১। যন্ত্রণা
ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে পৌনে সাতটায়। জীবনে কখনো কোনো দরকার ছাড়া এতো সকালে উঠেছি বলে মনে পড়ে না। অথচ এখন রোজ নিয়ম করে এই কাক ডাকা ভোরে (!) উঠতে হয়। উঠে বাথরুম সেরে, ব্রাশ করে, শেইভ করে, গোসল করে, ইস্ত্রি করা সাদা বা নীল রঙের স্ট্রাইপের ফর্মাল শার্ট আর কালো বা অন্য কোনো গাঢ় রঙের প্যান্ট চাপিয়ে টপাটপ একটু সিরিয়াল বা চা-বিস্কুট খেতে খেতে বেজে যায় আটটা। এরপর রীতিমতো দৌড় দিয়ে বের হই ট্রেন স্টেশন এর উদ্দেশ্যে। পাক্কা বারো মিনিটের হাঁটা পথ। ভাগ্য দেবতা সহায় থাকলে কখনো কখনো বের হয়ে বাস পাওয়া যায়। বাস ধরে বা পায়ে হেঁটে পৌঁছাই ট্রেন স্টেশন। এরপর কিউ বা এন ট্রেন ধরে লেক্সিংটন এভিনিউতে যেয়ে ট্রেন পরিবর্তন। ব্রঙ্কস থেকে ছেড়ে আসা তিন বা চার নম্বর ট্রেন ধরে এরপর ডাউনটাউন এর ফুলটন স্ট্রিট স্টেশন। ওখান থেকে দশ মিনিটের মতো হেঁটে এরপর অফিস। বাসা থেকে বের হবার পর নিজের ডেস্কএ পৌঁছাতে পাক্কা এক ঘন্টা চলে যায়। ট্রেনে বেশির ভাগ সময়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ডেস্কে বসার সময় দেখতে পাই আমার ম্যানেজার, তার ম্যানেজার, তার ম্যানেজার সবাই অনেক আগে অফিসে এসে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। নিজে দেরীতে আসার লজ্জায় মনে মনে বলি, ধরণী দ্বিধা হও। ধরণী দ্বিধা হয়না কোনোদিন, আমাকে বিরস মুখে আমার দিনের কাজ শুরু করতে হয়!
অফিস করতে হয় দশ/এগারো ঘন্টার মতো। আবার এক ঘন্টার যুদ্ধ করে বাসায় ফেরা। সব মিলিয়ে দিনের তেরো/চৌদ্দ ঘন্টার মতো চলে যায় অফিস এর পেছনে!
এই হোলো আমার ইদানিংকার কর্মজীবনের অবস্থা।
২। সুখ
দুই মাস আগেও ব্যাপারটা এরকম ছিলো না। ঘুম থেকে উঠতাম ইচ্ছেমতো। বাসার সামনে থাকতো গাড়ি। ড্রাইভ করে অফিসে যেতে লাগতো ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট। অফিসে যেয়ে ঢুকতাম নিজের অফিস রুমে। আমি কখন এসেছি কেউই সেটা খবর রাখতোনা। বারোটা বাজতে না বাজতেই লাঞ্চ টাইম। প্রায়ই বাইরে চলে যেতাম বন্ধুদের সাথে কিংবা টিমমেটদের সাথে। আরাম করে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ধীরেসুস্থে এসে অফিসে ঢুকতাম। চারটা সাড়ে চারটার দিকে এক টিম মেট এর সাথে ফুজবল (বোর্ড এ প্লাস্টিক এর প্লেয়ার আর বল দিয়ে ফুটবল) খেলতে বের হয়ে যেতাম। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে মনে হোতো অনেক কাজ হয়ে গেছে এবার বাসায় চলে যাইঃ)
বাসা ছিলো লেকের পাড়ে চমৎকার এক এপার্টমেন্টে। গাছগাছালিতে ভরা চারদিক, প্রায়ই পাখি এসে বসতো পেছনের গাছগুলোয়। লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে সব উঁচু উঁচু পাহাড় দেখা যেতো।
৩। নিউ ইয়র্ক
প্রায় দুই মাস আমি আমেরিকার পশ্চিম উপকুলের সিয়াটল শহর থেকে প্রায় তিন হাজার মাইল দূরে পুর্ব উপকুলের শহর নিউ ইয়র্কে চলে আসি। সিয়াটল এলাকা সম্ভবত আমারিকার সবচেয়ে সুন্দর এলাকা। বরফে ঢাকা পাহাড়, লেক, পার্ক, চারদিকে চিরসবুজ গাছের ছড়াছড়ি ইত্যাদি মিলে সিয়াটল এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। সেই তুলনায় নিউ ইয়র্ক অনেক বৈচিত্রহীন। নিউ ইয়র্ক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটি, যেদিকে চোখ যায় খালি ইট পাথরের বিল্ডিং। ব্রুকলিন কুইন্স এক্সপ্রেসওয়ে থেকে রাতের নিউ ইয়র্ক শহর এর দিকে তাকালে পুরো শহরটাকে এক জীবন্ত প্রাণী মনে হয়। শত শত আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং ম্যানহাটান এর এক প্রান্ত থেকে থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাতের ঝলমলো আলোতে পুরো শহরটাকে মানুষের তৈরি একটা বিশাল জীব মনে হয়।
