দেশের বাইরে দেশ


মানুষ হিসেবে আমি ভয়াবহ রকমের কৌতুহলী। সেই ছোটবেলা থেকেই চারপাশের পৃথিবী নিয়ে আমার হাজারো প্রশ্ন। খুব ছোটবেলায়, যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম, তখন একটা প্রশ্ন প্রায়ই আমার মাথায় ঘুরতো – এই পৃথিবীর শেষ সীমানা কোথায়? কাউকে তখন প্রশ্নটা করা হয়নি সম্ভবত, তাই আমি নিজে নিজে এর একটা উত্তর বের করে নিয়েছিলাম। আমি ভেবে ভেবে বের করেছিলাম পৃথিবীর শেষ দেশটির নাম আমেরিকা এবং সেই দেশটির সীমানা যেখানে শেষ সেখানে থেকে এরপর শুধু পানি, অথৈ সমুদ্র যতোদূর চোখ যায়! আশির দশকের কথা, আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ তখন তুঙ্গে, নোয়াখালির প্রত্যন্ত অঞ্চল আমাদের গ্রামে বসেও আমি আমেরিকা আর রাশিয়ার নাম জানতাম! এবং কী করে যেনো আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিলো আমেরিকা হচ্ছে পৃথিবীর শেষ সীমানায় অবস্থিত একটি দেশ, এরপর খালি দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি…

সেই পৃথিবীর শেষ সীমানার দেশ(!) আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো সবসময়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় এর পড়ালেখা শেষ করে আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়এ উচ্চশিক্ষার জন্যে ভর্তির আবেদন করি। ভাগ্যক্রমে কয়েকটি থেকে অফারও পেয়ে যাই। এবং অবশেষে ২০০৬ সালে ওহাইও অঙ্গরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে চলে আসি।

আমেরিকা বিশাল দেশ। এর পূর্ব দিকে আটলান্টিক আর পশ্চিম দিকে প্রশান্ত মহাসাগর। এ দুই মহাসাগর এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার মাইল কিংবা সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত আমেরিকা। উত্তর দক্ষিনেও প্রায় দেড় হাজার মাইল লম্বা এই দেশ। পূর্ব দিকে নিউ ইয়র্ক শহরে যখন সকাল নয়টা বাজে পশ্চিমের সিয়াটল শহর তখনো ঘুমিয়ে আছে ভোর ছয়টায়। আমি যে জায়গাটায় এসেছি তার নাম ওহাইও, শহরের নাম কলাম্বাস। ওহাইও স্টেইট ইউনিভার্সিটি আমেরিকার বৃহত্তম ইউনিভার্সিটি, পঞ্চাশ হাজার এর বেশি ছাত্রছাত্রী এখানে লেখাপড়া করে।

আমার প্রফেসর আমাকে নির্ধারিত সময়ের এক সেমিস্টার আগে গ্রীষ্মকালীন সেমেস্টারে নিয়ে এসে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের একটা ন্যাশনাল ল্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জীবনে প্রথমবারের মতো আমেরিকায় পড়তে এসেছি, ঠিকমতো ইংরেজী বলতে পারিনা, এর মধ্যে প্রায় মরুভূমির মতো (পুরো ওয়াশিংটন এর ওই অংশটুকুই বৈচিত্র্যহীন মরুভূমির মতো) জায়গায় ওই ল্যাবটরিতে যেয়ে পড়লাম মহা ফাঁপরে। উঠলাম ওই ল্যাবের গেস্ট হাউজে। অফিস এর সময় চারদিকে অনেক মানুষ থাকে, কিন্তু বিকেল হয়ে গেলে একটা কাকপক্ষীও চোখে পড়েনা। নতুন বিদেশে এসেছি, গাড়ি কেনার প্রশ্নই ওঠেনা অথচ গাড়ি ছাড়া এককদম চলারও উপায় নাই। এখানে আসার আগে ইন্টারনেট ঘেঁটে এখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমার ল্যাবের পাশেই অবস্থিত ওয়াশিংটন স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে একজন বাংলাদেশী অধ্যাপক এর নাম পেয়েছিলাম। ওনাকে ইমেইল করে এসেছিলাম আমি আসার আগে। তাই একদিন বিকেল বেলায় যখন উনি গাড়ি নিয়ে আমার গেস্ট হাউজের সামনে এসে হাজির হলেন তখন আমার মনে হলো স্রষ্টা আকাশ থেকে ফেরেশতা পাঠিয়েছেন! কয়েকদিন ভাত খেতে না পেরে আমার অবস্থা হালুয়া টাইট। উনি আমাকে ওনার বাসায় নিয়ে যেয়ে ঘরে রান্না করা তরকারী দিয়ে পেট ভরে খাইয়ে দিলেন। গরম গরুর মাংশের ঝোল দেখে আমার চোখ চকচক করে উঠেছিলো! এরপর উনি আমাকে প্রায়ই গাড়ি করে ওনার বাসায় নিয়ে যেতেন, মজার মজার খাবার খাওয়াতেন। গ্রোসারী স্টোরএ নিয়ে যেতেন। সেখানকার ছোটখাট বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। প্রায় মাস তিনেক ওই ল্যাবে কাটিয়ে ফিরে আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের ক্লাস করার জন্যে!

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সেমিস্টারে একদিন অ্যালগরিদম ক্লাস থেকে বের হয়ে লিফটএ উঠেছি। আমার সাথে কয়েকটি ভারতীয় ছেলেমেয়েও ঢুকলো লিফটে। আমাকে অবাক করে দিয়ে দেখি ওরা বাংলায় কথা বলা শুরু করলো নিজেদের মধ্যে! আমি সাথে সাথেই ওদের জিজ্ঞেস করলাম – “তোমরা বাংগালী?” “হ্যাঁ, আমরা কোলকাতার” – ওদের উত্তর। এরপর আমি আমার পরিচয় দিলাম, বললাম আমি বাংলাদেশের ছেলে। সেই থেকে ওদের সাথে আমার বন্ধুত্ব। ঘটনাক্রমে ওরা আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টএ থাকতো, তাই ওদের সাথেই হতো আমার যাবতীয় ওঠাবসা।

আরেকদিন হাই পারফরমেন্স কম্পিউটিং ক্লাস থেকে বের হয়েছি, একটা ছেলে এসে জিজ্ঞেস করলো ওই ক্লাসের একটা টপিক আমার কাছে আছি কিনা। আমি জবাব দেওয়ার পর ও জিজ্ঞেস করলো “হয়ার আর ইউ ফ্রম?” আমি বললাম, “আই এম ফ্রম বাংলাদেশ”। আমাকে প্রচন্ড অবাক করে দিয়ে ও তখন বললো সেও বাংলাদেশের ছেলে! যদিও ও বড় হয়েছে আমেরিকায়, ওরা বাবা-মা বাংলাদেশের। কাকতাল আর কাকে বলে!

কলাম্বাস শহরে প্রায় হাজারখানেক বাংলাদেশীর বসবাস। আমেরিকার খুব কম শহরেই এতো ফ্রেন্ডলি এবং আন্তরিক মানুষ দেখেছি আমি। আমেরিকায় নতুন হিসেবে আমার যেসব সমস্যা হতে পারতো সেটি অনেক কম হয়েছে কলাম্বাস শহরের কিছু চমৎকার মানুষের ভালোবাসা, আন্তরিক সাহায্যের কারণে।

আমেরিকায় সামারের (গ্রীষ্মকাল) সময়ে সাধারণত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ থাকে। ছাত্রছাত্রীরা তখন বিভিন্ন কম্পানীতে ইন্টার্নশীপ করার চেষ্টা করে থাকে। ভাগ্যক্রমে আমি মাইক্রোসফটএ একটা ইন্টার্ণশীপ পেয়ে যাই। মাইক্রোসফট এর প্রধান অফিস ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটলে অবস্থিত। তাই আমার দ্বিতীয় সামারও কাটে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে। ওয়াশিংটন অপূর্ব সুন্দর একটা জায়গা। আমি ইন্টার্ণশীপ করার জন্যে সিয়াটল যাচ্ছি এটা শুনে জাফর ইকবাল স্যার লিখেছিলেন – “ওয়াশিংটন আমেরিকার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা, ভালো করে ঘুরে ফিরে দেখো জায়গাটা। একটা ভালো ম্যাপ বই কিনে পাহাড়-পর্বত, বনভূমি সব ঘুরে দেখো”। জাফর ইকবাল স্যার আঠারো বছর আমেরিকায় ছিলেন, অতএব স্যারের কথা যে ভুল হবেনা সেটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। ওয়াশিংটন এর সৌন্দর্য্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম! ঘরের কাছেই বরফে ঢাকা পর্বতমালা, চমৎকার সব পার্ক, মনমুগ্ধকর লেক, চারদিকে খালি সবুজ আর সবুজ!

