Monthly Archives: October 2008

ঘর আমার ঘর

ঘর ছেড়েছি সেই কবে।

প্রথমবার ১৯৮৯ সালে। আগের বছর ক্লাস ফাইভ পাশ করে ঢাকা বেড়াতে এসেছিলাম  ডিসেম্বর মাসে। আব্বা আইডিয়াল হাই স্কুলের একটা ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম নিয়ে আসলো। ভর্তি পরীক্ষাও দেওয়া হলো। এবং কিভাবে কিভাবে যেন সত্তর জনের মধ্যে ছেষট্টিতম হয়ে টিকেও গেলাম। আমার আম্মা আল্লার কাছে দোয়া করেছিলেন আমি যাতে না টিকি। আম্মা ভাবলেন আমরা গ্রামে থাকি, বেড়াতে এসেছি খালাদের বাসায়, এর মধ্যে এত ভাল একটা স্কুলে টিকে গেলে না আমাকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে গ্রামের সাধারণ স্কুলগুলায় ভর্তি করাতে পারবেন (মানে খুব কষ্ট হবে আইডিয়ালে না দিয়ে গ্রামের স্কুলে দিতে), না ঢাকায় আমাকে রেখে আইডিয়াল স্কুলে পড়াতে পারবেন। তো টিকে যাওয়ার পর আম্মা পড়লেন মহা মুস্কিলে, ছেলেকে তিনি কোথায় রেখে পড়াবেন।

ঘটনাক্রমে আমরা যে খালার বাসায় বেড়াতে এসেছি উনি ছিলেন দাতা হাতেম তাই এর মহিলা সংস্করণ। উনি আমার আম্মাকে বললেন কেউ আইডিয়ালে এত সহজে চান্স পায় না, ও পেয়েছে, আমি ওকে আমার বাসায় রাখবো। খালাদের দুই রুম এর বাসাটাতে খালার তিন সন্তান ছাড়াও একজন টিউটর থাকতেন। এর মধ্যে খালা আমাকে রেখে দিলেন। আমার আম্মা তার বোন আর আল্লার হাতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে গেলেন।

আমার বয়স তখন সবে দশ ছেড়ে এগারোতে পড়েছে। যে ছেলেটি দশটি বছর গ্রামের পথে-ঘাটে-মাঠে, বনে-বাদাড়ে, পুকুরে, ধান ক্ষেতে, বাঁশ বাগানে, কাঁঠাল-তেঁতুল-কাম্রাঙ্গা গাছে তার উত্তাল শৈশব কাটিয়েছে মায়ের শাসন আর সোহাগের ভেতর, হঠাৎ করে সেই ছেলেটি আবিষ্কার করলো তার জীবনে এখন সেই গ্রামও নেই, আর তার মাও নেই। ঘর ছাড়ার কষ্টে, বেদনায় কাটতো আমার প্রতিটি দিন। আইডিয়াল স্কুলের কড়া শাসন আর মাকে ছেড়ে দূরে থাকার কষ্ট আমার শিশু হৃদয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল। মনে পড়ে আমি আমার ফুপুদের দোতলা বাসার ছাদের উপর যেয়ে দক্ষিন-পূর্ব দিকে তাকিয়ে থাকতাম ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের দিকে। ওই সড়ক দিয়েই আমাদের নোয়াখালীর বাসগুলো যেতো। বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর কল্পনা করতাম ওই বাসগুলোর একটা দিয়ে আমি নোয়াখালীর চাটখিলে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি। গ্রামে যেয়ে আমি অদৃশ্য হয়ে আমার আম্মাকে দেখছি। যেহেতু আম্মা চায়না আমি গ্রামে যাই তাই আমি কল্পনায় শুধু আম্মাকে দূর থেকে দেখে আসার কথা ভাবতাম। আরো মনে পড়ে আইডিয়াল স্কুলের জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম বাইরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলো কতো সুখী। আইডিয়াল স্কুলে আমার প্রতি মুহুর্তে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইতো।

সৌভাজ্ঞক্রমে আমার সেই ভয়াবহ দুস্বপ্নের দিনগুলো প্রায় দেড় বছরের মাথায় শেষ হয়ে আসে। ক্লাস সেভেন এর মাঝামাঝি সময়ে আমাদের পুরো পরিবার ঢাকায় চলে আসে। আমি ফিরে পাই আমার ঘর।

দ্বিতীয়বার ঘর ছাড়ি ১৯৯৮ সালে।

আমি সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল নভেম্বর মাসের পনের তারিখে। আমি অক্টবরের ঊনত্রিশ তারিখে তল্পিতল্পা গুছিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্য ঘর ছাড়ি। আমার আম্মা চোখের জলে তার সন্তানকে বিদায় জানালেন। আমার প্রাণের বন্ধুদের একজন আশিক আমাকে কমলাপুর স্টেশনে বিদায় দিতে গেল। ও বিদায় নেওয়ার আগ মুহুর্তে চোখের পানি ফেলল। আমার বুকে প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে থাকার বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠল। আমার এখনো মনে আছে আমি আশিককে বলেছিলাম, “দোস্ত, আমি যাচ্ছি অনেক ভালোভাবে (মানে অনেক সফল হয়ে) ফিরে আসার জন্য”। হায়, ভালো অনেক কিছুই আমি অর্জন করেছিলাম সিলেটে যেয়ে, কিন্তু আমার আর ফেরা হয়নি। আসলে ফেরা হয়েছে, কিন্তু সেটা খুব স্বল্প সময়ের জন্য। সিলেটে থেকেই আমি আবার, আরো লম্বা সময়ের জন্য ঘর ছাড়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছি।

সিলেটের পাট চুকাই ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে। চার বছরের ডিগ্রী অর্জন করি প্রায় ছয় বছরে। এরপর আবার ঘরে ফিরে আসি।

সর্বশেষ ঘর ছাড়ি ২০০৬ সালের মে মাসে।

আমেরিকার ওহাইও স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিটার বিজ্ঞানে পিএইচডি করার জন্য যোগ দিই ২০০৬ সালের জুন মাসে।

এরপর ঘটে গেছে আরো কতো ঘটনা। আমি পিএইচডি প্রোগ্রাম থেকে মাষ্টার্স এ পরিবর্তন করে চলে আসি। এরপর মাষ্টার্স শেষ করে চাকরীতে জয়েন করি। আমার স্ত্রীও এখানে চাকরী করে, কিন্তু সে আমার থেকে তিন হাজার মাইল দূরে থাকে। প্রায় আড়াই বছরের বিবাহিত জীবনে আমাদের সত্তিকারের ঘর বেঁধে একসাথে থাকা এখনো হলো না।

ঘরে ফেরা এখনো আমার কাছে একটা বড় স্বপ্ন। অবশ্য এখন ঘরে ফেরার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো ঘর বাঁধা। প্রায় তিন দশকের জীবনের একটা বড় অংশ ঘরের বাইরে কাটিয়ে দেয়ায় বুকের ভেতর থেকে শঙ্কা আর যায় না।

কবে পাবো আমার ঘর?

Tagged