বুক রিভিউ – সেপিঅ্যান্সঃ মানব (প্র)জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


Sapiens-book

 

ইতিহাসের প্রফেসর ইউভাল হারারির Sapiens: A Brief History of Humankind বইটা গত বছর বের হওয়ার কয়েক মাস আগেই আমাজন ডট কমে প্রি-অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় গত এক বছরে বইটা আর পড়া হয়ে ওঠেনি। তাই গত কয়েক সপ্তায় একেবারে পণ করে প্রতিদিন কয়েক পৃষ্ঠা করে পড়ে বইটা অবশেষে শেষ করেছি! এত পছন্দের একটা বই আর এত কষ্ট (!) করে পড়লাম তাই ভাবলাম একটা রিভিউ লিখে ফেলি!

বইটা চারশ পৃষ্ঠার চেয়ে সামান্য কয়েক পৃষ্ঠা বেশি, কিন্তু এর মধ্যে প্রফেসর হারারি মানুষের গত ৭০,০০০ বছরের ইতিহাসকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন।

আমাদের মানুষের যেই প্রজাতি যাকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় হোমো সেপিঅ্যান্স (Homo Sapiens) বলা হয় তার উদ্ভব গঠে প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে। কিন্তু আমাদের সত্যিকারের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি শুরু হয় প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে। হারারি এটার নাম দিয়েছেন “বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব” (Cognitive Revolution)। ইতিহাস নামক যে বিষয়টা আমরা পড়ি বা জানি তার শুরু এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের সময় থেকেই। এর আগের মানুষের যে আমাদের মানুষের মত বুদ্ধি ছিল এর তেমন কোন প্রমাণও পাওয়া যায়না।

এই সময় আমরা ভাষার সৃষ্টি করি। মানুষের মাঝে যোগাযোগ অনেক দৃঢ় হয় ভাষার কারণে। মানুষ দল বেঁধে চলা শুরু করে। এবং পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বারের মত মানুষ আফ্রিকার জঙ্গল থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

মজার ব্যাপার হলো এই সময় মানুষের শুধু একটা প্রজাতি ছিল না। মানুষের প্রায় পাঁচ/ছয়টা প্রজাতি ছিল তখন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল নিয়ান্ডারথাল (Neandarthal) মানুষেরা। কিভাবে নিয়ান্ডারথাল এবং অন্যান্য মানুষ প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হলো সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত নয়।

প্রায় ১১,০০০ বছর আগে শুরু হয় “কৃষি বিপ্লব”। কৃষি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত মানুষ ছিল মূলত শিকারি (Hunter-gatherer)। মানুষ নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে পশুপাখি শিকার কিংবা বিভিন্ন ধরণের পাতা-লতা-ফল-মূল খেয়ে বেঁচে থাকতো এবং এক জায়গায় বেশি দিন থাকতো না। কিন্তু কৃষি কাজ আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ চাষের জমি নির্ধারণ করে এর চারপাশে বসতি গড়া শুরু করে। প্রফেসর হারারির মতে কৃষি বিপ্লব মানুষকে আগের চেয়ে অসুখী এবং দুর্বল করে দেয়। আগে মানুষ বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিকর খাবার খেতে পারতো, শিকার করার কারণে মানুষের শরীর অনেক শক্ত ছিল। কিন্তু কৃষি কাজ করতে যেয়ে মানুষ এক ধরণের খাবার খেতে অভ্যস্ত হওয়া শুরু করে। আর কৃষি কাজের জন্যে ঝুঁকে ঝুঁকে কাজ করার ফলে মানুষের শারীরিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।

প্রায় ৫০০ বছর আগে শুরু হয় “বৈজ্ঞানিক বিপ্লব”। বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের হাত ধরে আসে “শিল্প বিপ্লব” এবং গত কয়েক দশকে শুরু হয় “তথ্য বিপ্লব” এবং “জৈব-প্রযুক্তি বিপ্লব”।

বইটির মূল বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে রাজত্ব করতে পেরেছে যেখানে ৭০,০০০ বছরের আগেও মানুষের চেয়ে বন-মানব বা শিম্পাঞ্জির শক্তি অনেক বেশি ছিল এবং বুদ্ধিও প্রায় সমান পর্যায়ে ছিল। মানুষের কী সেই গুণ যার দ্বারা মানুষ অন্য সব পশু পাখি এবং পুরো পৃথিবীকেই তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে?

এর উত্তর হারারি দিয়েছেন এভাবেঃ মানুষের রূপকথা (myth – মিথ) বা গল্প বানানো এবং সেই মিথ অন্যদের বিশ্বাস করানোর ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে মানুষের সাফল্যের মূলমন্ত্র। পুরো বই জুড়ে হারারি অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন মানুষের বানানো মিথের। যেমন – আমেরিকা একটা মিথ। বাংলাদেশ একটা মিথ। ফেইসবুক একটা মিথ। আমেরিকা, বাংলাদেশ, বা ফেইসবুক এই সব গুলোর অস্তিত্ব কিন্তু আমাদের মনে। আমেরিকা এবং বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে যেই মানুষগুলো থাকে তারা আমেরিকা এবং বাংলাদেশ নামক “দেশ” এর ধারণাকে মেনে নিয়ে এই মিথ তৈরি করেছে। কয়েক’শ বছর আগেও পৃথিবীতে কোন দেশ ছিল না। তখন ছিল সাম্রাজ্য – মিশরীয় সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য, অটোমান সাম্রাজ্য, অ্যাজটেক সাম্রাজ্য, ইনকা সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইত্যাদি। তখন মিথ ছিল সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক। এর আগের মিথ ছিল ধর্ম কেন্দ্রিক। এর আগে ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে ছোট ছোট নানা গোত্র এবং গোষ্টি। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সাম্রাজ্য, গোত্র, ধর্ম, কোম্পানি, দেশ, ইত্যাদি নানা ধারণার তৈরি করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে।

তেমনিভাবে ফেইসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট ইত্যাদি কম্পানী কিন্তু কিছু ধারণা ছাড়া আর কিছু নয়। এদের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নাই। সরকার নামে একটা মিথের মাধ্যমে আমরা কম্পানী নামের একটা মিথ এর আইনগত একটা অস্তিত্ব বজায় রাখি। সেই আইনও আরেকটা মিথ!

একটা খুব পরিচিত মিথ হচ্ছে টাকা। টাকা জিনিসটা বাস্তবে শুধু একটা কাগজ। কিন্তু আমরা সবাই টাকায় বিশ্বাস করি বলেই টাকার এত মূল্য। আগেকার দিনে সোনা ছিল টাকার মত বিনিময়ের মাধ্যম। এরও আগে ছিল রুপা।

প্রফেসর হারারির মতে আমরা মানুষেরা যে এক সাথে মিলে মিশে কাজ করতে পারি এর মূল কারণ হচ্ছে আমরা একদল অপরিচিত মানুষ মিলে একটা মিথ বানিয়ে বিশ্বাস করতে পারি এবং সেই বিশ্বাসের ছায়াতলে সবাই এক সাথে মিলে মিশে কাজ করতে পারি। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, কম্পানী ইত্যাদি হচ্ছে শক্তিশালী কিছু মিথের উদাহরণ। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী এভাবে গল্প বানিয়ে সেটাকে অন্যদের দ্বারা বিশ্বাস করাতে পারে না। একটা বানরকে কি কেউ মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবে বলে তার হাত থেকে কলা নিয়ে নিতে পারবে?

ইতিহাস শেষ করে প্রফেসর হারারি এরপর বর্তমান নিয়েও অনেকগুলো চ্যাপ্টার ব্যয় করেন। সভ্যতার চাকার সাথে সাথে মানুষ যে সুখী হতে পারেনি তার পক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়েছেন। এরপর তিনি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়েও বেশ কয়েক পৃষ্ঠা ব্যয় করেন। তাঁর ধারণা জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ এক সময় তার ক্ষমতাকে অনেক গুন বাড়িয়ে ফেলবে। এবং হাজার হাজার বছর পূর্বে মানুষ যে ঈশ্বরের ধারণা আবিষ্কার করেছিল মানুষ ধীরে ধীরে সেই ঈশ্বরের কাছাকাছি ক্ষমতা অর্জন করবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বইটার প্রতি আগ্রহী হওয়ার মূল কারণ ছিল পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্যে। প্রফেসর হারারি আমার সেই আশা পূরণ করেছেন। যেটা আমার ভালো লাগেনি সেটা হলো লেখক ইতিহাসের সাথে নিজের মতামত প্রদান করাকে পরম কর্তব্য জ্ঞ্যান মনে করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলেছেন ইতিহাসকে মূল্যায়ন করার কাজে। এই কাজটা তিনি তাঁর পাঠকদের জন্যে রেখে দিলেই ভালো করতেন।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: