Tag Archives: হেমন্ত

হেমন্ত – দেশে ও বিদেশে

fallleaves00831

এখানে এখন হেমন্ত কাল চলছে। অবশ্য চলছে বলা ঠিক হবে না, চলে যাচ্ছে। আমেরিকাতে হেমন্ত বেশিদিন থাকে না। কিন্তু যে কয়দিন থাকে সে সময়টাতে পুরো প্রকৃতি অপার্থিবভাবে রঙ্গিন হয়ে উঠে। সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য।

blue-sky51

যখনি এখানে হেমন্ত আসে তখনি আমার মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের হেমন্তের কথা। বাংলাদেশেও হেমন্ত খুব একটা বেশি সময় ধরে থাকে না। নভেম্বর মাসটাই মূলত হেমন্ত। হেমন্তের আকাশ থাকে অবিশ্বাস্য রকমের নীল। পুরো আকাশ জুড়ে শুধু নীলের খেলা। সারা আকাশে এক ফোটা মেঘের দেখা নেই। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ ধীরে ধীরে কোমল হয়ে আসে। শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত আসতে আসতে সেই রোদ হয়ে উঠে অতি মনোরম। ফসলের মাঠ হয়ে উঠে সবুজ আর হলুদ।

দেশে থাকতে হেমন্ত আমাকে কেমন অন্যরকম করে তুলতো। বাতাসে, রোদ্দুরে কেমন যেন মিষ্টি একটা ভাব। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিশ্বাস নিলেই প্রকৃতির সতেজতাকে নিজের ভেতরে নিয়ে যাওয়া যায়। আকাশটা মনে হতো বিশাল বক্ষ হয়ে পৃথিবীর অনেক কাছে চলে এসেছে। চৈত্রের আকাশে চিলেরা ডানা মেলে যেভাবে ঘুরে ঘুরে উড়ে, হেমন্তের আকাশে আমার ঠিক তেমনি উড়তে ইচ্ছে করতো। আমার মুক্ত আকাশে স্কাই ডাইভিং করার ইচ্ছেটা মনে হয় এই হেমন্তের আকাশ দেখেই হয়েছে!

ঢাকাতে তো আকাশ দেখার মতো খোলা জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। সৌভাগ্যক্রমে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে ঢাকার বাইরে, সিলেটে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শহরের বাইরে, একেবারে গ্রাম এলাকায়। চারদিকে ছিল ছোট-বড় টিলা। আর অনেক দূরে, দিগন্তের কাছাকাছি ছিল ভারতের উঁচু উঁচু পাহাড়। ওগুলো ছিল হিমালয় থেকে বের হওয়া শাখাপ্রশাখা। ছোট-বড় পাহাড়ের পেছনে আদিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ যে কতো সুন্দর সেটা যারা দেখেনি তাদের বলে বোঝানো যাবে না। কাছের সবুজ পাহাড় কিংবা দূরের কালচে নীল পাহাড় আঁকাবাঁকা হয়ে মিশে গেছে দিগন্তে, সে এক অপূর্ব দৃশ্য!

হেমন্তের সারা দিন ধরে চলে মিষ্টি, মায়াবী আলোর খেলা। আকাশে আলো, বাতাসে আলো, আলো আমার চোখে, আলো আমার মুখে, আলো আমার প্রাণে… আমি গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি – “আলো আমার আলো, ওগো আলো ভুবন ভরা, আলো নয়ন ধোয়া আমার আলো হৃদয় হরা; নাচে আলো নাচে ও ভাই আমার প্রাণের কাছে, বাজে আলো বাজে ও ভাই হৃদয় বীণার মাঝে…”। এ আলো গ্রীষ্মের খররৌদ্রতপ্ত আলো নয়, এ আলো এক অতি মনোরম মনপ্রাণ জাগানিয়া আলো। আর সন্ধ্যার গোধূলীর আলো তো এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পুরো পশ্চিম আকাশ জুড়ে চলে লাল এর খেলা। এ লাল রঙ কোন পৃথিবীর রঙ নয়, সে এক অপার্থিব ধরণের আলোর নাচ চলে হেমন্তের সন্ধ্যা গুলোতে। সিলেটের সন্ধ্যার আকাশ
আমার চেয়ে কেউ বেশি সময় নিয়ে দেখেছে বলে মনে হয় না!

বাংলাদেশের হেমন্ত যেমন গাঢ় নীল আকাশ আর মনোরম আলো দিয়ে চেনা যায়, আমেরিকার হেমন্ত তেমনি চেনা যায় গাছের পাতা রঙ্গিন হয়ে উঠা এবং কিছুদিন পর তার ঝরে যাওয়া দেখে। এখানে হেমন্তকে বলা হয় “Fall”, যার অর্থ পতন বা পড়া। এখানে প্রায় সব গাছের পাতা ঝরে পড়ে হেমন্তে। কিন্তু পাতা ঝরে পড়ার আগে সেগুলো বিচিত্র সব রঙ ধারণ করে। সেই রঙ এর বর্ণনা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এতো সুন্দর সেই রঙের বাহার, এতো বিচিত্র রকমের সেই রঙগুলো, সেই রঙ দেখলে সাথে সাথে মনেও তা ধরে যায়। লাল, হলুদ, আর সবুজের যতো রকমফের সম্ভব আমেরিকার হেমন্তে সেই সব রঙ দেখা যায় গাছের পাতাতে।

প্রকৃতি মনে হয় ভয়াবহ সৌন্দর্য্য বেশিক্ষণ রাখতে চায় না আমাদের সামনে। তাই হেমন্তও বেশিদিন থাকে না কোথাও। বাংলাদেশে নীল আকাশের বুকে স্বপ্নের উড়াউড়ি শুরু না হতেই আস্তে আস্তে শীত চলে আশে কুয়াশার চাদরে, নরম রোদের সূর্যটাকে আরো নরম করে দিয়ে। আমেরিকায় গাছের পাতাগুলির রঙ্গে মন রাঙ্গানোর সাথে সাথেই শুরু হয় পাতা ঝরা। রাস্তাঘাট সব ভরে যায় মরা, নিস্তেজ রঙ্গিন পাতায়। আর কনকনে শীতের বাতাস ঝাপ্টা দিয়ে জানিয়ে দেয় সে আসছে…

হেমন্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবনের উপভোগের বস্তুগুলোর স্বল্পস্থায়ীত্বের কথা। এ জীবনে কিছুই থাকে না চিরকাল ধরে। না সুখ, না স্বপ্ন, না সৌন্দর্য্য। কিন্তু সুখ-স্বপ্ন-সৌন্দর্য্য উপভোগ করার ইচ্ছা ও মানসিকতা থাকলে ওগুলো ঘুরে ফিরে আসতেই থাকবে, আমাদের শুধু চোখ মেলে দেখতে হবে চারপাশে।

Tagged , , , , ,