৪। মানুষ
সিয়াটল এর সাথে নিউ ইয়র্ক এর সবচেয়ে বড় পার্থক্য আসলে অন্য জায়গায়। সিয়াটল এতো সুন্দর হয়েও কেমন যেনো খালি খালি। নিউ ইয়র্ক মানুষের শহর। চারদিকে খালি মানুষ আর মানুষ। সাদা-কালো-বাদামী, আমেরিকান-ইউরোপিয়ান-এশিয়ান, ওয়াল স্ট্রিট এর মিলিওনেয়ার, মেক্সিকো থেকে সাগর-নদী-জঙ্গল দিয়ে পালিয়ে আসা অবৈধ অভিবাসী, সারা পৃথিবী থেকে আসা টুরিস্ট – সব মিলিয়ে পুরো নিউ ইয়র্ক শহর সারাক্ষন থাকে সরগরম। নিউ ইয়র্ক এক অর্থে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক শহর বলা যায়। শহরের প্রান-কেন্দ্রে টাইমস স্কয়ার বলে একটা জায়গা আছে যেখানে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা টুরিস্টদের আনাগোনা। রাত তিনটার সময় যেয়েও লাইন ধরে রাস্তার পাশে কার্টে বিক্রি করা মজাদার মধ্যপ্রাচ্যীয় খাবার “ফালাফাল” খাওয়া যায়। টাইমস স্কয়ারে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে সারা পৃথিবীর সব ভাষা শোনা যাবে নিশ্চিত!
বাংলাদেশের সবচেয়ে সক্রিয় মানুষগুলো থাকে নিউ ইয়র্কে। এখানে সব সময় কোনা না কোনো প্রোগ্রাম লেগেই থাকে। গান, নাচ, কিংবা রাস্তাঘাট বন্ধ করে মেলা, একটা না একটা কিছু সব সময় চলতে থাকে। আছে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দলাদলিও!
৫। জ্যাকসন হাইটস
নিউ ইয়র্ক এর কথা সম্পূর্ণ হবেনা যদি না জ্যাকসন হাইটস জায়গাটার কথা না বলি। জ্যাকসন হাইটস হচ্ছে নিউ ইয়র্ক এর বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা। জ্যাকসন হাইটস এ আসলে যে কারো মনে হতে পারে সে আসলে এখন ঢাকার কোনো এলাকায় চলে এসেছে। চারদিকে বাংলা ভাষায় সাইনবোর্ড, লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরা চাচা, বোরকা পরা ধার্মিক মহিলা – এসব দেখে জ্যাকসন হাইটসকে আমেরিকার একটা জায়গা মনেই হয়না।
জ্যাকসন হাইটসএ আছে অসংখ্য বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট। বেশিরভাগই গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। উইকএন্ডএ বন্ধুবান্ধবের সাথে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টএ বসে চা-সিঙ্গারা খেতে খেতে রাজনীতি কিংবা অন্য কোনো রসালো বিষয় নিয়ে গল্প করার মজাই সেরকম!
৬। টুইন টাওয়ার এবং স্ট্যাচু অব লিবার্টি
সারা জীবন নিউ ইয়র্ক এর ছবি দেখলেই দু’টো জিনিস দেখতাম – টুইন টাওয়ার আর স্ট্যাচু অব লিবার্টি। সবসময় ভাবতাম, আহা যদি একবার নিউ ইয়র্ক যেয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে পারতাম! লাদেন মামার কল্যানে টুইন টাওয়ার আর দেখা হোলো না, কিন্তু ভাগ্যের কারসাজিতে আজ আমার অফিস টুইন টাওয়ার এর পাশে, এবং আমার অফিস থেকে পরিস্কার স্ট্যাচু অব লিবারটি দেখা যায়! অফিস থেকে দেখে যেনো সাধ মিটে না, মাঝে মধ্যে বিকেলবেলা অফিস থেকে বের হয়ে হাডসন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্ট দেখি।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখি কিছুক্ষণ পরপর ফেরী ছেড়ে যাচ্ছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি এর উদ্দেশ্যে, একেবারে স্ট্যাচু এর উপরে উঠা যায় নিচ থেকে। আমার আর কখনো স্ট্যাচু অব লিবার্টি এর উপরে ওঠা হোলো না। যে জিনিস চোখে দেখা যায় প্রতিদিন সেটা ফেরী করে যেয়ে দেখার দরকারটা কী? ওই যে বলে না, মক্কার লোকে হজ পায় না!
বিলাস ভাই,
আপনার ব্লগটা পড়লাম. বিশেষ করে মাইক্রোসফট নিয়ে লেখাগুলু, ভালো লাগলো অনেক.