ওয়াশিংটনে পা রাখার দু’একদিনের মধ্যেই ছুটলাম উইনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন এর উদ্দেশ্যে। জাফর ইকবাল স্যার এখান থেকেই পিএইচডি করেছেন কিনা! ক্যাম্পাসে হাঁটছি আর ভাবছিলাম এই ক্যাম্পাস দিয়ে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে জাফর স্যার হেঁটেছিলেন! খুঁজে খুঁজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগটি বের করে সেখানে যেয়ে হাজির হলাম। জাফর স্যার এর সময়কার প্রফেসরদের বের করার চেষ্টা করলাম। একজনের অফিস রুমও খুঁজে পেলাম! ফটাফত কয়েকটি ছবিও তুলে নেওয়া হলো!

আমেরিকার মন্টানা আর ওয়াইওমিং অঙ্গরাজ্যের মাঝে অবস্থিত ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। ওয়াশিংটন এর সিয়াটল শহর থেকে এটি প্রায় নয়’শ মাইল বা পনের’শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইন্টার্ণশীপের সময় আমি আর আমার স্ত্রী মিলে ইয়েলোস্টোন পার্ক দেখতে গেলাম। আশি থেকে নব্বই মাইল বেগে ড্রাইভ করার পরেও মন্টানার বোজম্যান শহরে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় ১২ ঘন্টা লেগে গেলো। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ একটানা ড্রাইভ করার রেকর্ড। পথে যদিও মাঝে মাঝে থেমেছিলাম। বোজম্যানে আমাদের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন পিএইচডি স্টুডেন্ট ছিলেন। বোজম্যান পৌঁছার পরদিন সকালবেলা আমাদের পাঁচজনের দল নিয়ে বের হয়ে পড়লাম ইয়েলোস্টোন পার্ক এর উদ্দেশ্যে। বোজম্যান থেকে এটি প্রায় এক/দেড় ঘন্টার রাস্তা। বোজম্যান থেকে ইয়েলোস্টোন যাওয়ার রাস্তাটা খুবই সুন্দর। আমরা পথে একটা সুন্দর লেক এর পাড়ে থেমে ছবি তুললাম বেশ কিছু। এরপর পার্কে ঢুকে আমি রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একটা জায়গা কি করে এতো সুন্দর হতে পারে আমার মাথা ঢুকে না। বিখ্যাত ওল্ড ফেইথফুল গেইসার বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো প্রতি আশি-নব্বই মিনিট পরপর প্রায় দেড়শ ফুট উপরে ছুঁড়ে মারছে ভূগর্ভস্ত পানি। এর সামনে গেলেই দেখা যাবে পরবর্তী কখন এটি ফুঁসে উঠবে সেটা লেখা আছে। একটা জায়গায় যেয়ে দেখলাম পানির বিচিত্র সব রঙ। নিজের চোখে না দেখলে সেটি বিশ্বাস করা কষ্টকর, পানি আর মাটির যে এতো বিচিত্র রঙ হতে পারে সেটা এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

ইয়েলোস্টোন পার্কে আছে অপরুপ সুন্দর ইয়েলোস্টোন লেক। আমার জীবনে আমি এতো স্বচ্ছ পানির জলাধার দেখিনি কখনো। লেক এর পেছনে দিগন্ত বিস্তৃত বরফে মোড়া পর্বতমালা। সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য! লেক এর পাড়ে যেয়ে আমার শুধু মনে হচ্ছিলো “আহা, এখানে বসে যদি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম”!

ভাগ্যের পরিক্রমায় পড়ালেখা শেষ করার পর আমার জীবনের প্রথম চাকুরীটি পাই ওয়াশিংটন এর একটি কম্পানীতে। সুযোগ পাই জাফর স্যার এর কথামতো জায়গাটা ভালো করে ঘুরে ফিরে দেখার! ওয়াশিংটন এর বিভিন্ন জায়গা নিয়ে লিখতে গেলে অনেকগুলো লেখা লিখতে হবে। সেটা আগামী পর্বগুলোর জন্যে তোলা থাকলো।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: