সেদিন বিকেলে আমার ছেলে ইলনকে নিয়ে বাসার পাশের এস্টোরিয়া পার্কে খেলছিলাম। ইস্ট নদীর পাড়ে চমৎকার ছোট একটা পার্ক। নদীর ওপারে ম্যানহাটানের উঁচু উঁচু বিল্ডিং গুলোর ফাঁকে গ্রীষ্মের অলস বিকেলের সূর্যের লাল আলোকছটার ঝলকানি এক মায়াময় অপার্থিব রূপের সৃষ্টি করেছে। পার্কের লম্বা লম্বা গাছগুলোর কচকচে সবুজ পাতার ফাঁক গলে আসা শেষ বিকেলের মিষ্টি নরম আলোতে প্লে-গ্রাউন্ডে ছুটোছুটি করা ছেলে-মেয়েগুলোকে স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবশিশুর দল মনে হচ্ছিল।
ছেলেটি আমার দেখতে দেখতে প্রায় চার বছর হয়ে গেল। এই সেদিন ও জন্মালো, মায়ের পেট থেকে বের করে নার্স ওকে একটা প্লাস্টিকের বিনে রাখলো। ও নবজাতকের তারস্বরে দেওয়া কান্না শুরু করলো। আমি ভয়ে ভয়ে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কি ওকে একটু ধরতে পারি?” নার্স হালকা হেসে বললো, “অবশ্যই!” আমি ওর তুলতুলে নরম শরীর স্পর্শ করলাম।
সেই ছেলে এখন – ওর জন্মের চার বছর পর – এস্টোরিয়া পার্কে সাইকেল চালিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে!
আর ঠিক তখনি আমার মনে হলোঃ এই পার্ক, এই বিকেল, এই শিশুদের কলকলানি, ইস্ট নদীর উপর দিয়ে বয়ে আসা মিষ্টি নরম হাওয়া, ম্যানহাটানের এম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিং এর ওপারে অস্তায়মান সূর্য – এ সবই জীবন।
ইলন একদিন বড় হবে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, কতো রকম দেশের কতো রকম মানুষের সাথে মিশবে, বন্ধুত্ব পাতাবে, সম্পর্কে জড়াবে, কোন একটা পেশা বেছে নিবে জীবিকার জন্যে, কিন্তু সেই অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কিন্তু ওর জীবন নয়। ওর জীবন হচ্ছে এখন, এই মুহুর্ত! এই যে ও সাইকেল চালাচ্ছে, স্কুটার চালাচ্ছে, ছুটাছুটি করছে, এটাই ওর জীবন।
একইভাবে আমার জন্যেও কথাটা সত্যি। কে জানে আগামীকাল কী হবে, আগামী বছর কী হবে? গতকাল কিংবা গত বছর যা ঘটেছে সেটারও এখন আর স্মৃতি ছাড়া কোথাও অস্তিত্ব নাই। তাহলে এই যে আমি বেঁচে আছি, এই যে একটা জীবন যাপন করছি, সেটা তো এই বর্তমান ছাড়া আর কিছুই না, তাই না?
আমার কাজের জন্যে আমাকে এখনো ছাত্র অবস্থার চেয়ে বেশি পড়ালেখা করতে হয়। কম্পিউটার আর ইন্টারনেট এর জগতে কিছুদিন পরপর নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে, সারা পৃথিবীর মেধাবী ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় আর টেক ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে সেই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও চেষ্টা করি যাতে নতুন আসা কিছু প্রযুক্তির সাথে পরিচিত থাকতে। ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম, মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, গালভরা সব নাম! ইন্টারনেট আর নানা বইপত্র ঘেঁটে এসব প্রযুক্তি শেখার চেষ্টা করি। স্বপ্ন দেখি একদিন খুব ভালো একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবো…
কিন্তু এই চেষ্টা আর স্বপ্ন দেখার মাঝেই হারিয়ে যায় জীবন! যখন আমাদের ফোকাস হয় শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ, তখন আমরা আর বর্তমানে জীবন যাপন করি না, আমরা একটা ঘোরের মাঝে হারিয়ে যাই! এবং বেশির ভাগ সময়সময়ই এর ফল খুব একটা ভালো হয়না। ভবিষ্যতের আশায় আশায় জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানে জীবন কোন ফাঁকে চলে গেল সেটা টের না পাওয়া!
সে জন্যেই বলা হয় – জীবন একটা ভ্রমণ, গন্তব্য নয়!
জীবন হচ্ছে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া, সারাদিন খেটে কাজ করা, কাজ শেষে বাসায় ফিরে আসা। জীবন মানে শুধু মাস শেষে বেতন পাওয়া নয়।
এই যে আমরা ফেইসবুকে লাইক দিই, কমেন্ট করি, বাদানুবাদ করি, নিজের সুখের প্রচার করি, এটাই জীবন। প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধবের সাথে কাটিয়ে দেয়া মুহুর্তগুলিই জীবন।
আলবার্ট কামু “দি মিথ অফ সিসিফাস” রচনায় সিসিফাস, যে কিনা দেবতাদের দ্বারা দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে অনন্তকালের জন্যে ভারী পাথর পাহাড়ে উঠিয়ে চলেছে, সম্পর্কে বলেছিলেন “আমাদেরকে মানতে হবে যে সিসিফাস একজন সুখী মানুষ”। সিসিফাসের কাছে জীবন হচ্ছে সেই ভারী পাথরটি আর সেই পাহাড়টি, যে পাহাড়ের উপর ঠেলে ঠেলে সিসিফাস ভারী পাথরটি উঠায়। পাথরটি গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের পাদদেশে, সিসিফাস আবার সেটি ঠেলে ঠেলে উপরে উঠায়। কামু’র মতে সিসিফাস একজন সুখী মানুষ। সিসিফাস জীবনকে বেছে নিয়েছে, মরণকে নয়, সে বেঁচে আছে, কাজ যাই হোক, সে তার কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর।
সিসিফাসের মতোই আমরা প্রত্যেকে আমাদের যার যার জীবনের পাথর ঠেলে চলেছি প্রতিদিন। বাসায় কিংবা অফিসে, মাঠে কিংবা কলকারখানায়, রাস্তায় কিংবা হাটে, এক কিংবা অন্য মানুষের সাথে, প্রতিদিন আমরা কিছু না কিছু করে চলেছি। এই “কিছু না কিছু করা” কাজগুলোর বেশির ভাগেরই একটা ভবিষ্যৎ লক্ষ্য আছে। হয়তো আপনি আপনার ছেলেমেয়েদের জন্যে কাজ করছেন যাতে ওদের একটা চমৎকার নিরাপদ ভবিষ্যৎ তৈরি হয়, কিংবা হয়তো নিজের রিটায়ারমেন্ট এর জন্যে টাকা জমাচ্ছেন, কিংবা একটা স্কুল বানাচ্ছেন, কিংবা মাস শেষে টাকা পাওয়ার জন্যে একটা কোম্পানিতে কাজ করছেন। যাই করেন না কেন এই প্রতিটা দিনের সমষ্টিই কিন্তু আপনার জীবন।
একদিন হয়তো আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করবো, অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি, মানুষের ভালোবাসা সম্মান পাবো, দেশের জন্যে কিছু করতে পারবো, পৃথিবীর জন্যে কিছু করতে পারবো, কিন্তু সেই একদিন কিন্তু ভবিষ্যতের একদিন! ভবিষ্যৎ মানেই অজানা এবং অনিশ্চিত। এমনকি নিশ্চিত ভবিষ্যতেরও কিন্তু এখনো অস্তিত্ব নাই। আমি যদি দশ বছর ধরে কোন কিছুর জন্যে কাজ করে যাই তাহলে একদিন নিশ্চিত ফল পেলেও আমার জীবন থেকে কিন্তু দশ বছর চলে গেল! ওই দশ বছরের প্রতিটি দিন ছিল আমার জীবন। দশ বছরের শেষে যেদিন আমার স্বপ্ন পূরণ হলো সেদিন যেমন আমার জীবনের অংশ, এর আগের দশ বছেরের প্রতিটি দিনও তেমনিভাবে আমার জীবনের অংশ ছিল।
যে কারণেই হোক আমার মধ্যে সবসময় “কিছু একটার পেছনে ছোটা”র অভ্যাস ছিল। আমি ভুলে যেতাম যে ছুটতে ছুটতে আমি জীবনকে হারিয়ে ফেলছিলাম। স্বপ্ন পূরণ যেমন জীবনের অংশ, সেই স্বপ্নের পেছনে ছোটাটাও জীবনের একটা অংশ। দুটোকেই সমানভাবে উপভোগ করতে হবে। সম্প্রতি এই উপলব্ধি হওয়ার পর থেকে চেষ্টা করছি প্রতি দিন, প্রতি মুহুর্তকে উপভোগ করার জন্যে, এপ্রিশিয়েট করার জন্যে, বর্তমান মুহুর্তের প্রতি চোখ কান খোলা রাখার জন্যে।
কারণ, এই মুহুর্তই জীবন। জীবন ঘটে চলেছে।