্য। আগেকার দিনে সোনা ছিল টাকার মত বিনিময়ের মাধ্যম। এরও আগে ছিল রুপা।

প্রফেসর হারারির মতে আমরা মানুষেরা যে এক সাথে মিলে মিশে কাজ করতে পারি এর মূল কারণ হচ্ছে আমরা একদল অপরিচিত মানুষ মিলে একটা মিথ বানিয়ে বিশ্বাস করতে পারি এবং সেই বিশ্বাসের ছায়াতলে সবাই এক সাথে মিলে মিশে কাজ করতে পারি। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, কম্পানী ইত্যাদি হচ্ছে শক্তিশালী কিছু মিথের উদাহরণ। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী এভাবে গল্প বানিয়ে সেটাকে অন্যদের দ্বারা বিশ্বাস করাতে পারে না। একটা বানরকে কি কেউ মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবে বলে তার হাত থেকে কলা নিয়ে নিতে পারবে?

ইতিহাস শেষ করে প্রফেসর হারারি এরপর বর্তমান নিয়েও অনেকগুলো চ্যাপ্টার ব্যয় করেন। সভ্যতার চাকার সাথে সাথে মানুষ যে সুখী হতে পারেনি তার পক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়েছেন। এরপর তিনি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়েও বেশ কয়েক পৃষ্ঠা ব্যয় করেন। তাঁর ধারণা জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ এক সময় তার ক্ষমতাকে অনেক গুন বাড়িয়ে ফেলবে। এবং হাজার হাজার বছর পূর্বে মানুষ যে ঈশ্বরের ধারণা আবিষ্কার করেছিল মানুষ ধীরে ধীরে সেই ঈশ্বরের কাছাকাছি ক্ষমতা অর্জন করবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বইটার প্রতি আগ্রহী হওয়ার মূল কারণ ছিল পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্যে। প্রফেসর হারারি আমার সেই আশা পূরণ করেছেন। যেটা আমার ভালো লাগেনি সেটা হলো লেখক ইতিহাসের সাথে নিজের মতামত প্রদান করাকে পরম কর্তব্য জ্ঞ্যান মনে করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলেছেন ইতিহাসকে মূল্যায়ন করার কাজে। এই কাজটা তিনি তাঁর পাঠকদের জন্যে রেখে দিলেই ভালো করতেন।

নীল তারা

blue-stars-1280x800

ছেলেটি মেয়েটিকে ডাকতো নীল তারা বলে।

এক অদ্ভুত কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর সম্পর্কের জালে জড়িয়ে ছিল ওরা দু’জন।

প্রথম যেদিন মেয়েটি ওদের বাসায় আসে, ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকাতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো কী যেন ঘটে গেলো ওর মনে। এরপর বেশ কয়েক মাস মেয়েটি ওদের বাসায় ছিল। সেই কয়েক মাসে ওরা একজন আরেকজনের অনেক কাছে চলে আসে। মেয়েটি ছেলেটির চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু ওদের মানসিক বয়স ছিল একেবারে সমান – একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বোঝার এবং ভালো লাগার জন্যে যে বয়সে থাকতে হয় ঠিক সে বয়সটি।

মেয়েটির প্রেম ছিল আরেকজনের  সাথে। সে প্রেমে কোন খুঁত ছিল না। ছিল না আবেগের কোনো ঘাটতি। কিন্তু ছেলেটির সাথে পরিচয় হবার পর তাকেও মেয়েটির ভালো লাগতে শুরু করে। সে ভালো লাগা শুধুই ভালো লাগা, ভালোবাসা বা প্রেম নয়। কিন্তু কখনো কখনো ভালো লাগার তীব্রতা ভালোবাসার তীব্রতার চেয়ে বেশি হয়ে যায়। ছেলেটির প্রতি মেয়েটির ভালো লাগা সেরকম তীব্র কিনা এই প্রশ্নের উত্তর মেয়েটি তার জীবনে কখনো খুঁজে পায়নি। কাকে বেশি ভালো লাগে – নিজের প্রেমিককে (পরবর্তীতে স্বামী) নাকি ছেলেটিকে – এ প্রশ্ন নিজেকে অসংখ্যবার করেও মেয়েটি কখনো কোনো উপসংহারে পৌঁছতে পারেনি।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত এসে চলে যায়; পৃথিবী তার আপন কক্ষপথে আর সূর্যের চারদিকে অবিরাম ঘুরতে থাকে। সেই ঋতু চক্রের ক্লান্তিহীন চলার মাঝে ছেলেটি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ও প্রেম শুরু করে এক সুন্দরী তরুণীর সাথে। এরপর এক মায়াময় হেমন্তের রাত্রিতে ছেলেটি তার সুন্দরী প্রেমিকাকে বিয়ে করে বউ হিসেবে ঘরে তুলে আনে। মেয়েটি অবশ্য এর অনেক আগেই বিয়ে করে তার প্রেমিক পুরুষকে। গত কয়েক বছরে ওদের মধ্যে যোগাযোগ অনেক কমে গিয়েছিল। নিজেদের সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় একে অপরকে খুব বেশি মিস করার সময়ই পায়নি।

নিজেদের জীবনে নিজ জীবন সঙ্গী নিয়ে ওরা মোটামুটি সুখেই ছিল। দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনের টুকটাক টানাপোড়ন ছাড়া ওদের ব্যস্ত সংসার জীবনে খুব বেশি অভিযোগ অনুযোগ ছিল না। কিন্তু ভাগ্য বিধাতার মনে হয় অন্য পরিকল্পনা ছিল!

চাকরির কারণে দুজনেই এক সময় একই শহরে এসে পড়ে। ওদের যোগাযোগটা তখন আবার শুরু হয় নতুন করে। তবে এবার ওদের দেখা-সাক্ষাৎ সব হয় পারিবারিকভাবে। দু’জনের দুই পরিবার আস্তে আস্তে খুব ঘনিষ্ট হয়ে আসে। সেই সাথে ফিরে আসে প্রথমবার দেখা হওয়ার সময়কার ভালোলাগা।

মেয়েটি বৃষ্টি ভালোবাসতো। এক অঝোর ধারার শ্রাবনের বিকেলে ছেলেটি একদিন এসেছিল মেয়েটির বাসায়। মেয়েটির স্বামী বাসায় ছিল না। বাচ্চারা ছিল ঘুমে। মেয়েটি সোফা থেকে উঠে যেয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়, বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে সেই একই প্রশ্ন, যেটা আগেও সে অসংখ্যবার জিজ্ঞেস করেছিল ছেলেটিকে – “তুমি নিশ্চয়ই আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে পুরোপুরি পরিষ্কার?” ছেলেটি সোফা থেকে উঠে এসে পেছন থেকে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটির কানে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। এরপর ফিসফিস করে বলে – “আমি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে পুরোপুরি পরিষ্কার। আমি আমার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসি। তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আমি অসম্ভব রেস্পেক্ট করি। তোমরা দুজনেই আমার এবং আমার স্ত্রীর খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু…”। ছেলেটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে যায়। “কিন্তু কী?” – মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে ছেলেটির গলা জড়িয়ে ধরে, দু’চোখ রাখে ছেলেটির দু’চোখে, আর ছেলেটি দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েটির কোমরে। ওরা দু’জনেই মোটামুটি আঁচ করতে পারে এরপর ছেলেটি কী বলবে। ছেলেটি বলে – “আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি, তুমি ভালোবাসো তোমার স্বামীকে। কিন্তু আমরা দু’জনেই জানি আমরা একজন আরেকজনের সোল-মেট। আমি তোমাকে যেরকম জানি বুঝি, তুমি আমাকে যেরকম জানো বুঝো, পৃথিবীর আর কেউই আমাদের সেরকম জানেনা, বুঝেনা।” ছেলেটি এক সেকেন্ডের জন্যে থামে। গভীর আদরে চুমু খায় মেয়েটির কপালে। বলে – “আমাদের পৃথিবীতে জীবন একটাই। কিন্তু স্রষ্টা যদি আর কোনো জন্ম আমাদের জন্যে রেখে থাকে তাহলে সে জন্মে তুমি হবা আমার, শুধুই আমার নীল তারা”।

এভাবে চলতে থাকে ওদের ভেতরের আর বাইরের জীবন। এরপর আরো অনেক শ্রাবণ এসে চলে যায়। আকাশ কালো করে মেঘ জমে, তারপর আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটি মনে মনে ভাবে “আচ্ছা, ও কি আমাকে মিস করছে?”

কিন্তু ভাগ্য বিধাতার এর পরের পরিকল্পনাটা ছিল বড়ই নিষ্ঠুর।

এক কঠিন অসুখ এসে বাসা বাঁধে মেয়েটির শরীরে। মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরের সেরা হাসপাতালে নেওয়া হয়। ছেলেটি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সিঙ্গাপুর যায়। হোটেল থেকে সে প্রতিদিন নিয়ম করে হাসপাতালে যায়। মাঝে মাঝে ছেলেটি যখন হাসপাতালে যায় তখন কেউ না থাকলে ছেলেটি মেয়েটিকে হাতে তুলে খাইয়ে দেয়, হাতে পায়ে হালকা মাসাজ করে দেয়। দেখতে দেখতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠে। ছেলেটি মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

এরপর ওরা আবার ফিরে যায় ওদের আগের জীবনে। যদিও বিভিন্ন কারণে ওদের আগের মতো আর দেখা হয়না, শুধু মাঝে মাঝে এসএমএস বা ফোনে দু’এক মিনিট কিছুটা কথা হতো। অবশ্য সেই দুই একটি এসএমএস কিংবা দুই এক মিনিট কথাতেই ওরা ওদের সব ভাব বিনিময় করে ফেলতে পারতো। মনে হয় ওদের একজনের মনের কথা আরেকজন ঠিকই টেলিপ্যাথি কিংবা অদৃশ্য ইথারে কান পেতে পড়ে নিতে পারে।

ছেলেটি প্রায়ই ভাবতো – পৃথিবীতে কি খুঁতহীন পারফেক্ট কিছু আছে? মেয়েটির প্রতি ওর যে ভালো লাগার  অনুভূতি, সেটা তো প্রায় পারফেক্ট। প্রকৃতি কি এই পারফেকশন মেনে নিতে পারবে?

প্রকৃতি আসলেই মেয়েটির প্রতি ছেলেটির এই অদ্ভুত সুন্দর ভালো লাগার অনুভূতি বেশিদিন সহ্য করলো না। কিছুদিন পর মেয়েটির সেই কঠিন অসুখ আবার ফিরে আসে। এবার দেখা গেল সেটা আরো ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে এসেছে। মেয়েটির স্বামী ওকে আবার সিঙ্গাপুরের সেই হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানকার সেরা ডাক্তাররা ওর চিকিৎসা করতে থাকে। কিন্তু ভাগ্য বিধাতা সম্ভবত পণ করে বসেছিল এবার যে কোনভাবেই মেয়েটিকে ভালো হতে দিবে না।

কয়েক সপ্তাহ জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি যুদ্ধ করে মেয়েটি আরেক অঝোর ধারার শ্রাবণের এক বিষণ্ণ বিকেল বেলা এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেয়।

মেয়েটির মৃত্যু ছেলেটির পৃথিবীকে পুরোপুরি উল্টেপাল্টে দেয়। কিন্তু ও সেটা কাউকে বলতে পারেনা, বুঝাতে পারেনা। পৃথিবীতে কেউ জানেনা ওদের কথা। জীবনের সবচেয়ে কষ্টের একটা সময় ওর শুধু অদৃশ্য অশ্রু  ঝরিয়ে পার করে দিতে হয়েছে। ওর নীল তারা আর নাই। ওর সব প্রশ্নের উত্তর যে দিতে পারতো সেই মানুষটি আর নাই। যার মুখ দেখলে ওর জীবনটাকে অনেক সুন্দর মনে হতো সেই মানুষটা আর নাই।

সেই মৃত্যুময় শ্রাবণের এক দিনে ছেলেটি অফিসের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পুরো শহরকে ধুয়েমুছে দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেটির মনে সারা পৃথিবীর সব কষ্ট এসে আটকে আছে। ছেলেটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে। আর কোনো দিন নীল তারার সাথে ওর বৃষ্টি দেখা হবেনা ভেবে বুকটা এক অসীম শূন্যতায় ভরে ওঠে। ও জানে ওর নীল তারা আজ আর এই শহরে নাই, এই বৃষ্টি শুধু মিছে মিছিই ঝরে পড়ছে আজ। নীল তারা আর কোনো দিন হাসবেনা ওর চোখে চোখ রেখে, হাতে হাত রেখে। আর কোনো দিন বলবেনা বৃষ্টি সে কতো ভালোবাসে।

নীল তারা আর নাই।

নীল তারা চলে গেছে।

মানুষ কেন পৃথিবীর রাজা

yuval_harari_ted1

(Translation of the article Why humans run the world by Yuval Noah Harari)

৭০,০০০ বছর আগে মানুষ ছিল অতি তুচ্ছ এক প্রাণী। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্মপূর্ণ কথা হচ্ছে যে তারা খুব অগুরুত্মপূর্ণ ছিলো। এই পৃথিবীতে তাদের প্রভাব ছিল খুবই কম, জেলি ফিশ, কাঠ-ঠোকরা, বা মৌমাছির চেয়েও  কম।

বর্তমান সময়ে অবশ্য মানুষ পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের সেই অবস্থা থেকে আমরা কিভাবে আজকের এই অবস্থায় এলাম? আমাদের সাফল্যের সেই গোপন রহস্য কী – যার দ্বারা আমরা আফ্রিকার এক কোণায় অতি তুচ্ছ, অগুরুত্মপূর্ণ নরবানর থেকে পৃথিবী দাবড়িয়ে বেড়ানো প্রাণীতে পরিণত হলাম?

আমরা প্রায়ই অন্য প্রাণীদের সাথে আমাদের পার্থক্য দেখার সময় শুধু শারীরিক পার্থক্যের কথা চিন্তা করি। আমরা ভাবতে ভালোবাসি যে আমাদের শরীর অথবা আমাদের মস্তিষ্ক খুবই বিশেষ কিছু যার কারণে একজন মানুষ একটা কুকুর, একটা শুয়োর, বা একটা শিম্পাঞ্জির চেয়ে অনেক মহান। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে যে – মানুষ আর শিম্পাঞ্জি প্রায় একই রকম। একজন মানুষ আর একটা শিম্পাঞ্জিকে যদি একটা দ্বীপে একাকী ছেড়ে দেওয়া হয় এটা দেখার জন্যে যে কে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে বেশি টিকে থাকতে পারবে, তাহলে আমি নিশ্চিত যে শিম্পাঞ্জিটি অনেক ভালোভাবে বেঁচে থাকবে মানুষটির চেয়ে।

মানুষের সাথে অন্য প্রাণীদের আসল পার্থক্য হচ্ছে সমষ্টিগত পর্যায়ে।

আমরা মানুষেরা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করি কারণ আমরাই একমাত্র প্রাণী যারা অনেক বেশি সংখ্যায় এক সাথে থেকে নিজেদের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করতে পারি। পিঁপড়া এবং মৌমাছিরাও অনেকে এক সাথে কাজ করতে পারে, কিন্তু তারা সেটা করে একটা অনমনীয়, ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে থেকে। একটা মৌচাকের মৌমাছিরা যদি কোন নতুন হুমকির মুখে পড়ে, কিংবা নতুন কিছু করার সুযোগ পায়, সেই মৌমাছিরা রাতারাতি তাদের সমাজব্যবস্থা পাল্টে ফেলে সেই নতুন হুমকি কিংবা সুযোগ এর সাথে তাল মিলিয়ে উঠতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ – তারা তাদের মৌচাকের রানীকে মেরে ফেলে একটা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। চিতা বাঘ এবং শিম্পাঞ্জিরা মৌমাছিদের চেয়ে অনেক কম ধরাবাঁধা এবং বেশি নমনীয় নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে, কিন্তু তারা সেটি করতে পারে শুধু পরিচিত কিছু অন্য চিতা বাঘ এবং শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে। চিতা বাঘ এবং শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারটা শুধুমাত্র একই গোত্রের  পরিচিত অন্য প্রাণীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমি যদি একটা শিম্পাঞ্জি হই এবং আপনি যদি আমার সাহায্য চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই আমার ব্যক্তিগতভাবে চিনতে জানতে হবেঃ আপনি কেমন শিম্পাঞ্জি? আপনি কি একটা ভালো শিম্পাঞ্জি? আপনি কি একটা খারাপ, মতলববাজ শিম্পাঞ্জি? আপনাকে না চিনলে আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

শুধুমাত্র হোমো স্যাপিএন্স রাই অসংখ্য অজানা, অচেনা মানুষের সাথে কোন ধরাবাঁধা নিয়ম না মেনে এক সাথে কাজ করে যেতে পারে। একটা শিম্পাঞ্জি হয়তো একজন মানুষের চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে, এমনকি দশটা শিম্পাঞ্জি হয়তো দশটা মানুষের চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু এক হাজার জন মানুষ অনায়াসে এক হাজারটা শিম্পাঞ্জিকে কাবু করে দিতে পারবে – শুধুমাত্র এই কারণে যে এক হাজারটা শিম্পাঞ্জি নিজেদের মধ্যে ঠিক মতো সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে না। এক লাখ শিম্পাঞ্জিকে ওয়াল স্ট্রিট কিংবা ইয়াঙ্কি স্টেডিয়ামে রেখে দেখেন – সীমাহীন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। কিন্তু এক লাখ মানুষকে সেখানে রাখেন – তারা আস্ত একটা ফাইনান্স ইন্ডাস্ট্রি বানাবে আর চমৎকার একটা বেইসবল খেলা খেলবে!

একদল মানুষ এক সাথে হয়ে সহযোগিতা করা অবশ্য সবসময় ভালো কাজের জন্যে নাও হতে পারে। মানুষের দ্বারা সঙ্ঘটিত পৃথিবীর ইতিহাসের সব জঘন্য কাজও একদল মানুষের সহযোগিতারই ফসল। কারাগার, গুয়ান্তানামো বে, নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প – এগুলোও মানুষ পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে বানিয়েছিল। শিম্পাঞ্জিরা কখনো কারাগার, গুয়ান্তানামো বে, নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানায় না।

তাবৎ প্রাণীকুলের মধ্যে কেবল মানুষরাই অনেকে মিলে এক সাথে খেলে, বা ব্যবসা করে, বা খুন করে কেনো?

এর উত্তর হচ্ছে আমাদের কল্পনা শক্তি।

আমরা একসাথে অসংখ্য অজানা, অপরিচিত মানুষের সাথে কাজ করতে পারি কারণ আমরা গল্প বানাতে পারি, সেই কল্প-গল্প আমরা মানুষে মানুষে ছড়িয়ে দিতে পারি, এবং লক্ষ কোটি মানুষকে সেই গাল-গল্প সত্য কাহিনী বলে বিশ্বাস করাতে পারি। যখন সবাই একই কল্পকাহিনী বিশ্বাস করে, একই নিয়মকানুন মেনে চলে – তখন সবাই মিলে মিশে একসাথে কাজ করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

এটা শুধু মানুষেরাই করতে পারে। আপনি একটা শিম্পাঞ্জিকে কখনোই আপনাকে একটা কলা দেওয়াতে পারবেন না এই বলে যে মৃত্যুর পর শিম্পাঞ্জিটি শিম্পাঞ্জিদের বেহেশতে যাবে এবং তার ভালো কাজের পুরস্কার স্বরূপ শিম্পাঞ্জিদের বেহেশতে অসংখ্য কলা পাবে। কোন শিম্পাঞ্জিই এই ধরণের কল্প-গল্প বিশ্বাস করবে না! শুধুমাত্র মানুষই এই ধরণের কল্প-গল্প বিশ্বাস করে। এবং ঠিক সে জন্যেই আমরা মানুষেরা পৃথিবী শাসন করি। আর শিম্পাঞ্জিরা চিড়িয়াখানা কিংবা ল্যাবরেটরিতে খাঁচার মধ্যে আটকা থাকে।

একই ধর্মের মানুষের মধ্যে ঠিক এভাবেই একই ধরণের কল্প-গল্প বিশ্বাসের মাধ্যমে এক ধরণের সহযোগিতা গড়ে উঠে। অনেক মানুষ মিলে একটা গির্জা বানায়, কিংবা দল বেঁধে ক্রুসেডে (ধর্মযুদ্ধ) যায় – কারণ তারা সবাই ঈশ্বর এবং বেহেশত নিয়ে একই ধরণের গল্প বিশ্বাস করে। এটা শুধু ধর্ম নয়, বড় ধরণের সহযোগিতার সব জায়গায়ই একই ব্যাপার কাজ করে।

উদাহরণস্বরূপ – আইনের প্রতিষ্ঠানগুলোর কথাই ধরুন। বর্তমানের প্রায় সব আইনি প্রতিষ্ঠানগুলই মানবাধিকারের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু মানবাধিকার জিনিসটা একটা বায়বীয় কল্প-গল্প, ঈশ্বর আর ধর্মের ধারণার মতন। বাস্তবে মানুষের কোনো অধিকার নাই। যেমনটি নাই শিম্পাঞ্জি এবং চিতা বাঘের। একটা মানুষের শরীরকে কেটে দেখেন, সেই শরীরের ভেতরে অধিকার বলে কিছু নাই। মানবাধিকার ব্যাপারটা শুধু আমাদের কল্পনাতেই আছে, আর আছে আমরা মানবাধিকার নিয়ে যে সব কল্প-গল্প বানাই সেখানে। মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা একটা আকর্ষনীয় ব্যাপার হতে পারে – কিন্তু ব্যাপারটা শুধুমাত্র একটা কল্প-গল্প।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সত্যি। দেব-দেবী এবং মানবাধিকারের মতোই “জাতি” এবং “দেশ” এর ব্যাপারটা একটা বানানো জিনিস। একটা পাহাড়ের বাস্তব অস্তিত্ব আছে। আপনি পাহাড়কে দেখতে পারেন,স্পর্শ করতে  পারেন, এর গন্ধ নিতে পারেন। কিন্তু আমেরিকা বা ইজরায়েল এর কোন ভৌত অস্তিত্ব নাই। আপনি আমেরিকা বা ইজরায়েলকে দেখেন না, স্পর্শ করতে পারেন না, কিংবা গন্ধ নিতে পারেন না। এগুলো হচ্ছে এক ধরণের কল্প-গল্প যেটা মানুষ আবিষ্কার করেছে এবং এরপর সেই কল্প-গল্পের সাথে খুব আপন হয়ে গিয়েছে।

অর্থনৈতিক জোটগুলোর ব্যাপারটাও একই। একটা ডলারের নোট হাতে নিয়ে দেখেন। কাগজ হিসেবে এর কোন মূল্যই নাই। আপনি এটাকে খেতে পারবেন না, পরতে পারবেন না। কিন্তু বড় বড় গল্পবাজ, যেমন ফেডারাল রিজার্ভের চেয়ারম্যান অথবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, এসে আপনাকে বলবে যে এই ডলারের নোটটির বিনিময়ে আপনি পাঁচটা কলা পাবেন। যতক্ষণ লক্ষ কোটি মানুষ এই গল্পটি বিশ্বাস করবে ততক্ষণ এই ডলার নোটটির মূল্য সত্যি সত্যিই পাঁচটা কলার সমান! আমি ডলারের সেই নোটটি নিয়ে একটা ফলের দোকানে যেয়ে একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত ফল বিক্রেতাকে নোটটা দিলে সে সত্যি সত্য আমাকে পাঁচটা কলা দিয়ে দিবে। এখন একটা শিম্পাঞ্জিকে এই ডলারের নোটটি দিয়ে পাঁচটা কলা নেয়ার চেষ্টা করেন দেখি।

সত্যি কথা বলতে কি, টাকা সম্ভবত মানুষের আবিষ্কার করা সবচেয়ে সফল কল্প-গল্প। পৃথিবীর সব মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, সবাই মানবাধিকারেও বিশ্বাস করে না, এমনকি অনেক মানুষ আছে যারা আমেরিকার অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু সবাই টাকায় বিশ্বাস করে, ডলারের নোট সবার কাছেই সমান প্রিয়। এমনকি ওসামা বিন লাদেনও টাকায় বিশ্বাস করে। ওসামা বিন লাদেন আমেরিকাকে ঘৃণা করতো, আমেরিকার রাজনীতি এবং আমেরিকার সংস্কৃতি সবই সে ঘৃণা করতো – কিন্তু সে আমেরিকান ডলার খুবই পছন্দ করতো। ডলার নামক কল্প-গল্পে তার কোন আপত্তি ছিল না।

উপসংহারে আবার বলি – মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য সব প্রাণী নৈর্বক্তিক বাস্তবতায়, যেমন নদী, গাছপালা, পাহাড়, ইত্যাদিতে বাস করে। কিন্তু আমরা মানুষেরা বাস করি এক দ্বৈত পৃথিবীতে। এটা ঠিক আমাদের পৃথিবীতেও নদী, গাছপালা, পাহাড় আছে। কিন্তু সেই নৈর্বক্তিক বাস্তব জগতের উপরে আমরা দ্বিতীয় আরেকটা কল্প-গল্পের জগৎ তৈরি করেছি। যে জগতে আছে ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন, ঈশ্বর, ডলার, এবং মানবাধিকার।

সময়ের সাথে সাথে এই কল্পনার জগতের সত্তা গুলো ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে উঠতে এখন তারা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান শক্তিতে পরিণত হয়েছে। নৈর্বক্তিক বাস্তবতার জিনিসগুলো – গাছপালা, নদী, পাহাড়, প্রাণী জগত – তাদের বেঁচে থাকাটা এখন নির্ভর করে অবাস্তব সত্তা, যেমন আমেরিকা, বিশ্বব্যাংক, ইত্যাদির উপর। অথচ আমেরিকা আর বিশ্বব্যাংক কেবলমাত্র আমাদের কল্পনাতেই আছে, বাস্তবে এদের কোন অস্তিত্বই নাই।

কাছের মানুষগুলো

আমেরিকান লেখক এবং মোটিভেশনাল বক্তা জিম রন (http://en.wikipedia.org/wiki/Jim_Rohn) একটা চমৎকার কথা বলেছিলেনঃ “যে পাঁচ জন মানুষের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটান আপনি সেই পাঁচজন মানুষের গড় (You are the average of the five people you spend the most time with.)”। এর মানে হচ্ছে আপনার বুদ্ধি হচ্ছে আপনার সবচেয়ে কাছের পাঁচ জন মানুষের গড় বুদ্ধির সমান। কথাটার মানে অবশ্য শুধু বুদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় – মানুষের চিন্তা-ভাবনার অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই কথাটা খাটে (যেমন রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি ব্যাপারে আমরা কাছাকাছি ভাবনার মানুষের সাথেই বেশি মিশে – আওয়ামীলীগ-মনা মানুষ আওয়ামীলীগারদের সাথে মিশে বেশি, বিএনপি-মনারা বিএনপি সমর্থকদের সাথে মিশে বেশি, রাজাকার এর ছানারা অন্য রাজাকার ছানাদের সাথে বেশি মিশে, হেফাজতপন্থীরা অন্য তালেবানী কাঠমোল্লাদের সাথে মিশে, ইত্যাদি ইত্যাদি)।

কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার দরকার নেই, তবে এটা বাস্তবতার প্রায় কাছাকাছি একটা সত্যি কথা! আমরা যাদের সাথে আমাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটাই – আমাদের পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, অফিসের সহকর্মী – তাদের দ্বারা আমরা সব সময়ই প্রভাবিত হতে থাকি। যার সাথে যতো বেশি সময় কাটাবো তার দ্বারা ততো বেশি প্রভাবিত হবো। প্রভাব অবশ্য উভয় দিকেই যায় – আপনি প্রভাবিত হওয়ার পাশাপাশি আপনিও অন্যজনকে প্রভাবিত করবেন। তবে যার ব্যক্তিত্ব বেশি দৃঢ় তিনি বেশি প্রভাবিত করতে পারেন অন্যদেরকে।

এই কারণে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিখ্যাত প্রযুক্তি কম্পানী, সিলিকন ভ্যালী ইত্যাদি জায়গায় বুদ্ধিমান, সৃজনশীল মানুষের আনাগোনা বেশি। একবার কোনো কারণে স্মার্ট, ট্যালেন্টেড মানুষের সমাগম শুরু হলে সেখানে তাদের কারণে আরো বেশি স্মার্ট এবং ট্যালেন্টেড মানুষের আসা শুরু হয়। এইভাবে একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সিলিকন ভ্যালী’র মতো জায়গা গড়ে উঠে।

গুগল, ফেইসবুকের মতো বড় বড় টেক কম্পানীগুলোর নতুন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার নেওয়ার সময় একটা লক্ষ্য থাকে নতুন ইঞ্জিনিয়ারের মেধা এবং দক্ষতা যাতে কম্পানীর গড় মেধা এবং দক্ষতার চেয়ে বেশি হয়। এভাবে এক এক জন নতুন ইঞ্জিনিয়ার নেওয়ার মাধ্যমে কম্পানীর ওভারঅল মেধা এবং দক্ষতা বাড়তে থাকে।

আমরা মানুষেরা সাধারণত প্রশংসার কাঙ্গাল (ফেইসবুকের লাইক বাটন উঠে গেলে আমাদের স্ট্যাটাসের সংখ্যা দশ ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে বলে আমার ধারণা!)। এটা দোষের কিছু নয় – প্রশংসা আমাদেরকে ভালো কিছু করতে উৎসাহিত করে। কিন্তু প্রশংসার পাশাপাশি আমাদেরকে সমালোচনা গ্রহণ করার জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু আমরা প্রশংসার জন্যে যতোটা উদগ্রীব সমালোচনা শোনারা জন্যে আমরা প্রায়ই ততোটা প্রস্তুত থাকিনা। কিন্তু আমাদের বুদ্ধি, মেধা, এবং সৃজনশীলতার উন্নতি ঘটাতে হলে প্রশংসার চেয়ে সমালোচনা (গঠনমূলক সমালোচনা – নির্বিচার গালাগালি নয়!) বেশি জরুরী। আমরা যখন আমাদেরকে কম চিন্তাশীল, গাধা টাইপের মানুষ দিয়ে ঘিরে রাখি তখন আমরা প্রচুর প্রশংসা শুনতে পাই। কিন্তু আমরা যতোই মেধাবী, স্মার্ট, এবং সৃজনশীল মানুষ দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখবো ততোই আমাদের চিন্তার এবং কাজের সমালোচনা বাড়তে থাকবে। এবং এই সমালোচনার মাধ্যমেই আমাদের চিন্তা এবং কাজের মান আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। আর মানুষ হিসেবেও আমরা চমৎকার মানুষ হয়ে উঠতে থাকবো।

কেউ এক গাদা প্রশংসা করলেই সে আমার খুব ভালো বন্ধু, আর কেউ আমার কোনো একটা ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিলে সে আমার বন্ধু নয় – এই ধরণের সস্তা টাইপের চিন্তা করলে কোনো দিন নিজের ব্যক্তিগত উন্নতি সাধন করা যাবে না।

কাছের প্রিয় মানুষগুলোর ভালো হওয়া জরুরী, স্মার্ট এবং সৃজনশীল হলে আরো ভালো। কিন্তু আপনি যদি শুধু নিজের গুনগান শোনার জন্যে তোষামোদ টাইপের মানুষ দিয়ে আপনার চারপাশ ভরে রাখেন (আমাদের অনেক নেতা/নেত্রীর মতো!) তাহলে আপনি যে মানুষ হিসেবে খুব ভালো, চমৎকার, দক্ষ একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত!

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেনো আমাদের বারবার হতাশ করে কিংবা আমরা কেনো বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলতে পারিনা

work-harder

প্রতি বার বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন প্রচন্ড আশা জাগিয়ে আমাদের হতাশ করে – আমাদের বুকটা ভেঙ্গে যায় কষ্টে, আমরা অবাক হয়ে ভাবি কেনো সাকিব-তামিম-মুশফিকের মতো মেধাবী ক্রিকেটাররা আমাদের বারবার হতাশ করে!

এটা একবার নয়, বার বার ঘটছে।  এবং খুব একটা ভুল হওয়ার আশঙ্কা না করেও বলা যায় এটা অদূর ভবিষ্যতেও ঘটতে থাকবে।

বিশ্বকাপ ফুটবল বাংলাদেশে আসে রীতিমতো ঝড় হয়ে। সারাদেশে কেউ যেন এড্রেনালিন হরমোন ঢেলে দেয় এই সময়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ কখনো এই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। আগামী কয়েক দশকে পারবে তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আহা, বাংলাদেশ যদি মেসি-নেইমার-রোনাল্ডোদের সাথে বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলতে পারতো!

কিন্তু কেনো আমাদের ক্রিকেট এবং ফুটবলের এই দুরাবস্থা?

প্রিয় পাঠক, আপনি এ লেখাটি হয়তো পড়ছেন ঢাকায় বসে, কিংবা অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকা-ইউরোপে বসে, কিংবা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো জেলায় বসে। আপনি হয়তো একজন ছাত্র, কিংবা হয়তো একজন গৃহিনী, কিংবা একজন চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক। হয়তোবা আপনি একজন কর্মহীন বেকার। আপনি হয়তো একজন সংস্কৃতিকর্মী – গায়ক, গায়িকা, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মডেল, চিত্রশীল্পি। হয়তো আপনি একজন সাংবাদিক, লেখক, বা ফটোগ্রাফার।

আমাদের অবস্থান যেখানেই হোক না কেনো, আমাদের পেশা যেটাই হোক না কেনো, দেশের ক্রিকেট এবং ফুটবল দল এর কাছে আমাদের সবারই চাওয়া একটা – বিশ্বের সেরা দলগুলোর সম-মানের পারফরম্যান্স! আমরা চাই আমাদের ক্রিকেট দল বীর বিক্রমে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো দলগুলোকে গুঁড়িয়ে দিক (আহা – সত্যিই যদি সেটি ওরা করতে পারতো!), আমাদের ফুটবল দল নিয়মিত বিশ্বকাপে যেয়ে বিশ্বসেরা দলগুলোকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করুক।

কিন্তু আমরা সবাই জানি সেটি কখনো ঘটেনা। আমাদের ক্রিকেট দল আমাদের নিয়মিত মন খারাপ করে দেয়, নিজ দেশের ফুটবলারদের পরিবর্তে আমরা মেসি-নেইমার-রোনাল্ডোদের নিয়ে মেতে উঠি। আমাদের ঘরে ঘরে উড়ে ব্রাজিল-আর্জেনটিনার পতাকা।

আমাদের ক্রিকেট বা ফুটবল দলের এই ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণ(গুলো) কী?

এই প্রশ্নের উত্তর আরেকটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি।

প্রিয় পাঠক, আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাগুলোর কারণ(গুলো) কী?

আপনার পেশা যাই হোক না কেনো আপনি সেটাতে কতোটুকু সফল, কতোটুকু তৃপ্ত? আপনার কাজ কতোটুকু বিশ্বমানের? আপনার পেশায় আপনি কি অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা-ভারতের একজনের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারবেন?

তামিম-সাকিব-মুশফিকরা আমার আপনার মতোই বাংলাদেশের আলো-বাতাস-পানি খেয়ে বড় হয়েছে, হচ্ছে। যে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবেশ বাংলাদেশে বিরাজমান সেটাই তাদের কাজ করার ভিত্তি। আপনি খেলোয়াড়দের যতোই কোটি টাকা বেতন/স্পন্সরশিপ দেননা কেনো, যতো বড় বিদেশী কোচ দিয়ে প্রশিক্ষণ দেননা কেনো – দিনের শেষে তারা বাংলাদেশেই থাকে। তাদের বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিতজন সবাই বাংলাদেশী। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ এর মধ্য দিয়েই তাদের দিন কাটাতে হয়। এই পরিবেশ-পরিস্থিতি এর মধ্য দিয়ে আপনি অনেক চেষ্টা করে যতোটুকু সফল হতে পেরেছেন, আমাদের ক্রিকেটার ফুটবলাররাও ততোটুকুই হয়েছেন এবং হচ্ছেন।

আমরা উঠতে বসতে রাজনীতিবিদিদের গালি দিই – এটা সত্য তারা এর বেশিরভাগই ডিজার্ভ করে – কিন্তু রাজনীতিবিদরা কিন্তু আমাদের থেকেই উঠে আসা মানুষ। রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে আমাদের নিজেদের দিকে আগে তাকানো উচিৎ। আমরা কি আমাদের নিজেদের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করছি?

আমরা বাংলাদেশীরা দিনের একটা বড় সময় ব্যয় করি অন্যের সমালোচনা করতে। রাজনীতিবিদরা খারাপ, আওয়ামীলীগ খারাপ, বিএনপি খারাপ। সিভিল সোসাইটি ধান্দাবাজ, প্রথম আলো খারাপ, ডক্টর ইউনুস খারাপ। পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তারা ঘুখখোর। ব্যবসায়ীরা মুনাফাখোর। এই লিস্টের শেষ নেই! (সমালোচনা নিয়ে কিছুদিন আগে একটা লিখেছিলামঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/bilashbdblog/29344027)

শেষ কবে কারো প্রশংসা করেছেন মনে আছে?

আমার মনে হয় আমাদের প্রশংসা করা শিখতে হবে আরো বেশি। প্রশংসা করার মানুষ খুব বেশি না খুঁজে পেলে একটা কাজ করুণঃ নিজে এমন একটা কিছু করূন যাতে মানুষ আপনার প্রশংসা করবে! মুশফিক-সাকিব-তামিমরা হতাশ করছে? নিজে একজন বিশ্বমানের ছাত্র, ছাত্রী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিল্পী, ব্যবসায়ী হয়ে যান। তখন সবাই প্রশংসা করার মতো, গর্ব করার মতো একজন নতুন মানুষ পাবে।

কে না চায় তার দেশের দল বিশ্বসেরা পারফরম্যান্স করুক। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা আমাদের ক্রিকেট দল থেকে অনেক বেশি প্রত্যাশা করে ফেলছি। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে – বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট, কিংবা অলিম্পিকে – সাফল্য পেতে হলে আমাদের দেশের ওভারঅল পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আমাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে “প্রাণ” এর সঞ্চার করতে হবে। আমার মনে হয় আমাদের সবার জীবনে বড্ড বেশি “প্রাণ” এর অভাবঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/bilashbdblog/28989710

“প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষ কৌতুহলী হয়, আগ্রহী হয়, সবসময় কিছু একটা করতে চায়, যেকোনো জিনিসের ভালো দিকটা দেখে প্রথমে, নিজের ভুল/দোষ হলে সেটা স্বীকার নেয় সহজে, অন্যের সফলতা দেখে হিংসা করেনা, সবকিছুর পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়ায়না, অন্যরা কী করছে সেটা না ভেবে নিজেই এগিয়ে আসে যেকোনো কাজে, ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বসে থাকেনা, এবং আশেপাশের সবার মধ্যে নিজের প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করে। একজন সফল মানুষ আরেকজন সফল মানুষকে হিংসা করবেনা। যে ছেলেগুলো হরতাল-বিক্ষোভ এর সময় নির্বিচারে অন্যের গাড়ি ভাংগে, সেই ছেলেগুলোর প্রত্যেকের একটা করে গাড়ি থাকলে ওরা কখনো এই কাজটি করতো না। অসফল মানুষ স্বভাবতই কিছুটা হীনমন্যতাবোধে ভোগে, এবং সুযোগ পেলেই তার দুঃখ-কষ্টের কারণ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়।”

ভালো ফুটবলার এবং ক্রিকেটার এর আগে আমাদের দরকার ষোল কোটি ভালো মানুষ, লক্ষ লক্ষ ভালো ছাত্র-ছাত্রী, হাজার হাজার ভালো শিক্ষক, দক্ষ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, পরিচালক। আমাদের সমালোচনা করার এবং সমালোচনাকারী মানুষের অভাব নাই – কিন্তু আমাদের দরকার বেশি বেশি প্রশংসা করার এবং প্রশংসাকারী মানুষ। ব্লগ-ফেইসবুকে দুনিয়ার সবার সমালোচনা করে করে নিজের ওয়াল  এবং মানুষের নিউজ ফিড ভরিয়ে ফেলে নেগেটিভিটি ছাড়ানোর পাশাপাশি অন্যের প্রশংসা ছড়ান, নিজে ভালো কিছু করে অন্যকে আপনার প্রশংসা করার সুযোগ করে দিন।

যে দেশের সাধারণ মানুষ ভালো, ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকগণ মেধাবী, সাধারণ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-সাংবাদিক-পুলিশ-সরকারী কর্মকর্তারা দক্ষ, শিল্পী-পরিচালকরা উঁচু মানের, সেই দেশের ক্রিকেটাররা যখন তখন ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিতে পারে, আর সেই দেশের ফুটবল টিম প্রতি বিশ্বকাপে খেলতে পারবে – এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

elevator-success-stairs

অপরাজিত – ২

Boat_in_river,_Bangladesh

Image source: http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/6/66/Boat_in_river%2C_Bangladesh.jpg

(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর “অপরাজিত” উপন্যাস থেকে নেওয়া)

ইছামতী এই চঞ্চল জীবনধারার প্রতীক। ওর দু’পাড় ভরিয়া প্রতি চৈত্র বৈশাখে কত বনকুসুম, গাছপালা, পাখি-পাখালি, গাঁয়ে গাঁয়ে গ্রামের ঘাট – শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া কত ফুল ঝরিয়া পড়ে, কত পাখির দল আসে যায়, ধারে ধারে কত জেলেরা জাল ফেলে, তীরবর্তী গৃহস্তবাড়িতে হাসি-কান্নার লীলাখেলা হয়, কত গৃহস্ত আসে, কত গৃহস্ত যায় – কত হাসিমুখ শিশু মায়ের সঙ্গে নাহিতে নামে, আবার বৃদ্ধাবস্থায় তাহাদের নশ্বর দেহের রেণু কলস্বনা ইছামতীর স্রোতোজলে ভাসিয়া যায় – এমন কত মা, কত ছেলেমেয়ে, তরুণতরুণী মহাকালের বীথিপথে আসে যায় – অথচ নদী দেখায় শান্ত, স্নিগ্ধ, ঘরোয়া, নিরীহ…

আজকাল নির্জনে বসিলেই তাহার মনে হয়, এই পৃথিবীর একটা আধ্যাত্মিক রুপ আছে, এর ফুলফল, আলোছায়ার মধ্যে জন্মগ্রহণ করার দরুণ এবং শৈশব হইতে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার দরুণ এর প্রকৃত রুপটি আমাদের চোখে পড়ে না। এ আমাদের দর্শন ও শ্রবণগ্রাহ্য জিনিসে গড়া হইলেও আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও ঘোর রহস্যময়, এর প্রতি রেণু যে  অসীম জটিলতায় আচ্ছন্ন – যা কিনা মানুষের বুদ্ধি ও কল্পনার অতীত, এ সত্যটা হঠাৎ চোখে পড়ে না। যেমন সাহেব বন্ধুটি বলিত, “ভারতবর্ষের একটা রুপ আছে, সে তোমরা জান না। তোমরা এখানে জন্মেছ কিনা, অতি পরিচয়ের দোষে সে চোখ ফোটে নি তোমাদের।”

আকাশের রঙ আর এক রকম – দূরের সে গহন হিরাকসের সমুদ্র ঈষৎ কৃষ্ণাভ হইয়া উঠিয়াছে – তার তলায় সারা সবুজ মাঠটা, মাধবপুরের বাঁশবনটা কি অপূর্ব, অদ্ভুত, অপার্থিব ধরনের ছবি ফুটাইয়া তুলিয়াছে!… ও যেন পরিচিত পৃথিবীটা নয়, অন্য কোনো অজানা জগতের কোনো অজ্ঞাত দেবলোকের…

প্রকৃতির একটা যেন নিজস্ব ভাষা আছে। অপু দেখিয়াছে, কতদিন বক্রতোয়ার উপল-ছাওয়া-তটে শাল ঝাড়ের নিচে ঠিক দুপুরে বসিয়া – দূরে নীল আকাশের পটভূমিতে একটা পত্রশূন্য প্রকান্ড কি গাছ – সেদিকে চাহিলেই এমন সব কথা মনে আসিত যা অন্য সময় আসার কল্পনাও করিতে পারিত না – পাহাড়ের নিচে বনফলের জঙ্গলেরও একটা কি বলিবার ছিল যেন। এই ভাষাটা ছবির ভাষা – প্রকৃতি এই ছবির ভাষায় কথা বলেন – এখানেও সে দেখিল গাছপালায়, উইঢিপির পাশে শুকনো খড়ের ঝোপে, দূরের বাঁশবনের সারিতে – সেই সব কথাই বলে – সেই সব ভাবই মনে আনে। প্রকৃতির এই ছবির ভাষাটা সে বোঝে। তাই নির্জন মাঠে, প্রান্তরে, বনের ধারে একা বেড়াইয়া সে যত প্রেরণা পায় – যে পুলক অনুভব করে তা অপূর্ব – সত্যিকার Joy of Life – পায়ের তলার শুকনো লতা-কাটি, দেয়াড়ের চরে রাঙ্গা-রোদ-মাখানো কষাড় ঝোপ, আকন্দের বন, ঘেঁটুবন – তার আত্মাকে এরা ধ্যানের খোরাক যোগায়, এ যেন অদৃশ্য স্বাতী নক্ষত্রের বারি, তারই প্রাণ মুক্তার দানা বাঁধে।

সন্ধার পুরবী কি গৌরীরাগিণীর মতো বিষাদ-ভরা আনন্দ, নির্লিপ্ত ও নির্বিকার – বহুদূরের ওই নীল কৃষ্ণাভ মেঘরাশি, ঘন নীল, নিথর, গহন আকাশটা মনে যে ছবি আঁকে, যে চিন্তা যোগায়, তার গতি গোমুখী-গঙ্গার মতো অনন্তের দিকে, সে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কথা বলে, মৃত্যুপারের দেশের কথা কয়, ভালবাসা-বেদনা-ভালবাসিয়া হারানো – বহুদূরের এক প্রীতিভরা পুনর্জন্মের বাণী…

এইসব শান্ত সন্ধ্যায় ইছামতীর তীরের মাঠে বসিলেই রক্তমেঘস্তুপ ও নীলাকাশের দিকে চাহিয়া চারিপাশের সেই অনন্ত বিশ্বের কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে বাল্যে এই কাঁটাভরা সাঁইবাবলার ছায়ায় বসিয়া মাছ ধরিতে ধরিতে সে দূর দেশের স্বপ্ন দেখিত – আজকাল চেতনা তাহার বাল্যের সে ক্ষুদ্র গন্ডি পার হইয়া ক্রমেই দূরে আলোকের পাখায় চলিয়াছে – এই ভাবিয়া এক এক সময় সে আনন্দ পায় – কোথাও না যাক – যে বিশ্বের সে একজন নাগরিক, তা ক্ষুদ্র, দীন বিশ্ব নয়। লক্ষ কোটি আলোক-বর্ষ যার গণনার মাপকাঠি, দিকে দিকে অন্ধকারে ডুবিয়া ডুবিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকাদের দেশ, অদৃশ্য ইথারের বিশ্ব যেখানে মানুষের চিন্তাতীত, কল্পনাতীত দূরত্বের ক্রমবর্ধমান পরিধিপানে বিস্তৃত – সেই বিশ্বে সে জন্মিয়াছে…

milky-way

ঐ অসীম শূন্য কত জীবলোকে ভরা – কি তাদের অদ্ভুত ইতিহাস! অজানা নদীতটে প্রণয়ীদের কত অশ্রুভরা আনন্দতীর্থ – সারা শূন্য ভরিয়া আনন্দস্পন্দনের মেলা – ইথারের নীল সমুদ্র বাহিয়া বহু দূরের বৃহত্তর বিশ্বের সে-সব জীবনধারার ঢেউ প্রাতে, দুপুরে, রাতে, নির্জনে একা বসিলেই তাহার মনের বেলায় আসিয়া লাগে – অসীম আনন্দ ও গভীর অনুভূতিতে মন ভরিয়া ওঠে – পরে সে বুঝিতে পারে শুধু প্রসারতার দিকে নয় – যদিও তা বিপুল ও অপরিমেয় – কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চেতনা-স্তরের আর একটা Dimension যেন তার মন খুঁজিয়া পায় – এই নিস্তব্দ শরত-দুপুর যখন অতীতকালের এমনি এক মধুর মুগ্ধ শৈশব-দুপুরের ছায়াপাতে স্নিগ্ধ ও করূণ হইয়া ওঠে তখনই সে বুঝিতে পারে চেতনার এ স্তর বাহিয়া সে বহুদূর যাইতে পারে – হয়তো কোনো অজ্ঞাত সৌন্দর্যময় রাজ্যে, দৈনন্দিন ঘটনার গতানুগতিক অনুভূতিরাজি ও একঘেয়ে মনোভাব যে রাজ্যের সন্ধান দিতে পারিতই না কোনোদিন…

নদীর ধারে আজিকার এই আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর নব রুপ সে দেখিতে পাইল। মনে হইল, যুগে যুগে এ জন্মমৃত্যুচক্র কোন বিশাল-আত্মা দেবশিল্পীর হাতে আবর্তিত হইতেছে – তিনি জানেন কোন জীবনের পর কোন অবস্থার জীবনে আসিতে হয়, কখনো বা বৈষম্য – সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি – বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট-

ছ’হাজার বছর আগে হয়তো সে জন্মিয়াছিল প্রাচীন ঈজিপ্টে – সেখানে নলখাগড়া প্যাপিরাসের বনে, নীলনদের রৌদ্রদীপ্ত তটে কোন দরিদ্র ঘরের মা বোন বাপ ভাই বন্ধুবান্ধবদের দলে কবে সে এক মধুর শৈশব কাটাইয়া গিয়াছে – আবার হয়তো জন্ম নিয়াছিল রাইন নদীর ধারে – কর্ক-ওক, বার্চ ও বীচবনের শ্যামল ছায়ায় বনেদি ঘরের প্রাচীন প্রাসাদে, মধ্যযুগের আড়ম্বরপূর্ণ আবহাওয়ায়, সুন্দরমুখ সখীদের দল। হাজার হাজার বছর পর হয়তো সে আবার ফিরিয়া আসিবে – তখন কি মনে পড়িবে এবারকার জীবনটা? – কিংবা কে জানে আর হয়তো এ পৃথিবীতে আসিবে না – ওই যে বটগাছের সারির মাথায় সন্ধ্যার ক্ষীণ প্রথম তারকাটি – ওদের জগতে অজানা জীবনধারার মধ্যে হয়তো এবার নবজন্ম! – কতবার যেন সে আসিয়াছে… জন্ম হইতে জন্মান্তরে, মৃত্যু হইতে মৃত্যুর মধ্য দিয়া… বহু দূর অতীতে ও ভবিষ্যতে বিস্তৃত সে পথটা যেন সে বেশ দেখিতে পাইল… কত নিশ্চিন্দিপুর, কত অপর্ণা, কত দুর্গা দিদি – জীবনের ও জন্মমৃত্যুর বীথিপথ বাহিয়া ক্লান্ত ও আনন্দিত আত্মার সে কি অপরুপ অভিযান… শুধু আনন্দে, যৌবনে, পুণ্যে ও দুঃখে, শোকে ও শান্তিতে…। এই সবটা লইয়া যে আসল বৃহত্তর জীবন – পৃথিবীর জীবনটুকু যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র – তার স্বপ্ন যে শুধুই কল্পনাবিলাস, এ যে হয় তা কে জানে – বৃহত্তর জীবনচক্র কোন দেবতার হাতে আবর্তিত হয় তা কে জানে?… হয়তো এমন সব প্রাণী আছেন যাঁরা মানুষের মতো ছবিতে, উপন্যাসে, কবিতায় নিজেদের শিল্পসৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন না – তাঁরা এক এক বিশ্ব সৃষ্টি করেন – তার মানুষের সুঝে-দুঃখে উখথানে-পতনে আত্মপ্রকাশ করাই তাঁদের পদ্ধতি – কোন মহান বিবর্তনের জীব তাঁর অচিন্ত্যনীয় কলাকুশলতাকে গ্রহে গ্রহে নক্ষত্রে নক্ষত্রে এ-রকম রুপ দিয়াছেন – কে তাঁকে জানে?…

একটি অবর্ণনীয় আনন্দে, আশায়, অনুভূতিতে, রহস্যে মন ভরিয়া উঠিল। প্রাণবন্ত তার আশা, সে অমর ও অনন্ত জীবনের বাণী বনলতার রৌদ্রদগ্ধ শাখাপাত্রের তিক্ত গন্ধ আনে – নীলশূন্যে বালিহাঁসের সাঁই সাঁই রব শোনায়। সে জীবনের অধিকার হইতে তাহাকে কাহারো বঞ্চনা করিবার শক্তি নাই – তার মনে হইল সে দীন নয়, দুঃখী নয়, তুচ্ছ নয় – ওটুকু শেষ নয়, এখানে আরম্ভও নয়। সে জন্মজন্মান্তরের পথিক আত্মা, দূর হইতে কোন সুদূরের নিত্য নূতন পথহীন পথে তার গতি, এই বিপুল নীল আকাশ, অগণ্য জ্যোতির্লোক, সপ্তর্ষিমন্ডল, ছায়াপথ, বিশাল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার জগৎ, বহির্ষদ পিতৃলোক, – এই শত সহস্র শতাব্দী, তার পায়ে-চলার পথ – তার ও সকলের মৃত্যুদ্বারা অস্পৃষ্ট সে বিরাট জীবনটা নিউটনের মহাসমুদ্রের মতো করলেই পুরোভাগে অক্ষুন্নভাবে বর্তমান – নিঃসীম সময় বাহিয়া সে গতি সারা মানব যুগে বাধাহীন হউক।…

অপু তাহাদের ঘাটের ধারে আসিল। ওইখানটিতে এমন এক সন্ধ্যার অন্ধকারে বনদেবী বিশালাক্ষী স্বরুপ চক্রবর্তীকে দেখা দিয়াছিলেন কতকাল আগে!

আজ যদি আবার তাহাকে দেখা দেন!

– তুমি কে?
– আমি অপু।
– তুমি বড় ভালো ছেলে। তুমি কি বর চাও?
– অন্য কিছু চাই নে, এ গাঁয়ের বনঝোপ, নদী, মাঠ, বাঁশবনের ছায়ায় অবোধ, উদ্গ্রীব,  স্বপ্নময় আমার সেই যে দশ বৎসর বয়সের শৈশবটি – তাকে আর একটি বার ফিরিয়ে দেবে দেবী? –

“You enter it by the Ancient way
Through Ivory Gate and Golden”

অপরাজিত…

Le-Meridien-Bora-Bora---Aerial
প্রথম জীবনের সে-সব মাধুরীভরা মুহূর্তগুলি যৌবনের কলকোলাহলে কোথায় মিলাইয়া গেল? কোথায় সে নীল আকাশ, মাঠ, আমের বউলের গন্ধভরা জ্যোৎস্নারাত্রি? পাখি আর ডাকে না, ফুল আর ফোটে না, আকাশ আর সবুজ মাঠের সঙ্গে মেশে না – ঘেঁটুফুলের ঝোপে ফোটা সদ্যফোটা ফুলের তেতো গন্ধ আর বাতাসকে তেতো করে না। জীবনে সে যে রোমান্সের স্বপ্ন দেখিয়াছিল – যে স্বপ্ন তাহাকে একদিন শত দুঃখের মধ্য দিয়া টানিয়া আনিয়াছে, তার সন্ধান তো কই এখনো মিলিল না? এ তো একরঙ্গা ছবির মতো বৈচিত্রহীন, কর্মব্যস্ত, একঘেয়ে জীবন – সারাদিন এখানে অফিসের বদ্ধ জীবন, রোকড়, খতিয়ান, মর্টগেজ, ইনকামট্যাক্সের কাগজের বোঝার মধ্যে পক্ককেশ প্রবীন ঝুনো সংসারাভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের সঙ্গে সপিনা ধরানোর প্রকৃষ্ট উপায় সম্বন্ধে পরামর্শ করা, এটর্নিদের নামে বড় বড় চিঠি মুসাবিদা করা – সন্ধ্যায় পায়রার খোপের মতো অপরিষ্কার নোংরা বাসাবাড়িতে ফিরিয়াই তখনি আবার ছেলে পড়াইতে ছোটা।

অফিসে সে নানা স্থানের ভ্রমণকাহিনী পড়ে, ডেস্কের মধ্যে পুরিয়া রাখে। পুরোনো বইয়ের দোকান হইতে নানা দেশের ছবিওয়ালা বর্ণনাপূর্ণ বই কেনে – নানা দেশের রেলওয়ে বা স্টিমার কোম্পানি যে সব দেশে যাইতে সাধারণকে প্রলুব্ধ করিতেছে – কেহ বলিতেছে, হাওয়াই দ্বীপে এসো একবার – এখানকার নারকেল কুন্জে, ওয়াকিকির বালুময় সমুদ্রবেলায় জোৎস্নারাত্রে যদি তারাভিমুখী ঊর্মিমালার সঙ্গীত না শুনিয়া মর, তবে তোমার জীবন বৃথা।

এল পাশো দেখ নাই। দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার চুনাপাথরের পাহাড়ের ঢালুতে, শান্ত রাত্রির তারাভরা আকাশের তলে কম্বল বিছাইয়া একবারটি ঘুমাইয়া দেখিও।।। শীতের শেষে নুড়িভরা উঁচুনিচু প্রান্তরে কর্কশ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে দু-এক ধরণের মাত্র বসন্তের ফুল প্রথম ফুটিতে শুরু করে, তখন সেখানকার সোডা-আলকালির পলিমাটিপড়া রৌদ্রদীপ্ত মুক্ত তরুবলয়ের রহস্যময় রুপ – কিংবা ওয়ালোয়া হ্রদের তীরে উন্নত পাইন ও ডগলাস ফারের ঘন অরণ্য, হ্রদের স্বচ্ছ বরফগলা জলে তুষারকিরীট মাজামা আগ্নেয়গিরির প্রতিচ্ছায়ার কম্পন – উত্তর আমেরিকার ঘন, স্তব্দ্ধ, নির্জন অরণ্যভূমির নিয়ত পরিবর্তনশীল দৃশ্যরাজি, কর্কশ বন্ধুর পর্বতমালা, গম্ভীরনিনাদী জলপ্রপাত, ফেনিল পাহাড়ি নদীতীরে বিচরণশীল বলগা হরিণের দল, ভালুক, পাহাড়ি ছাগল, ভেড়ার দল, উষ্ন প্রস্রবণ, তুষারপ্রবাহ, পাহাড়ের ঢালুর গায়ের সিডার ও মেপল গাছের বনের মধ্যে বুনো ভ্যালোরিয়ান ও ভায়োলেট ফুলের বিচিত্র বর্ণসমাবেশ – দেখ নাই এসব? এস এস!

টাহিটি! টাহিটি! কোথায় কত দূরে, কোন জোৎস্নালোকিত রহস্যময় কূলহীন স্বপ্নসমুদ্রের পারে, শুভরাত্রে গভীর জলের তলায় যেখানে মুক্তার জন্ম হয়, সাগরগুহায় প্রবালের দল ফুটিয়া থাকে, কানে শুধু দূরশ্রুত সংগীতের মতো তাহাদের অপূর্ব আহবান ভাসিয়া আসে। অফিসের ডেস্কে বসিয়া এক-একদিন সে স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকে – এই সবের স্বপ্নে। এই রকম নির্জন স্থানে, যেখানে লোকালয় নাই, ঘন নারিকেল কুন্জের মধ্যে ছোট কুটিরে, খোলা জানালা দিয়া দূরের নীল সমুদ্র চোখে পড়িবে – তার ওপারে মরকতশ্যাম ছোট ছোট দ্বীপ, বিচিত্র পক্ষীরাজি, অজানা দেশের অজানা আকাশের তলে তারায় আলোয় উজ্জ্বল মাঠটা একটা রহস্যের বার্তা বহিয়া আনিবে – কুটিরের ধারে ফুটিয়া থাকিবে ছোট ছোট বনফুল – শুধু সে আর অপর্ণা।

(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর “অপরাজিত” উপন্যাস থেকে নেওয়া)

Tagged , ,

ভালোবাসা

What-is-love

সবচেয়ে গভীর ভালোবাসা একমুখী হয়, দ্বিমুখী নয়।

ভালোবাসা দেওয়ার জিনিস, নেওয়ার জিনিস নয়। আপনি যদি ভালোবাসা দেওয়ার চেয়ে ভালোবাসা পাওয়াতে বেশি সুখ পান, তাহলে আপনি এখনো ভালোবাসার গভীরে যেতে পারেননি। গভীর ভালোবেসে যে সুখ পাওয়া যায় তার সাথে প্রায় অন্য কোনো সুখের তুলনা চলেনা!

ভালোবাসার সাথে প্রত্যাশার (expectation) কোনো সম্পর্ক নাই। সত্যিকারের ভালোবাসা শুধু ভালোবাসার মানুষটিকে সুখী করতে চায়, তার থেকে কোনো প্রতিদান আশা করে না। প্রত্যাশার চাপ আস্তে আস্তে ভালোবাসাকে মেরে ফেলে। আপনার ভালোবাসার মানুষটি আপনার প্রত্যাশা পূরণের মেশিন নয়।

সত্যিকারের ভালোবাসা মানুষকে মুক্ত করে, বেঁধে ফেলে না। ভালোবাসা আফিমের মতো, লোহার শিকল নয়। আপনার ভালোবাসার মানুষ খুব সম্ভবত আপনার কাছে ফিরে আসবে যদি আপনি তাকে মুক্ত করে দেন। লোহার শিকল দিয়ে ভালোবাসার মানুষকে আটকে রাখার চেষ্টা করলে পাখি খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। শেকল পরানোর চেয়ে পাখিকে ভালোবাসার আফিম খাওয়ান বরং।

প্রেম হচ্ছে আকর্ষণ (শারীরিক এবং মানসিক) + ভালোবাসা + প্রত্যাশা। প্রেমের প্রথম দিকে এই তিনটির সবগুলোই মোটামুটি সমান পরিমাণে থাকে। ভঙ্গুর প্রেমে প্রত্যাশার পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, আকর্ষণ এবং ভালোবাসা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। শ্বাশ্বত প্রেমে প্রত্যাশা প্রায় থাকেইনা, কিন্তু থাকে তীব্র ভালোবাসা; যদিও আকর্ষণ ধরে রাখাটা যেকোনো প্রেমেই কঠিন একটা কাজ। যেকোনো কিছুতে সময়ের সাথে সাথে আকর্ষণ কমে যাওয়াটা খুব সম্ভবত মানুষের ডিএনএতে লেখা আছে। এ ব্যাপারে আমাদের খুব বেশি কিছু করার নাই।

বিয়ে হচ্ছে প্রেম + দায়িত্ব। স্বামী হিসেবে দায়িত্ব, স্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব, জামাই হিসেবে দায়িত্ব, ঘরের বউ হিসেবে দায়িত্ব। সর্বোপরি পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব। যে সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের কাছ থেকে প্রত্যাশা সর্বনিম্ন সে সম্পর্ক সাধারণত বেশিদিন টিকে। ভঙ্গুর বৈবাহিক সম্পর্কে মানুষের আকর্ষণ এবং ভালোবাসা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, আর প্রত্যাশা আর দায়িত্ব আকশের কাছাকাছি চলে যায়। শ্বাশ্বত বৈবাহিক সম্পর্ক শ্বাশ্বত প্রেমের মতোই মূলত ভালোবাসা নির্ভর – প্রত্যাশা করার আগেই ভালোবাসা থেকে একে অপরকে সুখী করে ফেলে।

নিজে অসুখী হয়ে অন্যকে ভালোবেসে সুখী করা যায়না। কেউ আপনার জীবনে সুখ এনে দেবে ভেবে কারো সাথে প্রেমে জড়াবেন না। বরং আপনি কারো জীবনে সুখ এনে দেবেন ভেবে প্রেম করুন।

যেকোনো মানুষকে, যেকেনো বস্তুকে, এমনকি যেকোনো পশুকেও ভালোবাসা যায়। ভালোবাসলে যদি সুখ না পাওয়া যায় তাহলে সে ভালোবাসা গভীর ভালোবাসা না। দেশের কথা ভেবে যদি বুকের ভেতর সুখ-আবেগের মোচড় না উঠে তাহলে দেশকে আপনার আরো ভালোবাসতে হবে।

ভালোবাসা, প্রেম, আর অবসেশন – তিনটা ভিন্ন জিনিস। অবসেশন হচ্ছে কাউকে বা কোনো কিছুকে পাওয়ার জন্যে অযৌক্তিক রকম মরিয়া হয়ে উঠা। অবসেশনকে গভীর প্রেম বলে ভুল হতে পারে। অবসেশন মূলত ভালোবাসার মানুষের মাধ্যমে নিজেকে সুখী করার একটা চেষ্টা।

ভালোবাসার সাথে যৌনতার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নাই। সেক্সের জন্যে ভালোবাসার চেয়ে আকর্ষণের বেশি দরকার। তবে আকর্ষণের সাথে ভালোবাসা যোগ হলে সেটা হয় সর্বোৎকৃষ্ট সেক্স। আকর্ষন ছাড়া শুধু ভালোবাসা দিয়ে যৌন জীবনে খুব বেশি সুখী হওয়া যায়না।

পুনশ্চঃ উপরের কথাগুলো নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। এই ভাবনাগুলোর কোনোটি বা সবগুলো অন্য কারো ভাবনার সাথে পুরোপুরি মিলে যাবে এটা আমি আশা করি না। আর সময়ের সাথে সাথে আমার নিজের ভাবনারও পরিবর্তন হতে পারে!